কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ৩)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ
সঙ্ঘ গঠনের প্রথম ধাপ
যেকোনো কাজ করতে গেলে তার ভিত খুব শক্তপোক্ত হওয়া দরকার। তাই প্রণবানন্দ (তখন অবশ্য ব্রহ্মচারী বিনোদ) সঙ্ঘের ভীত শক্ত করার কাজে মন দিলেন। সেই সময় তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ তরুণ দলকে ত্যাগের আদর্শে গড়ে তোলার কাজ শুরু করলেন। কুমুদ, সুরেশ, ক্ষিতীশ, বাণীকান্ত, নিকুঞ্জ, যতীন্দ্র এরা সকলেই বাজিতপুর হাই স্কুলের ছাত্র। এবং আচার্য দেবের শিক্ষা ও সংস্কার নিয়ে ত্যাগী জীবন গঠনে ব্রতী। এরাই ছিল ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মূল চালিকা শক্তি। কেমন ছিল এদের ত্যাগ এবং তিতিক্ষার শিক্ষা না জানলে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে ঠিকভাবে জানা যাবে না। আচার্য প্রণবানন্দজির খুব অন্তরঙ্গ সন্তান নিকুঞ্জ, যাঁর সন্ন্যাস নাম স্বামী আত্মানন্দজি মহারাজ ওনার ডায়েরি ( শ্রীশ্রীযুগাচার্য জীবনচরিত) থেকে কিছু কথা লিপিবদ্ধ করব।
শ্রাবণ, ১৩২৬ সন,ইং আগষ্ট,১৯১৯
“প্রহ্লাদের দৃঢ়তা, শঙ্করের জ্ঞান, শ্রীচৈতন্যের প্রেম,বুদ্ধের ত্যাগ বৈরাগ্যের কথা চিন্তা করবে। ত্যাগেই সুখ, ত্যাগেই শান্তি, ত্যাগেই আনন্দ; ভোগাকাঙ্ক্ষা যেখানে, সেখানেই অসুখ, অশান্তি।…. ভারতবর্ষ ত্যাগীর দেশ, ধর্মের রাজ্য, ভারতবাসী অমৃতের সন্তান, তাকে আবার স্বীয় আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সমগ্র দেশময় ত্যাগের আবহাওয়া নৈতিক আবহাওয়া সৃষ্টি করতে হবে।ত্যাগীর দল চাই, তাদের উন্নত আদর্শে, তাদেরই সাধনা ও তপস্যায় দেশের ভোগপঙ্কিল আবহাওয়া শুদ্ধ পবিত্র হবে।…তখন সেই নূতন সাধনার ভিতর দিয়ে জন্ম নেবে আদর্শবান, নীতিপরায়ণ, স্বধর্মনিষ্ঠ খাঁটি ভারতীয় জাতি।”এইসব উপদেশের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভারত কল্যাণের চিন্তা, হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের চিন্তা। এই প্রসঙ্গে স্বামী বেদানন্দ লিখছেন :
১। তিনি সনাতন আদর্শে প্রতিষ্ঠিত, স্বধর্মনিষ্ঠ ভারতীয় জাতির গঠন চাহিতেছেন।
২। উক্ত কার্য সাধনের জন্য -সমাজ ও জাতির সেবায় উৎসর্গীকৃত জীবন একদল ত্যাগী কর্মী চাহিতেছেন।
৩। এই ত্যাগী কর্মীগণকে প্রিয় আদর্শে ত্যাগ সংযম সত্য ব্রহ্মচর্যের ভিত্তিতে গঠনপূর্বক সমাজ জাতির সম্মুখে স্থাপন করিতে চাইতেছেন।
৪। তিনি যে ভগবন্নির্দ্দিষ্ট আচার্য, সমাজ ও জাতির তথা জগতের কল্যাণকর বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আবির্ভূত; সেই ভাবের কিঞ্চিৎ আভাস দিতেছেন।১০
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের পুণ্যময়ী মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বাজিতপুর সিদ্ধপীঠে প্রথম সঙ্ঘসন্তানদের ব্রহ্মচর্য সংস্কার দান করলেন আচার্যদেব। প্রত্যেক সন্তানকে দিলেন কৌপিন ও বহির্বাস। সঙ্ঘের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল। এবার আচার্যদেব তাঁর সন্তানদের বিশ্বকল্যাণ যজ্ঞে আত্মাহুতি দেবেন। অর্থাৎ তিনি যে জন্য দেহ ধারণ করেছেন এবার সচেতনভাবে সেই কাজ শুরু করবেন। প্রত্যেক সন্তানের রুচি, কর্মদক্ষতা ও সংস্কার অনুযায়ী বিভিন্ন রকম কাজে নিয়োগ করলেন। তিনি সঙ্ঘসন্তানদের বাজিতপুর, মাদারীপুর, খুলনা, আশাশুনি বিভিন্ন সেবাশ্রমে ও কলিকাতা কার্যালয়ের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত রাখলেন। সন্তানদের মনোভাবনা যাতে না ভেঙে যায় সেই জন্য তিনি মাঝে মাঝে ২/৪দিন বিভিন্ন আশ্রমে যেতেন এবং তাদেরকে উৎসাহ ও প্রেরণা দিতেন। কখনো কখনো প্রিয় সন্তানদের চিঠি লিখতেন। সেইসব চিঠি ‘সঙ্ঘগীতা’তে লিপিবদ্ধ আছে।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। ফেব্রুয়ারি মাসে বাজিতপুর সিদ্ধ পীঠে অনুষ্ঠিত হবে মাঘী পূর্ণিমা উৎসব। প্রতিবারের ন্যায় এবারও ছাপা হল প্রচারপত্র। সঙ্ঘ সন্তানদের নির্দেশ দিলেন ব্রহ্মচারী নামের পূর্বে আচার্য কথাটা বসাতে। বললেন: “এই যুগে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির পক্ষে যা সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর, তা আমি আমার চিন্তা, বাক্য, কার্য ও সাধনার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলে সকলকে শিক্ষা দিয়ে যাব। সেজন্য আমার নামের পূর্বে ‘আচার্য’ এই অভিধাটি যুক্ত করতে হবে। গুরু অনেকে হতে পারেন, কিন্তু আচার্য আসেন- এক এক যুগে এক এক জন।”১১
আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সঙ্ঘের নামকরণ। বাজিতপুরে শ্রীশ্রী মাঘী পূর্ণিমা মহোৎসব শেষ হল। আচার্যদেব বসলেন তাঁর প্রিয় সন্তানদের নিয়ে আলোচনা সভাতে। বললেন, আমার সঙ্ঘ হবে দ্বিতীয় বুদ্ধের সঙ্ঘ। আমি সমগ্র দেশ ও জাতিকে বুদ্ধ, শঙ্কর, চৈতন্যের মতো নূতন আদর্শ ও তপঃশক্তিতে সঞ্জীবিত করতে চাই।”সঙ্ঘের নামকরণ করলেন ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ।’সন্তানেরা জানতে চাইল এইরূপ নামকরণের কারণ? আচার্যদেব বললেন : “এই সঙ্ঘ ভারতীয় আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভারতের সুমহান ধর্ম, সংস্কৃতি, আদর্শ ও ভাবধারা সমগ্র জগতে প্রচার করবে। ভারতীয় জাতীয়তার পুনর্গঠন করবে। সেজন্য সঙ্ঘের নামের মধ্যে ‘ভারত’ কথাটি থাকা আবশ্যক।
সেবাই সঙ্ঘের ধর্ম, সেবাই সঙ্ঘের কর্ম- সমগ্র মানবজাতির শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক -সর্বপ্রকার সেবাই হবে এই সঙ্ঘের প্রধান কাজ। সেজন্য ‘সেবা’ কথাটিও থাকবে।
এই সঙ্ঘের মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রাচীন ভারতের বৈদিক ভাব ও শিক্ষা-সংস্কৃতির আদর্শ। সনাতন বৈদিক আদর্শ হবে এই সঙ্ঘের ভিত্তি। সুতরাং ‘আশ্রম’ কথাটিও বাদ দেওয়া চলবে না।
‘সঙ্ঘ’ এই শব্দটির দ্বারা সূচিত হবে -সেই বৌদ্ধ যুগের সন্ন্যাসী সঙ্ঘের অনুরূপ সংহতি বা সঙ্ঘ-চেতনা সৃষ্টি। আমি সঙ্ঘশক্তি সৃষ্টি করতে চাই। এই ছিন্ন-বিছিন্ন বিশাল জাতিকে এক ধর্মসূত্রে গেঁথে নিয়ে একটি বিরাট শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনই এই সঙ্ঘের উদ্দেশ্য। সুতরাং নামের মধ্যে সঙ্ঘ-শক্তিসূচক শব্দ থাকা চাই।”এই নামকরণের মধ্যে দিয়েই আচার্যদেব বুঝিয়ে দিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা।
(ক্রমশ)