T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় মধুসূদন দরিপা
by
·
Published
· Updated
কুঁচ তেলের গল্প
আমার বাবার মাথায় চুল ছিল একেবারে পিছনের দিকে । কয়েক গাছি । বাকি একেবারে কপাল থেকে পুরো মাথা ফাঁকা । চকচকে টাক । বাবার চোখ দুটো ছিল বড়ো বড়ো । নাক ছিল টিকালো । খুবই রাশভারী মানুষ । ভয়ানক রাগী । কিন্তু তাঁর রসবোধ ছিল দুরন্ত ।
সেটা সত্তরের দশকের প্রথম দিকের কথা । আমাদের স্টেশনারি জিনিষের পাইকারী দোকান । ঠাকুর্দার আমলের । জবাকুসুম তেল, লক্ষ্মীবিলাস তেল, শালিমার নারকেল তেল, টাটা কোম্পানীর 501 বার -হামাম সাবান, ভারত-পানামা ব্লেড ইত্যাদি হরেক রকম জিনিষের পরিবেশক । সরাসরি কোম্পানী থেকে মাল আসত । বাজারের সব খুচরো দোকানে অর্ডার করে মাল দেওয়া হত ।
বাবার বয়স তখন ৪৫ /৪৬ হবে । সারা দিন দোকানেই বসতেন । আমার তখন ১৫/১৬ বছর বয়স । ক্লাস টেনে পড়ি । পড়াশুনো করতে করতেই দোকানে বসাটা আমাদের পারিবারিক রীতির মধ্যেই ছিল । বড়দাও বসত । কলেজে পড়ত । সন্ধেবেলা সব কোম্পানীর লোকেরা আসত । বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন চেহারার বিভিন্ন চরিত্রের সব মানুষ । বাবাকে দাদা বলত তাদের অনেকেই । অনেকদিন ধরে আসা যাওয়ার ফলে সেলসের লোকদের সঙ্গে বাবার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠত । ঠাট্টা ইয়ার্কি হত । সে-সময় বাবাকে একদম রাগী মানুষ বলে মনে হত না । বরং অত্যন্ত একটা সরস রসালো মানুষ উঠে আসত তাঁর ভেতর থেকে । বাবার উচ্চ রসবোধ সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আবাল্য আকর্ষণের পরিচয় তুলে ধরত ।
বাবার কাছে শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর স্বচক্ষে দেখার গল্প । রবীন্দ্রনাথ এই শহরে এসেছিলেন ১৯৪০ সালের ১ মার্চ । জেলা শাসকের বাংলোতে ছিলেন তিন দিন । ঠাকুমার সঙ্গে গিয়ে লাইন দিয়ে বাবা কবিকে প্রণাম করেছিলেন ।
আমাদের দোকানে সন্ধেবেলার জমজমাট মজলিশে আসতেন পাঁজাদা । ওনার একটা নাম ছিল নিশ্চয় । কিন্তু তিনি সবারই পাঁজাদা । বাবা যদিও ডাকতেন পাঁজা বলে আর পাঁজাদা বাবাকে দাদা বলতেন । কিন্তু দোকানের বাকি সবাই বাবার বয়সী কিম্বা বাবার চেয়ে বড়ো যারা তারা সবাই এমনকি দাদা এবং আমিও ওনাকে পাঁজাদা বলেই ডাকতাম । মাসের মাঝামাঝি সময়ে আসতেন কলকাতা থেকে । ট্রেন থেকে নেমেই ব্যাগ কাঁধে দোকানে দোকানে অর্ডার করতে করতে হেঁটে হেঁটে মেসে এসে ঢুকতেন । জিওফ্রে ম্যানার্স কোম্পানীতে কাজ করতেন । ফরহ্যান্স পেস্ট, টুথ ব্রাশ, গ্লিম শ্যাম্পু ইত্যাদি প্রোডাক্ট ছিল ।
পাঁজাদার বৈশিষ্ট্য ছিল তার সিগারেট খেতে খেতে বিখ্যাত হাসি আর অসাধারণ সব হিউমার । যেকোন ঘটনার প্রেক্ষিতে তুলে নিয়ে আসতেন বিখ্যাত সব মনীষীদের জীবনের রসালো ঘটনা । শুধু আমাদের দেশের নয় বিদেশেরও । অনবদ্য সব তুলনা । তখন বুঝিনি । অত গভীরে বোঝার মতো বয়স হয়নি । কিন্তু বয়সকালে এসে সেইসব ঘটনা ভাবি যখন তখন বিস্মিত হয় মন । সেলস লাইনের মতো একটি ক্লান্তিকর একঘেয়ে পেশার মানুষ কিভাবে এমন ক্ষুরধার রসবোধের অধিকারী হয়ে ওঠেন । অর্থাৎ পাঁজাদার পড়াশোনা ছিল সাহিত্যে বেশ ভালো রকমই ।
কুঁচ তেলের গল্পটা বলি । কুঁচ তেলের কোন কোম্পানীর কাজ ছিল না বাবার । একদিন সন্ধে বেলা এক ভদ্রলোক এলেন চামড়ার ব্যাগ কাঁধে । বাবাকে নমস্কার করে বসলেন চেয়ারে । তারপর ব্যাগ থেকে কয়েকটি ছোট ছোট কুঁচ তেলের শিশি বের করে বাবার সামনে টেবিলের ওপর রাখলেন ।
বাবা বললেন, ‘ হ্যাঁ । বলুন । কি এগুলো ? ‘
ভদ্রলোক বললেন, ‘ দাদা এটা কুঁচ তেল । ‘
তখন দাদা কিম্বা নামের সঙ্গে ‘ দা ‘ যোগ করে রাম-দা, শ্যাম-দা, মধু-দা এই ধরণের সম্বোধনই চলত । কিম্বা নামের সঙ্গে ‘ বাবু ‘ যোগ । এখনকার মতো ‘ স্যার, ‘ কাকু, জেঠু, মিস্টার, সাহেব ইত্যাদি সম্বোধন ছিল না ।
বাবা বললেন, ‘ কুঁচ তেল ? কি হয় ? গায়ে মাখে না মাথায় ? ‘
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ বলতে শুরু করলেন পাখি পড়ার মতো ।
” আমাদের কোম্পানী চুল পড়া বন্ধ এবং টাকে চুল গজানোর একটি যুগান্তকারী তেল আবিস্কার করেছে । এই তেল প্রাচীন আয়ুর্বেদ উল্লেখিত কুঁচ বা গুঞ্জফল ফল থেকে তৈরি । কুঁচ ফলের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাব্রাস প্রিকেটোরিয়াস । ভারত ছাড়া এই ফল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও তাইল্যান্ডে পাওয়া যায় । আমাদের দেশে রক্তকুঁচ ও শ্বেতকুঁচ এই দুই ধরণের কুঁচ ফল পাওয়া যায় । রক্তকুঁচ ফল বা রতি সোনা পরিমাপে ব্যবহার করা হয় । শ্বেতকুঁচ বা শ্বেতগুঞ্জা ফলের নির্যাস থেকে সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পরীক্ষা নিরীক্ষা গবেষণা করে আমাদের কোম্পানী এই যুগান্তকারী তেল আবিস্কার করেছে । আমাদের কোম্পানী গ্যারান্টি সহকারে ঘোষণা করছে যে এই তেল ব্যবহার করলে অবশ্যই চুল পড়া বন্ধ হবে এবং নতুন চুল গজাবে । যাদের মাথায় টাক আছে তাদের মাথায় নতুন চুল বেরোবে । গ্যারান্টি । আমাদের প্রোডাক্টের নাম ‘ নো-Bald কুঁচ তেল ‘ । অর্থাৎ আর কোন চিন্তা নেই । মাথায় টাক পড়বে না । নো-Bald. নো-টাক । গ্যারান্টি । “
পাশের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাঁজা-দা হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ ব্রেভো ! ব্রাদার ! ব্রেভো ! এ তো দেখছি তেল মাখতেই হবে না । আপনার লেকচার শুনেই টাকে চুল গজাতে শুরু করবে । ‘
ভদ্রলোক তার কথায় প্রথমে একটু থতমত খেয়ে অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিলেন । বললেন, ‘ চল্লিশ বছরের রিসার্চ দাদা । চুল তো গজাবেই । শিগগিরই আমাদের কোম্পানী খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে গ্যারান্টি দিয়ে । ‘
বিজ্ঞাপনের কথা শুনে পাঁজা-দা বললেন, ‘ জানি তো । আপনাদের এই কুঁচ তেলের সার্টিফিকেট লিখে দেবার জন্য আপনাদের কোম্পানী তো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে সুপারিশ করেছিল । কবি প্রথমে রাজি হননি । পরে লিখে দিয়েছিলেন । ‘
ভদ্রলোক পাঁজা-দার কথায় অপ্রতিভ হয়ে মাথা নেড়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ এটা তো জানা ছিল না । ‘
পাঁজা- দা বাবাকে চোখ টিপে কৌতুক বাড়িয়ে বললেন, ‘ দাদা । তুমি তো রবি ঠাকুরকে প্রণাম করতে গিয়েছিলে সেই সময় তোমার মায়ের সঙ্গে । মনে পড়ছে ? ‘
বাবা পাঁজা-দার রসিকতা উপলব্ধি করে হিউমার বাড়াতে সঙ্গে যোগ দিলেন ।
‘ হ্যাঁ । হ্যাঁ । মনে পড়েছে । একটি কুঁচ তেলের কোম্পানী এসেছিল তাঁর কাছে । কয়েক শিশি তেল উপহার দিয়েছিলেন কবিকে । ‘
পাঁজা-দা ভদ্রলোককে বললেন, ‘ শুনুন কবিগুরু কি বলেছিলেন । আপনার ওই লেকচারে এটা অ্যাড করে নেবেন । কাজে লাগবে । ‘
ভদ্রলোক পাঁজা-দার কথার যাদুতে তখন পুরো কাত । ব্যাগ থেকে একটা প্যাড আর পেন বের করে সিরিয়াসলি লিখে নেবার উদ্যোগ নিলেন ।
পাঁজা-দা বললেন, ‘ হ্যাঁ লিখে নিন । মুখস্থ করে নেবেন । কবি লিখেছিলেন,
‘ কুঁচ তেল ব্যবহার করে আমি যার-পর-নাই উপকৃত হয়েছি । আমার মাথার দু’ পাশে দুটি টাক ছিল । কুঁচ তেল ব্যবহার করার ফলে দুটি টাক মিলে মিশে একটি টাকে পরিণত হয়েছে । কাজেই, টাকের সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে কুঁচ তেলের কোন জুড়ি নেই । ‘
পাঁজা-দার কথা শেষ হতেই বাবা সহ দোকানের সবাই হো হো করে হেসে উঠল । তেল কোম্পানীর ভদ্রলোকটি লেখাতে মগ্ন ছিলেন । সকলের হাসির রোলে চমকে উঠে অবাক হয়ে পরিস্থিতি বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন ।
পাঁজা-দা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ দাদা ! তোমার তো পুরো টাক । তুমিই আগে ট্রাই করো । ‘ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে পাঁজা-দা খ্যাঁক খ্যাঁক করে তার সেই বিখ্যাত হাসিতে হেসে উঠলেন ।
বাবা পকেট থেকে রুমাল বের করে পেট থেকে উঠে আসা হাসি চাপতে প্রয়াসী হলেন ।
তেল কোম্পানীর ভদ্রলোক বাবাকে জিগগেস করলেন, ‘ তাহলে দাদা । আমাদের তেল কোম্পানীর কাজটা কি করবেন ? ‘
বাবা তাকে বললেন, ‘ হ্যাঁ । করব । নিশ্চয় করব । রবি ঠাকুরের সুপারিশ বলে কথা । তবে একমাস পরে । ‘
ভদ্রলোক একটু অবাক হলেন বাবার কথায় ‘ এক মাস পরে কেন ? ‘
বাবা এবার পাঁজা-দার দিকে চোখ টিপে ভদ্রলোককে বলে উঠলেন, ‘ আপনারও দেখছি আমার মতোই মাথায় কয়েক গাছি মাত্র চুল । আপনি নিশ্চয় আপনাদের কোম্পানীর এই ‘ নো-Bald কুঁচ তেল ‘ ব্যবহার করছেন । কোম্পানীর গ্যারান্টি দিচ্ছে যখন । এক মাস পর আসুন । দেখি আপনার মাথায় চুল গজাচ্ছে কি না । যদি গজায় । আমিও গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনাদের কোম্পানীর কাজ আমি করব । ‘
ভদ্রলোক বাবার কথা শুনে খানিকটা কাঁচু মাচু করে নিজের টাকে হাত বুলাতে বুলাতে ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়ালেন । বাবাকে নমস্কার করে বললেন, ‘ আচ্ছা তাই হবে । এক মাস পরেই আসব তাহলে । চলি ‘ তারপর গুটি গুটি পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
পাঁজা-দা আর বাবা এবার একসঙ্গে খুব জোরে হেসে উঠলেন । দোকানের বাকি আমরা সকলেও তাদের সাথে সেই হাসিতে যোগ দিলাম ।
বলা বাহুল্য অজ্ঞাত কারণে ওই কুঁচ তেল কোম্পানীর ভদ্রলোক এক মাস পরে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি । ফলে কোম্পানীর গ্যারান্টি মোতাবেক তার টাক মাথায় নতুন চুল গজিয়েছিল কিনা সেকথা যেমন জানা হয়ে ওঠেনি । তেমনই পাঁজা-দার কাছে লিখে নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঁচ তেল সম্বন্ধীয় বিজ্ঞাপনটি তিনি মুখস্থ করেছিলেন কিনা সেকথাও অজানা রয়ে গেল চিরকালের জন্য ।