ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৪০)

দার্শনিক হেলাল ভাই

: ভালই তো, ডাক্তার হলে সরাসরি অসহায় মানুষকে সেবা করার সুযোগ পাওয়া যায়। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেছেন-রোগাক্রান্ত মানুষের সেবা করার মধ্যে দু’টি আনন্দ পাওয়া যায়। প্রথমত: পরকালে এগুলির প্রতিফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত: রোগীকে সেবা করে সুস্থ্য করতে পারলে সীমাহীন আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়।
: জি খালাম্মা, আর আমাদের দেশে ডাক্তারের খুব প্রয়োজন। দার্শনিকের তেমন দরকার নাই।
: হিি হি। খালাম্মা শব্দ করে হেসে উঠলেন।
রিনি বলল: আর দর্শন মানুষকে কেমন পাল্টে দেয়। দর্শনে পড়তে গিয়ে আপা কেমন চুপচাপ টাইপের হয়ে গেছে। আগে এমন ছিল না। হেলাল ভাইকেও তো অদ্ভূত ধরনের মানুষ মনে হয়। তবে পাল্টানো মানুষ আমার ভাল লাগে। মানুষ তো পাল্টাবেই। পাল্টায় না গাছ-পালা, পশু-পাখি। যে মানুষ যত বেশি পাল্টায়, সে মানুষ তত বেশি সফল ও সুন্দর। আপাকে এখন আগের চেয়ে সুন্দর লাগে।
: ঠিক, তোমার চিন্তা-ভাবনা স্বচ্ছ ও সুন্দর।
: ধন্যবাদ খালাম্মা। এই কথাটা আপনিই প্রথম মুখ ফুটে বললেন। অন্যরা বলতে চায় না।
তারপর খালাম্মা উঠে ভেতরে গেলেন। রিনি হেলাল ভাইকে বলল: হেলাল ভাই, আপনার দেখা একটা সুন্দর মেয়ের নাম বলেন তো।
ভেবেছিলাম হেলাল ভাই লজ্জায় মুখ ফেরাবে। কিন্তু না। চট করে বলে ফেলল: সুচিত্রা সেন। এমন রোমান্টিক চেহারার নারী আমি আর জীবনে একটাও দেখিনি। এঞ্জেলিনা জোলিও সুন্দর, তবে সুচিত্রা সেনের মতো রোমান্টিক না।
আমি খুশি হলাম। হেলাল ভাই সুন্দর একটা জবাব দিয়েছে।
কিন্তু রিনি চুপসে গেল। সে যেন বসে থাকার সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। হতাশ কন্ঠে বলল: ঠিক আছে, আজ উঠি হেলাল ভাই। আপনি ঠিকমতো ওষুধ খারেব। ফল-মূল, শাক-সবজি বেশি খাবেন। আর আমরা তো বিশেষ কিছু নিয়ে আসিনি। রোগি দেখতে এলে কিছু আনতে হয়। এই টি-প্যাক, পাউরুটি, আর বারবিকিউ ফ্লেভারের চানাচুর রেখে গেলাম, খাবেন।
: আরে না, এসব রেখে যাবার দরকার নেই।
: চা-টা উপকারে আসবে। ঠিক আছে, আসি…..।
আমরা নিচে নেমে এলাম। রিনির মন খারাপ ভাব। বলল: হেলাল ভাইয়ের কথায় খুব অবাক হলাম-কষ্টও পেয়েছি।
ঝিনি আপা বলল: অবাক হবার মতো বা কষ্ট পাবার মতো কিছু বলেনি সে।
: বলে নাই? তুমি কি কানে তুলো দিয়ে ছিলে? বলল না, সুচিত্রা সেনই তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ও রোমান্টিক নারী?
: ঠিকই তো বলেছে। সে সহজ-সরল মানুষ। কী বললে তুই খুশি হোতি তা সে বুঝতে পারে নাই।
: তবে যাই বলো, খালি গায়ে তাকে কিন্তু বেশ লাগছিল। খালি গায়ে পুরুষ মানুষকে এতটা সুন্দর লাগে তা আমার তা জানা ছিল না। আচ্ছা আপা, তুমি এমন কেন? ওখানে একটা কথাও বললে না। কেমন চুপ মেরে বসে রইলে।
আমি হেসে ফেললাম। রিনি ধমক দিয়ে বলল: ফিক ফিক করছো যে? এখানে ফিক ফিক করার মতো কী হল?

৯ 
কয়েক দিনের মধ্যে হেলাল ভাই পরিপূর্ণ সুস্থতা নিয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এল। আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো মোজাফ্ফরের চায়ের দোকান।
ফিরে গেলাম সেই পুরণো বিষয়ে, হেলাল ভাইয়ের প্রেম। রিনির সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে হবে। মানে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রেমের পথ থেকে ওকে সরাতে হবে। তারপর হেলাল ভাইয়ের চূড়ান্ত প্রেমপর্ব শুরু হবে ঝিনি আপার সাথে।
একবার চাইনিজ রেস্টুরেন্টে রিনির সাথে বসার কথা ছিল। আফজাল ভাই সে সিদ্ধান্তকে পন্ড করে দিল। রিনি আর ঝিনি আপার হেলাল ভাইয়ের বাসায় গেল। তখন তো আমরা কেউ কথা বলার কোনো সুযোগই পেলাম না। যা বলার রিনিই বললো। আর তখন বাসার ভেতরে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে কথা বলার অবস্থাও ছিল না।
হেলাল ভাই বলল: রিনির সাথে স্পষ্ট করে কে কথা বলতে পারবি?
আমি বললাম: আমরা ওর কাছে পাত্তা পাই না। যা বলার আপনারই বলা উচিত।
: না, আমি বলবো না। তোদের ভেতর থেকে একজন বা দু’জন গিয়ে ওর সাথে কথা ফাইনাল করবি।
: কী কথা?
: মাথা থেকে প্রেমের ভূত নামিয়ে ফেলার কথা।
: ও তো বলে বসবে-প্রেম প্রস্তাব দিয়েছিল কেন? তখন মনে ছিল না?
: বলবি, আমি আমার ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছি। মানুষ ভুল করে, আবার ভুল শুধরেও নেয়। ওর পরীক্ষার কথা স্মরণ করে দিবি। বলবি, প্রেমের ক্ষেত্রে আবেগ যতটা কাজ করে প্রজ্ঞা ততটা করে না। তাই আবেগকে পরিহার করতে হবে। এইচ.এস.সি তে খারাপ হয়ে গেলে বিপদ হবে। ডাক্তারি পড়বে বলে এইম ঠিক করেছে। রেজাল্ট এদিক-সেদিক হয়ে গেলে মেডিকেলে চাঞ্চ পাওয়া টাফ হয়ে যাবে। ডাক্তার তো দূরের কথা, কম্পাউন্ডারও হতে পারবে না। কে কে যাবি রিনির কাছে বল?
ফেকু রিনির সাথে কথা বলতে রাজি হয়ে গেল। হেলাল ভাই আমাকে বলল: তুই ফেকুর সাথে যাবি।
: অন্য কাউকে পাঠান। ও মাথা খারাপ মেয়ে। ওর কাছে কথা বলার ফ্লোর পাওয়া যায় না।
ফেকু বলল: তোর কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমি বলব। তুই শুধু আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবি।
রিনি কলেজ থেকে ফিরছিল রিকশা করে। পথে আমি আর ফেকু ওর পথ আটাকালাম। রিকশাওয়ালার মুখ শুকিয়ে গেল। ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভয় পেলে অনেক সময় মানুষ মরিয়া হয়ে উঠে। সে আঙ্গুল তুলে আমাদেরকে বলল: শোনেন, আইজ আপনেরা এই মা জননীরে ঝামেলায় ফেলবেন তো কাইল পুলিশ আপনেগো ঝামেলায় ফেলব। আপনেগো সাথে ঝামেলায় পড়বো আপনেগো বাপ-মা। পার পাইবেন না।
আমি চুপ। ফেকু তো বলেই এসেছে, যা বলার ও বলবে। ফেকু বলবো: আপনার মা-জননীরে আমরা কী ঝামেলায় ফেলব? সে-ই তো আমাদেরকে মহাঝামেলায় রেখেছে।
রিনি মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভয়ে নয়, রাগে। আমাদেরকে ভয় পাবার মতো পাত্রী সে না। সে রিকশাওয়ালাকে বলল: রিকশা ঐ গাছের নিচে দাঁড় করান।
রিকশাওয়ালা কম্পিত হাতে রিকশা টেনে নিয়ে গাছের নিচে দাঁড় করাল।
ফেকু কিছু বলার আগেই রিনি মুখ খুলল। আর রিনি মুখ খোলা মানেই তো দশ নম্বরের একটা প্যারাগ্রাফ বলে যাওয়া। রিনি বলল: বলো, হেলাল ভাই কোনো খবর দিয়েছে? আমি তার কাছ থেকে নেগেটিভ-পজিটিভ কিছু একটা জানতে চাই। আই এ্যাম ওয়েটিং ফর হিজ ওয়ার্ড। অল অব ইউ নো দ্যাট আই লাভ হিম ভেরি মাচ। আই লাভ হিম মোর দ্যান এ্যানিওয়ান অব দ্যা ওয়ার্লড। কিন্তু সে নিষ্ঠুর লির্লিপ্ততা দেখাচ্ছে। আমি এটা সহ্য করতে পারছি না। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে নির্লিপ্ত থাকা এক রকমের হিপোক্রেসি। কোনো মেয়ের মনের সাথে ভন্ডামি করার অধিকার কারও নেই।
এই প্যারাগ্রাফটার নাম কী হতে পারে? হতে পারে, ‘কিশোরীর ভালবাসা।’ এরকম একটা প্যারাগ্রাফের পরে কেমন করে বলা যায় যে, হেলাল ভাই বলেছে, তার পথ থেকে সরে যেতে? কেমন করে বলা যায় যে, ঝিনি আপার জন্য হেলাল ভাইয়ের পথ ক্লিয়ার করে দাও?
যা হোক, আমি অপেক্ষায় আছি, ফেকু তো একটা কিছু বলবে। সে বীর-পালোয়ানের মত বলেছিল-তোকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমি বলবো, তুই শুধু আমার সাথে যাবি।
ফেকু একটা কথাও না বলে মাথা নিচু করে উল্টো দিকে হাঁটা দিল। আমিও ও পিছে পিছে। ফিরে আসতে শুনলাম রিকশাওয়ালা বলছে: আমি তো মারাত্মক ডর খাইছিলাম। আইজকাল প্রায়ই শুনি, বখাইটা পোলাপান মাইয়াগো সাথে খারাপ আচরণ করে আর সেই ফটো তুলে। তারপর আন্টারেট না কি জানি আছে সেইখানে ছাইড়া দেয়।
: আপনি চুপ করে রিকশা চালান।
: তয় আমার জান থাকতে আপনের শরীলে হাত দিতে…..।
: আপনাকে চুপ করে রিকশা চালাতে বলছি। ওরা অনেক ভাল ছেলে। এরকম ছেলে বর্তমান সময়ে কম হয়।
রিনি আমাদেরকে ভাল ছেলে বলল। শুনে আমার মনটা খুব প্রশান্ত হল।
হেলাল ভাই কিন্তু ফেকুর সাথে কোনো রাগ দেখাল না। শান্ত কন্ঠে বলল: তোরা যে ওর সাথে কথা বলতে পারবি না সেটা আমি ধারণা করেছিলাম। যা হোক, এটা আবেগের বয়স। খুব ভেবে-চিন্তে কাজ করতে হবে। ওর নার্ভাস সিস্টেমে কোনো আঘাত না লাগে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

আমরা আগের মতো নিয়মিত মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে বসতে শুরু করেছি। হৈ-হুল্লোরে মেতে আছি।
তবে অসুখ থেকে ফিরে আসার পর থেকে হেলাল ভাই কিছুটা চিন্তামগ্ন তাকে। উদাসীনভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকে। ডাক দিলে চমকে উঠে। লোকটা ভালবাসার কাঙ্গাল ছিল। এখন একসাথে দুই বোনের ভালবাসা পেয়ে ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে গেছে।
সকাল সাড়ে দশটার মত হবে। আমাদের স্কুল-কলেজ কী কারণে যেন সেদিন বন্ধ। আমরা বসে আছি মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে। হেলাল ভাই কড়া লিকারের এক কাপ চা নিয়ে আসে-সুস্থে খাচ্ছে। আর তখনই সেখানে এল টিটু। টিটু ক্লাশ সিক্সে পড়ে। এলাকার নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ছোট ভাই। টিটু খুব শান্ত স্বভাবের। বড়দের সম্মান করে কথা বলে। তাই আমরা সবাই ওকে খুব ভালবাসি। তাছাড়া, ও আমাদের সাথে খেলাধুলাও করে। এ বয়সেই চমৎকার ব্যাটিং করে। আবার স্পিন বোলিং-এও খুব দক্ষতা আছে। স্লোস্পিডে বল করে, কিন্তু বলকে ঘুরাতে পারে খুব। ঠিকমতো প্রাকটিস চালালে ও বাংলাদেশের একজন নামকরা ক্রিকেটার হতে পারবে বলে আমরা মনে করি।
টিটুর দুই হাতের মুঠোয় ভাঁজ করা দু’টি কাগজ। টিটু হেলাল ভাইয়ের মুখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।