সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মানস চক্রবর্ত্তী – ৩১

মর্তকায়ার অন্তরালে

|| ৩১ ||
একদিন সুপ্রভাদেবী চেপে ধরলেন হলে গিয়ে ওর সঙ্গে সিনেমা দেখতে হবে | বিভূতিভূষণ ‘না’ করে দিলেন | সিনেমার প্রতি অনুরাগ বিভূতিভূষণের কোনো কালেই ছিল না |

সুপ্রভাদেবীও মেনে নিলেন, কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস বিভূতিভূষণকে দুঃখ দিল | তাই বিভূতিভূষণ সুপ্রভাদেবীর রাগ ভাঙিয়ে আবার রাজি করালেন সিনেমা দেখতে | ‘মুক্তি’ দেখছেন দুজনে পাশাপাশি বসে চিত্রা হলে | হঠাৎ সুপ্রভাদেবী বিভূতিভূষণের হাতের মধ্যে নিজের হাতখানা রাখলেন | বিভূতিভূষণ একটু অপ্রস্তুত | সুপ্রভাদেবী নিজের হাতে বোনা একখানি রুমাল দিলেন | বিভূতিভূষণ হল থেকে বেরিয়ে যতই বলুক , এর চাইতে বাপু আমার ছেঁড়া জামাটা রিপু করে দিলে বেশি কাজে লাগত | কিন্তু এ রুমালের রেশ আমৃত্যু থেকে গিয়েছিল বিভূতিজীবনে | এই পর্বে আর একটি উল্লেখ করার বিষয় হলো চিঠির আদান-প্রদান | সুপ্রভাদেবী প্রথম চিঠিতে বিভূতিভূষণকে লিখছেন : “সব সময় ভাবছি আপনার কথা | এবার আর শিলঙ ভাল লাগছে না একলা | কী লগ্নেই যে পরিচয় ঘটল আপনার সঙ্গে | আচ্ছা কেন এমন হয়? ….” বিভূতিভূষণ যখন চিঠির উত্তর পাঠাতেন সঙ্গে কয়েকটা বকুল ফুল ঘামের মধ্যে ভরে দিতেন |

বৈদ্যনাথধামে বেড়ানোর স্মৃতি ক’দিনের হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিভূতিভূষণ ও সুপ্রভাদেবীর সম্পর্কে | সুপ্রভাদেবী এখানে বিভূতিভূষণের ছেঁড়াজামা সেলাই করে দিয়েছিলেন | বালিশের সুন্দর করে খোল তৈরি করেছিলেন | “বিছানাপত্তর একটু ভালো করুন এবার ” – এ কিসের ইঙ্গিত দিলেন সুপ্রভাদেবী এ মননশীল পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় | ‘যৌবন সরসী নীরে’ গানটি শোনালেন সুপ্রভাদেবী | দেওঘরের অভিজ্ঞতার কথা প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ তাঁর ডাইরিতে লিখলেন : “ওর মতো মমতাময়ী মেয়ের সাহচর্য ক’জন পায়?”

কিন্তু বিভূতিভূষণ সেই সাহচর্যে নিজেকে বাঁধলেন না | অমিয়াদেবী চেয়েছিলেন দুটিতে জুটি হয়ে থাকুক | “আমি মুক্ত পথিক ” – এই বলে বিভূতিভূষণ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন | মুখে যাই বলুক, সত্যিই মনে মনে চেয়েওছিলেন, তবুও পারলেন না | সে গল্প আজ থাক | হয়তো অন্য কোনোদিন অন্য কোনো স্থানে তা লেখার ইচ্ছে রাখলাম |

কল্যাণী প্রসঙ্গে ফিরি | ওদের বিয়ে হয় ১৯৪০এর ৩ডিসেম্বর তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি | কিন্তু বিবাহিত জীবন বেশিদিনের ছিল না | মাত্র দশ বছর | বিভূতিভূষণ চলে যাচ্ছেন ১৯৫০এর ১নভেম্বর | বিভূতিভূষণের কল্যাণী তখন সাতাশ বছরের | ভরা যৌবন আর শিশু সন্তান নিয়ে বিধবা | আমৃত্যু বিভূতিভূষণের ভালোবাসা সম্বল করে পড়ে থাকলেন রমা দেবী | দশ বছরের সংসার জীবনের কোন্ ভালোবাসা তাঁকে আমৃত্যু বিভূতি অনুরাগিনী করে রাখল ? সেই রসায়ন উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে রমাদেবী ও বিভূতিভূষণের দাম্পত্য জীবনের কিছু কিছু ঘটনার কথা জানতে হবে |

রমাদেবী মানুষটাকে যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছিলেন এবং অনেকখানি সার্থকও হয়েছিলেন | তাঁদের সুযোগ্য সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আমার বাবা বিভূতিভূষণ’ গ্রন্থে বেশকিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন | তারই কিছু পাঠককে শোনানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না | প্রবন্ধের খাতিরেও তা যুক্তিসিদ্ধ |

বিয়ের কয়েকমাস পরেই রমাদেবীকে নিয়ে বিভূতিভূষণ চলেছেন বেড়াতে |সিদ্ধেশ্বর ডুংরিতে গিয়ে হাজির | রমাদেবীর বয়স তখন সতেরো | সকাল থেকে হাঁটা হয়েছে সাত আট মাইল | অত হাঁটার অভ্যেস নেই | স্বভাবতই ক্লান্ত | বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল | এদিকে বিভূতিভূষণের বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছেই নেই | বললেন : “চল, এতদূর যখন আসা গিয়েছে, পাহাড়টায় কিছুদূর ওঠা যাক |” কী আর করবেন রমাদেবী | অগত্যা উঠছেন | সূর্য তখন মাথার উপর | গনগনে আঁচ | জলতেষ্টা পেলো | স্বামীকে জানালেন | বিভূতিভূষণ একটি বুনো আমলকি কুড়িয়ে দিয়ে বললেন, “খাও, দেখ জলতেষ্টা কমে যাবে |” রমাদেবী খেতে রাজী না হওয়ায় বিভূতিভূষণ বললেন, “সে আবার কী কথা | সেকালে মুনি-ঋষিরা তো এই খেয়ে জীবন ধারণ করতেন | তুমি পারবে না ?”

রমাদেবী বুঝেছিলেন তাঁর স্বামী আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো নয় | তিনি এক অন্য মানুষ |

রমাদেবীর ভালোবাসায় বিভূতিভূষণ এতটাই বদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরেও বোধহয় সে ভালোবাসা কমে যায়নি | পরলোকে থেকেও, অলক্ষ্যে থেকেও সবসময় স্ত্রীর সঙ্গেই থাকতেন | যেদিন রমাদেবী পুত্র তারাদাসকে নিয়ে ঘাটশিলা ছাড়ছেন সেদিনের ঘটনা | প্যাকিং বাক্স বোঝাই হয়ে গেছে | বিশ্রামের জন্য রমাদেবী একটু শুয়েছেন | স্বপ্নে এলেন বিভূতিভূষণ | বলছেন : “কী আজেবাজে জিনিস সঙ্গে নিচ্ছ কল্যাণী? এসব বের করে ফেলে দাও, এসব জীবনে কোনো কাজে লাগবে না | শুধু বই নাও, আমার সমস্ত বইগুলো নাও |” স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর রমাদেবী মৃত স্বামীর নির্দেশ শিরোধার্য করে বাক্স খুলে আবার বইগুলো নিলেন | পরে বোঝা গেছে এ নির্দেশ নিছক স্বপ্ন ছিল না | তার প্রমাণ এক মাস পরেই পাওয়া গেলো | রমাদেবী যখন একমাস পরে ঘাটশিলায় ফিরে গিয়ে ফেলে রেখে আসা আসবাব ও বইগুলি আনতে যায় তখন সেখানে কিছুই ছিল না | সব চুরি হয়ে গিয়েছিল |

প্রেমিক বিভূতিভূষণ আজও জীবিত | তাঁর প্রেম দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম-মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায় ……
————————————————————
সহায়ক গ্রন্থ :
১| পথের কবি, কিশলয় ঠাকুর, আনন্দ পাবলিশার্স
২| পথের পাঁচালী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩| আমার বাবা বিভূতিভূষণ, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,দক্ষিণের বারান্দা
৪| আনন্দবাজার পত্রিকা

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।