• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্ত্তী – ২৫

অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক  

অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের এই পর্বে অপ্রাতিষ্ঠানিক মানুষ গুরুদের কথা বলব | প্রথমে আমার জীবনের একটি ঘটনা দিয়ে লেখা শুরু করব | একদিন স্কুল থেকে একজনের দোকানে গেছি | একজন মানে সে আমার দাদা , বন্ধু , শুভাকাঙ্ক্ষী আরো অনেককিছু | কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছি একটু বহুল প্রচলিত ডায়ালগ , “টেনশেন লেনেগা নেহি , টেনশেন দেনেগা |” সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর , “মানস এটা তো ভারতীয় সংস্কৃতি নয় |” যেন কড়া চাবুক পড়ল | মনে পড়ল গীতার বাণী , “যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ |” সুতরাং ভগবানের ভক্ত যেমন কারুর কাছ থেকে  বেগ নেবেও না তেমনই সত্য কারুকে বেগ দেবেও না | আমি অবাক হলাম ওঁর অলিখিত , অঘোষিত জ্ঞানের প্রাচুর্য থেকে | অলিখিত এই কারণেই বেশিদূর পাণ্ডিত্য ফলানোর সুযোগ পায়নি | আবার অঘোষিত , কারণ লোকে তাঁকে জানে ছাপোষা মানুষ | গীতা প্রয়োগের মাধুর্যতা আমাকে অভিভূত করল |
সম্মানীয় দেবশঙ্কর হালদার তাঁর জীবনের একটি শিক্ষণীয় ঘটনার কথা আমাদের শুনিয়েছেন | ব্রাত্য বসু যখন তাঁকে রুদ্ধ সঙ্গীতে অভিনয়ের জন্য বলেছিলেন , তখন তিনি স্বভাবতই আঁতকে উঠেছিলেন | কারণ পার্ট ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের – গায়কের পার্ট | অথচ তিনি সেভাবে গানই গাইতে পারতেন না | তবুও তিনি হাল ছাড়েননি বরং কণ্ঠ ছাড়ার জন্য শুরু হলো রেওয়াজ | সারাদিন শো করে এসে রাতে ঘরে বসতেন হারমোনিয়াম শিখতে | হারমোনিয়াম শিখলেন | অভিনয়ও করলেন দেবব্রত বিশ্বাসের রোলে | কিন্তু এইসব কিছুই সম্ভব হলো এক অপ্রাতিষ্ঠানিক দিদিমণির শিক্ষায় | নাটকবাবুর জবানিতেই তার একটু পরিচয় দিই : “প্রচণ্ড ক্লান্ত , তার মধ্যে ভাবছি , এটা কি আমাকে করতেই হবে ? খোলা জানলার ওপারে এক ভদ্রমহিলা দেখতাম , সারাদিন সংসারের সব কাজের পরও সেলাই মেশিন চালাচ্ছেন | আমার সামনে হারমোনিয়াম , ওঁর সামনে সেলাই মেশিন | উনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন | আমি যখন ভাবছি আমার সামনে এই যন্ত্রটা আমি বাজাতে পারব না , উনি তখন সেলাই মেশিনটা চালিয়েই যাচ্ছেন | ক্লান্ত কিন্তু করছেন | ওই রাত বারোটা সাড়ে বারোটাতেও | ওঁকে দেখেই আমি যতটুকু পারলাম শিখলাম হারমোনিয়াম , অভিনয়ও করলাম দেবব্রত বিশ্বাসের রোলে |” ১ ওই অপ্রাতিষ্ঠানিক সেলাই দিদিমণির অলক্ষ্যের ওই প্রেরণাটুকু কি নাটকবাবুর যশ নামক মুকুটের গৌরব বৃদ্ধি করেনি ?
বোধিসত্ব মৈত্রেয়ের স্মৃতিচারণায় এইরকম এক অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের কথা উঠে এসেছে |  বোধিসত্ব মৈত্রেয়ের কিঞ্চিৎ পরিচয়ের দরকার আছে | প্রকৃত নাম রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য | জুলজিতে স্নাতকোত্তর | দৌলতপুর কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু | পরে পরে রিপন কলেজ , বহরমপুর কলেজ , কেন্দ্রীয় সরকারের ডিপ. সি. ফিশিং বিভাগের অধিকর্তা পদে চাকরি করেছেন | অন্যদিকে আবার গল্প , উপন্যাসের লেখকও তিনি | তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন সেই কোন্  ছোট্টকালে ডাক্তারবাবুর হাতে চড় খাওয়াটা হয়ে উঠল সারাজীবনের অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ শিক্ষা | লেখাটিতে এক অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের কথাই উঠে এসেছে |
স্কুল খুলেই বন্ধ | উপলক্ষ্য কী ? মতিলাল নেহেরু মারা গেছেন | বন্ধের একটা মজা শিশুমনে তখনও ছিল , এখনও আছে , ভবিষ্যতেও থাকবে | এই মজাটা বোধহয় সনাতন -শ্বাশত | ছেলের দল হই হই করতে করতে বাড়ি ফিরছে | পথে মোড়ের মাথায় পাড়ার এক কাকুর ডিসপেনসারি | নেশা হলো নিজের গাটের পয়সা খরচ করে গরিব মানুষগুলোর চিকিৎসা | ডিসপেনসারির সামনে আসতেই ডাক্তারবাবুর জিজ্ঞাসা , “কি-রে এতো সকাল সকাল ইস্কুল ফেরত ?” লেখকও শিশুসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিল , “মতিলাল নেহেরু অক্কা |” বলেই জিভ বের করে , চোখ উল্টে মরার অভিনয়টা দেখিয়ে দিল | ডাক্তারবাবু গম্ভীর স্বরে ডাক পাড়লেন , “এই শোন্ |” কাছে যেতেই ঠাস করে এক চড় | “মতিলাল নেহেরু -আমাদের একজন দেশবরেণ্য নেতা | শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি | তিনি মারা গেছেন | তাঁর সম্বন্ধে ওই ভাবে কথা |” আর কখনো ও’ভাবে কথা বলতে বারণ করে দিলেন | লেখকের সশ্রদ্ধ স্বীকারোক্তি : ” এ-ও এক শিক্ষা | সারা জীবনের শিক্ষা |”  ২
অধ্যাপক পবিত্র সরকার মহাশয় ‘যাঁরা আমার শিক্ষক’ প্রবন্ধে যে সব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের কথা শুনিয়েছেন তাঁদেরই দু’একজনের শিক্ষার কথা শিখব |
অধ্যাপক সরকার তখন খড়গপুরে অতুলমণি স্কুলে পড়ছেন | যাওয়া আসার পথে মালঞ্চ রোড়ের ধারে বটগাছের নীচে এক মুচি বসত | তিনি বোধহয় একটু ধার্মিক গোছের লোক ছিল | অবসর পেলেই তুলসীদাস রামচরিত মানস সুর করে পড়তেন |
লেখক পায়ে চটি গলিয়ে ফটাফট করতে করতে দু’কিলোমিটার দূরে স্কুলে যেত | চটির উপর অত্যাচার অনেক হতো | পাথরের টুকরো নিয়ে বল খেলা চলত | চটি ঐ ধকল সহ্য করতে পারত না | চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ত , পেরেক উঠত , হিল খুলত | লেখক সরকারও অসুস্থ চটিটাকে নিয়ে মুচির সামনে এসে বলত , “তাড়াতাড়ি মেরামত করে দাও |” তাড়াতাড়ির কারণ – হয় স্কুলের ঘণ্টা পড়ে যাবে , না হয় বাড়ি ফিরে খেলার মাঠে যাবার তাড়া |
অসুস্থ চটিটাকে পেয়ে মুচিও তাঁর চিকিৎসা শুরু করত | প্রথমে স্যাণ্ডেলটিকে আগাপাশতলা উল্টে-পাল্টে দেখত | তারপর শুকনো দাঁতমাজা ব্রাশ দিয়ে তার ধুলো পরিষ্কার করত | তারপর সোল ও ছেঁড়া স্ট্র্যাপ দুটোতেই ভেজা কাপড় দিয়ে জল লাগাত | যাতে ভিজে আরও নরম হয় | তারপর গুটুলি থেকে গুনসুতো দিয়ে দীর্ঘ সময় রজন মালিশ | তাঁর এই দীর্ঘ সময় মালিশে খুদে লেখক বিরক্ত – “জলদি করো |” কিন্তু স্যাণ্ডেল ডাক্তারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই | এদিকে ওপারেশন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি চলছে | শানপাথরে ঘসা চলছে বাটালির মুখ আর মোটা চামড়ার ছুঁচ | তারপর ওপারেশন শুরু – রেজিন ঘষা সুতে পরিয়ে স্যাণ্ডেল ছুঁচ ফুটিয়ে সেলাই | স্যাণ্ডেলের মালিকের খেঁপে ওঠা , “অত কী করছ – চট্ করে  ঘচাঘচ দুটো সেলাই লাগিয়ে ছেড়ে দাও তো !” চিকিৎসক বলত , “এ লেডকা , দেখো সব কামেরই একটা রীতি আছে , একটা ধাঁচা আছে | তুমি তং করলে হোবে ? আমার কামটা আমাকে ঠিক সে করতে হোবে তো ! চাহো তো যাও , খালি পায়ে ইস্কুলে যাও , মাস্টার কুছু বোলবে না |” ৩
তাঁর ( মুচিটার ) কাজের যে principle সেটা নমস্য | কাজটা নিখুঁত করার এই আদর্শটাই worship .
এর পরের ঘটনাটি অধ্যাপক সরকার যখন উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে তোকিয়ো শহরের এশিয়া হাউসে যে দিন তিনেক ছিলেন সেই সময়ের |
লেখক সরকার যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরেই ছিল মুখ ধোয়ার বেসিন | একদিন সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ এপ্রন পরা একটি মেয়ে পরিষ্কার করতে এলো | বেসিনের ওপর সাফাই পাউটার স্প্রে করে ২ মিনিট অপেক্ষা করল | বাথরুম থেকে বালতি করে জল ভরে নিয়ে এলো | সাফাই ট্রলিতে ঝোলানো ঝাড়ন দিয়ে বেসিন প্রচণ্ড গতিতে ঘষতে শুরু করল | মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মেশিন ঝকঝকে তকতকে | অধ্যাপক সরকার ভাবলেন কাজ শেষ |
কিন্তু না | মেয়েটি বেসিনে লেগে রইল আরো পাক্কা পনেরো মিনিট | পরবর্তী অংশ অধ্যাপক পবিত্র সরকারের নিজের ভাষায় , “একবার প্রাণপণে ঘষে , তারপর একটু দূরে পিছিয়ে এসে , বা ঘাড় নিচু করে একোণ ওকোণ দেখে , আবার এসে একটা কোথাও স্প্রে করে , আবার ঘষে | এইরকম করে যখন তার মনোমত হল কাজটা, তখন সে দূরে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে ভালো করে দেখল পুরো দৃশ্যটা | তখন যেন ওই বেসিনটাই তার বিশ্ব-পৃথিবীতে একমাত্র বস্তু , আর সবকিছু তুচ্ছ | শেষ দেখা দেখে খুশি হয়ে সে বেসিনে একটা আলতো ঝাড়নের আঘাত করে ট্রলি ঠেলে বেরিয়ে গেল |” ৪
ঘটনা দুটোই আপাত দৃষ্টিতে হয়তো তুচ্ছ | কিন্তু কৌশলে  কাজ হাসিল করার সহজ ধান্দাটা এখানে অনুপস্থিত | যে পরিমাণ নিষ্ঠা থাকলে কাজ পুজো হয় তারই মন্ত্র রয়েছে ঘটনা দুটোতে |
তথ্যসূত্র : ১| রবিবাসরীয় আনন্দবাজার ১৩ নভেম্বর ২০১৬ |   ২| আমার শিক্ষক , সম্পাদনা – বন্দনা দে , দে’জ পাবলিশিং , পৃঃ ১৫৯ , জানুয়ারি ২০১০ |  ৩| ঐ , পৃঃ ১৪২-১৪৩ |  ৪| ঐ , পৃঃ ১৪৩

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।