কর্ণফুলির গল্প বলায় মোঃ মনজুরুল ইসলাম

সৌমেন দেবনাথের ছোটোগল্প “দারিদ্র্যের কাঠগড়ায়”: মানুষের অস্তিত্ব ভাবনার প্রাঞ্জল প্রকাশ

জীবনের অজস্র বৈচিত্র্যময় মুহূর্তের একটি রূপ ছোটোগল্পের উপজীব্য। জীবনে ঘটে চলা চলমান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার শৈল্পিক উপস্থাপন, নিরাসক্তভাবে উপস্থাপন ছোটোগল্পে থাকে। কথাসাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠতম শাখা ছোটোগল্প হলেও অতুলনীয় ও সমৃদ্ধ; বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অনন্য। কারণ ঘটনায় এলোমেলো ডালপালা থাকে না, কাহিনি নিটোল, সুডৌল, সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট আবার ইঙ্গিতপূর্ণ। জীবনের সহজ-সরল যাপন, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ-উল্লাসঘন মুহূর্তগুলো অনন্য বর্ণনায় উপস্থাপিত হয় ছোটোগল্পে। একটি প্লটে একটি ভাবনা ব্যঞ্জনাধর্মী ঘটনায় এগিয়ে যায়। অসাধারণ বয়ান-কৌশলের কারণে সাধারণ প্লটের গল্পও অসাধারণ হয়ে উঠে। ছোটোগল্পের কাহিনি গতিময়ে রূপায়ণ, তীব্র গতিস্রোতে বহমান যার আঙ্গিক, বিষয় ও ঘটনা একমুখী যা কিনা একটি ঘটনার নাটকীয় ব্যঞ্জনাধর্মী, রসপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। ঘটনা একমুখী আর ঘটনায় আকস্মিকতা থাকলেও চরিত্রের নানামুখী রূপ থাকে৷ ছোটোগল্প বিস্তারিত বিবরণধর্মী না, তবে সংকেতনির্ভর। স্বল্পায়তনের খণ্ডচিত্র, কিন্তু সংক্ষিপ্ত উপন্যাস নয়। সময়ের ব্যাপ্তি স্বল্পক্ষণের, একবার বসে পড়ে নেওয়া যায়। জীবনের পূর্ণাবয়ব নয়, জীবনের খণ্ডাংশকে রসনিবিড় করে উপস্থাপন ছোটোগল্পে থাকে। সুদীর্ঘ চরিত্রচিত্রণ অপ্রয়োজন। বিষয়বস্তুর মধ্যে সংগ্রাম থাকে। ছোটোগল্প যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, তবে রসঘন ও নিবিড় কাহিনিপ্রবল। চকিত চমকে ছোটোগল্পের যে যাত্রা তা ক্ষুদ্র পরিসরে, যা এক ভাবকেন্দ্রীক, আবেগ-প্রবাহের ব্যাপ্তিহীন। ছোটোগল্প যেমন চকিতে শুরু, তেমনি শেষাংশেও অজ্ঞাত, চকিতে শেষ। তবে শেষাংশে ক্ষিপ্রতা, চমক, মোচড়, বাঁক, চরম উৎকণ্ঠা, নাটকীয়তা, আকর্ষণীয়তা থাকে। বিস্ময় ভরা তৃষ্ণা, আরও পড়ার তৃষ্ণা, চাবুক মারা সমাপান শেষাংশে থাকা বাঞ্ছনীয়।

সৌমেন দেবনাথের “দারিদ্র্যের কাঠগড়ায়” তেমনি একটি ছোটোগল্পের বই, যেটি পাঠান্তে মনে হবে কিছু না কিছু প্রাপ্তি আছে। বইটিতে ছোটোগল্প আছে আটটি। ছোটোগল্পের বিষয়বন্তু, চরিত্রসৃষ্টি, পরিবেশসৃষ্টি, কথোপকথন বেশ নান্দনিক। হাঁস ডুব দিয়ে প্রতি ডুবে ঝিনুক, শামুক না পেলেও পাঠক ছোটোগল্পগ্রন্থটির প্রতিটি গল্প পাঠ শেষে মুক্তোর ঝুলিক পাবেনই।

গল্পগ্রন্থটির প্রথম গল্প “শেষের কবিতার শেষ পৃষ্ঠা” একটি অনন্য ছোটোগল্প। প্রেমের বিচিত্র লীলা, বিচিত্র পরিবেশের বিচিত্র মানুষের বিচিত্র চিন্তা-ধারা, বিচিত্র মানুষের বিচিত্র অবস্থা ও অবস্থান ছোটোগল্পটি পড়ে জানা যাবে। কেন্দ্রীয় চরিত্র নির্মল আর শ্বেতার মধ্যের সম্পর্কের মনোদ্বান্দ্বিক বিষয়ই ছোটোগল্পটির উপজীব্য। প্রাপ্তির নেশা উভয়রেই প্রবল থাকলেও চাওয়াশূন্যতায় পাওয়া অধরা থাকা ছোটোগল্পটিতে অসামান্য বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে। চরিত্রের অন্তর্গত জগৎকে মুন্সিয়ানায় সৌমেন দেবনাথ উপস্থাপন করেছেন। অনন্য সুন্দর কথোপকথনে এগিয়ে গিয়েছে ছোটোগল্পের কাহিনি। একটি ঘটনার শিল্পরূপ ছোটোগল্প, সেই সূত্রে “শেষের কবিতার শেষ পৃষ্ঠা” সত্যই সুন্দর শিল্পকর্ম। একটি মনস্তাত্ত্বিক ছোটোগল্পের সুন্দর উদাহরণও বটে।

গল্পগ্রন্থটির দ্বিতীয় ছোটোগল্প “হৈমন্তীর মন”। এটিও সুন্দর ছোটোগল্প। কেন্দ্রীয় চরিত্র হৈমন্তী আর অপু। যাদের গীতময় প্রেমচেতনার অনন্য বর্ণনা আছে ছোটোগল্পটিতে। হৈমন্তীর যখন রবীন্দ্রর সাথে বিবাহ হয়ে যায় তখন হৈমন্তীর পূর্ব প্রেমের যাতনা আর নতুন স্বামীর প্রতি অনাগ্রহ গল্পের মূল কাহিনি। পূর্ব স্মৃতির প্রতি মনের আকুলতা আর নতুন করে জাগ্রত প্রেমের প্রতি সাড়াদান, এই দোটানায় পড়লে একটি মানুষের কী অবস্থা হতে পারে তাই ছোটোগল্পটির প্রাণ। ছোটোগল্পটি মনোদ্বান্দ্বিক ছোটোগল্পের উদাহরণ হবে বৈকি।

গল্পগ্রন্থটির তৃতীয় ছোটোগল্প ” আরেক জীবন” -এ সেই জীবনের আখ্যান বর্ণনা যে জীবন সচরাচর স্বাভাবিক জীবন নয়। নির্মম কঠিন বাস্তব জগৎ, মানব মনের জটিল রহস্য, সংকট ও সংগ্রামের বিষয়টি “আরেক জীবন” গল্পে ফুটে উঠেছে। রিক্সাচালক বদরুল আর তার বছর বছর বাচ্চা দিতে থাকা বৌ জরিমন, পাশাপাশি দেহবিলাসী, দেহরঞ্জনবিকাশধারিণী মহিলা নছিমন বিবি গল্পের প্রাণ। বস্তিতে বসবাস করা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, তাদের ভেতর অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপ, এক অনালোকিত প্রান্তর “আরেক জীবন” গল্পে বিবৃত হয়েছে। সামাজিক অসংগতির সুন্দর উদাহরণ হতে পারে ছোটোগল্পটি।

গ্রন্থটির চতুর্থ ছোটোগল্প “দীর্ঘয়ী”। যেটির কেন্দ্রীয় চরিত্র দীর্ঘয়ী ও শৈবাল, যারা প্রেম করে বিয়ে করে পরিবারের অজ্ঞাতে। পরিবার জানলে পরিবার থেকে সৃদৃষ্টি ও শুভকামনা পায় না। তারা অন্যত্র বসবাস শুরু করে। তাদের সংগ্রামমুখর জীবন এই ছোটোগল্পের উপজীব্য। অপূর্ব প্রেমনির্ভর বাক্য আর টানাপোড়েনে ছোটোগল্প এগিয়ে যায়। শৈবালের জীবনকে গভীর ও সূক্ষ্মদৃষ্টিতে অবলোকন করার পর শৈবালের সুন্দর মানসিকতা আর সুন্দর ভবিষ্যতের কারণে টানাপোড়েনের সমাপ্তি ঘটে। গল্পটি নিছক ও নিরেট প্রেমের গল্প।

পঞ্চম ছোটোগল্পটির নাম “সিদ্ধান্তের বাঁক”। যেটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে আইরিন ও রাতুল। তারা দুই বন্ধু মিলেমিশে পড়াশোনা করে, ঘোরে, আড্ডা দেয়। জিসানের সাথে আইরিনের বিয়ে ঠিক হয়। আইরিন রাতুল ও জিসানের সাথে ঘোরাঘুরি করে বুঝতে পারে দুটি মানুষের মধ্যে পার্থক্য ভীষণ। রাতুলের অন্তর্জীবনের সাথে জিসানের ভীষণ পার্থক্য, অগ্রহণীয়। জিসানের বহির্জীবনের সাথে রাতুলের ভীষণ পার্থক্য। দুটি মানুষের প্রতি আইরিনের বিচিত্র উপলব্ধি, অনুভূতি, মানসিক অবস্থা এই ছোটোগল্পের মূল উপজীব্য। এটি একটি নিরেট প্রেমোপখ্যান।

ষষ্ঠ ছোটোগল্পটির নাম “বরফ না গলা নদী”। তমাল ও তুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব “বরফ না গলা নদী” ছোটোগল্পের মূল কাহিনি। ছোটোগল্প জীবনের খসড়া। সাংসারিক জীবনের এক টুকরো খসড়া এই ছোটোগল্পটি। যেখানে সাংসারিক টানাপোড়েন, অর্থনৈতিক যাতনা, মনোবিষয়ক অন্তর্ঘাত দৃশ্যমান। জীবনাভিজ্ঞতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন ছোটোগল্পটি। যেখানে প্রেমপ্রবল জীবন ও বাস্তব জীবনের সংঘাত দেখা যায়। কল্পনার জগৎ আর বাস্তবতার জগতে যে ভিন্নতা আছে তা তমাল তুলির চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন লেখক। বাস্তবতার অনন্য এক বয়ান “বরফ না গলা নদী”।

সপ্তম ছোটোগল্পটির নাম “টাইম পাস”। কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে সুধা। সুধা আবার লেখকের প্রিয় বান্ধবী। লেখকের কাছ থেকে একাধিক ছেলের মোবাইল নম্বর নিয়ে সুধা টাইম পাস করে। আবার এই সুধাই ছোটোবেলার বন্ধু হাসানের সাথে প্রেম করে। লেখক তার বান্ধবী সুধার মাধ্যমে এমন এক চরিত্রের অবতারণা করেছেন পাঠ করলে বিস্ময় জাগে। সাহিত্যরূপের মূখ্য উপাদান চরিত্র। এই ছোটোগল্পটিতে চরিত্রের আধিক্য আছে। তবে প্রত্যেকটি চরিত্রই গল্পের জন্য আবশ্যক ছিলো। কিছু সাধারণ চরিত্র আছে, কিন্তু বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। একদমে এক বসায় পড়ে ফেলার মতো দারুণ একটি প্রেমনির্ভর গল্প “টাইম পাস”। যা পাঠে টাইম কেটে যাবে রেঙে রেঙে।

অষ্টম ও শেষ ছোটোগল্পটি “দারিদ্র্যের কাঠগড়ায়”। কেন্দ্রীয় চরিত্র এহসান সমাজের সেই শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এই শ্রেণির মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, জীবন-সংগ্রাম, জীবনবিন্যাস, তাদের জীবনের রঙিনতা, স্বপ্ন, আশা ছোটোগল্পের উপজীব্য। বাস্তবতা আর কল্পনার সংমিশেলে শৈল্পিক চিত্রায়ণ রয়েছে ছোটোগল্পটিতে। এহসান ও নৈরীতার সম্পর্ক, সম্পর্ক না পরিণতির কারণ, এহসানের পড়া ছেড়ে রিক্সা চালানো, বন্ধুদের কাছে হেয় হওয়া দারুণ মুন্সিয়ানায় উপস্থাপন করেছেন লেখক।

“দারিদ্র্যের কাঠগড়ায়” ছোটোগল্পগ্রন্থটির ফ্ল্যাপ লিখেছেন একজন শিক্ষক। আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ আলামিন স্যারের লেখা ফ্ল্যাপটিও একটি শিল্পকর্ম। ফ্ল্যাপটি না তুলে ধরলে সাহিত্য সম্বন্ধে ন্যূন হলেও অজানা থেকে যাবে।

“ছোটোগল্প বাংলা সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। গল্প আর ছোটোগল্প স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ছোটোগল্প জীবনের বিস্তৃত-বর্ণিত উপাখ্যান নয়, আঁটোসাঁটো রচনা। লেখকের ব্যক্তিত্বমণ্ডিত অনুভূতিই ছোটোগল্পের বীজ। ছোটোগল্পের উপস্থাপনায় নাটকীয় কৌশল আর সমাপ্তিতে আকস্মিক চমক থাকা বাঞ্চনীয়। সর্বাধুনিক সাহিত্যশিল্প এই ছোটোগল্পে থাকে জীবনের খণ্ডচিত্র। সৌমেন দেবনাথের ছোটোগল্পের প্লট নির্মাণ অভিনব, শব্দচয়ন নান্দনিক, চরিত্র-চিত্রণ চিত্তাকর্ষক, উপস্থাপন রীতি-ভঙ্গি আধুনিক। মানুষের বিস্ময়, আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন-কল্পনা, জীবন প্রণালী, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, সংগ্রাম, প্রেম-চেতনা, প্রকৃতি-চেতনা ও রহস্যানুভূতির অপরূপ মিশ্রণ আছে তার ছোটোগল্পে। জীবনমন্থিত ছোটোগল্পগুলোর গতি দুরন্ত। বিষয় নির্বাচনে তার অন্তর্শক্তির প্রয়োগ দৃশ্যমান। যুগমানস, সমাজমানস ও ব্যক্তিমানস-সচেতন লেখকের ছোটোগল্পগুলো সূর্যস্পর্শী, শীর্ষস্পর্শী। সুখদুঃখপূর্ণ জীবন গল্পবস্তু ও রূপরীতিতে জীবন্ত রূপ পেয়েছে। তার ছোটোগল্পগুলোর আঙ্গিকবিন্যাস, ভাষাবিন্যাস, বিষয়বিন্যাস, গঠনকৌশলও চিন্তাপ্রসূত ও নিরীক্ষাপ্রবণ। জীবনসত্য ঘটনার গ্রন্থন নৈপুণ্য ও মায়াবী বুনন দেখে আমার উপলব্ধি তার শিল্পমানস লক্ষ্যাভিমুখী এবং সপ্রতিভ। শাব্দিক অলংকারে রচিত তার শব্দ-পাহাড় ছোটোগল্পগুলো কত বেশি শিল্পগুণে ও শিল্প প্রকরণে উত্তীর্ণ এবং শিল্পসম্মত তা সময় বলবে। সাবলীলতা ও সহজতায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশমানগুণ তাকে দীর্ঘদূর নিয়ে যাবে এ আমার বিশ্বাস। তার শিল্পসত্তা ও শিল্পকৌকর্য ক্রমাগত বিকশিত হোক এই প্রত্যাশা থাকলো। পাশাপাশি তার প্রকাশিত প্রথম ছোটোগল্পগ্রন্থ এই ‘দারিদ্র্যের কাঠগড়ায়’ পাঠকমহলে সমাদৃত হবে এই শুভাশিস থাকলো।”

ছোটোগল্প মানবিক শিল্পকর্ম যেখানে জীবনবিন্যাসের ব্যাখ্যা ও অভিজ্ঞতার নির্যাস বিদ্যমান থাকে। ঘটনার বৈচিত্র্য ও ঐক্যময় শিল্পরূপ ছোটোগল্পের প্রাণ। বিষয়ে ব্যঞ্জনা স্বভাবধর্ম ছোটোগল্প। ক্ষণকালীন ঘটনাংশে চিরকালীনের ব্যঞ্জনা থাকে ছোটোগল্পে। সৌমেন দেবনাথের ছোটোগল্প পাঠে সেই ব্যঞ্জনা, সেই নাটকীয়তা, বিচিত্র উপলব্ধি, অনুভূতি, সংকেত পাওয়া যায়। পাওয়া যায় জীবনঘনিষ্ঠ কথাবার্তা, কল্পনা-বাস্তবতার সংমিশেল, আছে জীবনের যাতনা, আছে জীবনে প্রাপ্তির ডালি। গ্রন্থটি লেখকের প্রথম গ্রন্থ। সুপাঠ্য গ্রন্থটি সংগ্রহে রাখার মতোই।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।