T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় মানিক দাক্ষিত

সর্বংসহা নারী

নারী সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, ভরসা ও সভ্যতার প্রতীক। সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নারী। নারী ছাড়া
এ-জগত একেবারেই অচল, অসম্পূর্ণ । সৃষ্টির মধ্য দিয়ে
আবহমানকাল নারী সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে
অতি সযত্নে তা রক্ষা করে চলেছে। নারী প্রকৃতি। কল্যাণী-
রূপে নারী ঐশ্বর্যময়ী। নারী শুধুমাত্র রমণী নয়, নারী
মহিয়সী মা, ভগিনী, জায়া ও দুহিতা। নারীর সৌন্দর্য
নিয়ে কবি লেখকদের কি উচ্ছ্বাস কি অসীম কল্পনা
তা সর্বজনবিদিত।

আমরা যতই নারীর জয়গান গাই না কেন, বাস্তবে তা
ভিত্তিহীন। সত্যি কথা বলতে কি, পুরুষশাসিত সমাজে
নারীরা চিরদিনই অবহেলিতা, লাঞ্ছিতা এবং রীতিমতো
অত্যাচারিতা। নিজের সংসারে প্রতিনিয়ত তারা বিভিন্ন
ধরনের অত্যাচারের মুখোমুখি হয়। কারণে অকারণে
দিবারাত্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়। দুঃসহ
নারীর জীবন। নারীরা চিরকাল বাল্যে পিতার, যৌবনে
স্বামীর এবং বার্ধক্যে ছেলের অভিভাবকত্বে বা অধীনে
থাকতে হয়। তাদের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা নাই।
তারা আগে এখন পরে অর্থাৎ কোনোকালেই স্বয়ং –
শাসিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না।

মধ্যযুগে তো নারীর অবস্থা ছিল অতি ভয়ংকর ও
শোচনীয়। নানা ধর্মীয় অনুশাসনে, সামাজিক নানা
বিধিনিষেধের বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়েছিল। বাল্য-
বিবাহ, কুলীন প্রথা,অশিক্ষা, সতীদাহের মতো জঘন্য
ঘৃণ্য প্রথা তদানীন্তনকালে নারী জীবনকে করে তুলে –
ছিল অতিষ্ঠ এবং দুর্বিষহ। সেকালে মেয়েদের লেখা –
পড়া ছিল অবৈধ এবং গর্হিত কাজ। মেয়েদের লেখা –
পড়া শেখা অর্থহীন। যুক্তি ছিল, মেয়েদের লেখাপড়া
সমাজে অমঙ্গল ডেকে আনে। লেখাপড়া শিখলে
মেয়েরা বিধবা হয়, স্বামীদের প্রতি অবজ্ঞা বাড়ে,
পরপুরুষে আসক্তি জন্মায়। মেয়েরা ব্যভিচারিনী
হয়। বাইরের জগত নারীর জন্য নয়। তারা ঘরে থেকে
মন দিয়ে ঘর সংসার করবে, পরমযত্নে পতিদেবতা
এবং পরিবার পরিজনের সেবা করবে, সন্তানের জন্ম
দেবে এবং তাদের প্রতিপালন করবে। নিজস্ব মতামত
থাকবে না। সংসারে স্বামীর আজ্ঞাবহ দাসী হয়ে থাকতে
হবে। ঘরসংসার দেখা, পতিসেবা এবং পুত্রসন্তানের
জন্ম দেওয়াই হলো স্ত্রীর পরম ধর্ম। কন্যাসন্তানের জন্ম?
নৈব নৈব চ। কন্যাসন্তানের জন্ম দিলে পরিবার থেকে
স্ত্রীর ওপর নেমে আসতো শাস্তির খাঁড়া। বাড়ি থেকে
বিতাড়িত, নয়তো আজীবন বাক্যবাণে মানসিক
যন্ত্রণা। কথায় আছে — সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।
উপরোক্ত গুণগুলিই হলো রমণীর গুণ। সেগুলি থাকাই
ছিলো বাঞ্ছনীয়। পতির কোনপ্রকার গুণের দরকার
ছিলো না সংসারে সুখ শান্তির জন্য।

আধুনিককালে নারীদের সামাজিক অবস্থা সামান্য
উন্নতি হলেও সামগ্রিকভাবে নারীরা এখনও শৃঙ্খলিত
অন্ধকার কারায় অবস্থান করছে। নারীরা এখন
অনেকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে
রাজনীতিতে, খেলাধূলায় প্রভূত উন্নতিসাধন এবং
স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তবুও কিন্তু তারা তাদের হৃত
ব্যক্তি স্বাধীনতা ফিরে পাননি। স্বামীর কথায় তাদের
এখনও উঠতে বসতে হয়। স্বামীর প্রভুত্ব তাদের
নির্দ্বিধায় মেনে চলতে হয়। অন্যথায় বয় সংসারে
চরম অশান্তির ঝড়।

আমরা মহা আড়ম্বরে অতি ধূমধামসহকারে মণ্ডপে
মণ্ডপে মন্দিরে মন্দিরে মা দুর্গা, মা কালী, মা মনসা,
মা সন্তোষী, মা মহালক্ষ্মী প্রভৃতি নারী দেবীদের পরম
ভক্তিভরে পূজা-অর্চনা, আরাধনা করি। কিন্তু সমাজ
সংসারে যে চিন্ময়ী দুর্গা লক্ষ্মীমায়েরা সুখ সমৃদ্ধির
জন্য স্বার্থত্যাগ করে অহর্নিশ নিজেদের প্রাণপাত
করে চলেছেন, সেদিকে আমাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ
নাই। গার্হস্থ্য নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, খুন এটা তো
এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এছাড়াও পুরুষশাসিত
সমাজে নারীর প্রতি সহিংসার নানা চিত্র রয়েছে।
যেমন রয়েছে — যৌনাঙ্গচ্ছেদ, জোরপুর্বক পতিতাবৃত্তি,
মেয়েপাচার, জোরপূর্বক বিয়ে, ধর্ষণ, অনার কিলিং,
কন্যভ্রুণ হত্যা, এসিড ছোঁড়া, বিধবাদের মঙ্গলকাজে
অশুচি আখ্যা দিয়ে অংশগ্রহনে মানা, ডাইনি সন্দেহে
মৃত্যুদণ্ড, যৌতুক নিয়ে দুই পরিবারে বিবাদ — বধূর
মৃত্যু বা আত্মঘাতী এরূপ রয়েছে অসংখ্য দৃষ্টান্ত।

শাস্ত্রে মনু বলেছেন, যেখানে নারী পূজিতা, সেখানে
দেবতাও খুশী হন, যেখানে তাঁদের পূজা নাই, সেখানে
সকল ধর্মকর্মই নিষ্ফল।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, যে সমাজে মাতৃশক্তি
অবহেলিত হয়, সেই সমাজ কোনোদিন নিজের মেরুদণ্ড
সোজা করে উঠে দাঁড়াতে পারে না।

পরিশেষে বলি, সমস্ত নারীর মধ্যে রয়েছেন সেই
দেবী, যিনি নারীমূর্তিতে মর্ত্যে আবির্ভুত হয়েছিলেন।
শক্তিরূপে সমস্ত নারীর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিতা।
জগৎজননী মা বলেছেন —জগতের সমগ্র নারীজাতিই
আমার এক একটা রূপ। প্রতিটি ঘরে ঘরে আমি
জননী, জায়া, কন্যারূপে বিরাজিতা। সুতরাং আমাদের
শুভবুদ্ধি হোক জাগ্রত। যেদিন আমরা রমণীকে
যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দিতে পারবো, নারীকে
জননীজ্ঞানে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতে পারবো, সেদিন
এই জগৎ সংসারে প্রতিটি পরিবারে আসবে সুখ,
সমৃদ্ধির সাথে অপার শান্তি। নারীরা শিক্ষার সাথে
পাক মানসিক স্বাধীনতা। নারী পুরুষের অসম সম্পর্ক
হোক দূরীভূত। তৈরী হোক তাদের মধ্যে সুষম এক
আত্মিক সম্বন্ধ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।