• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৫)

পর্ব – ১৫

১১২
শ্যামলী বলে “ জানেন , ছোটবেলায় পড়েছি “ হাঁটিতে শেখে না কেহ না খেয়ে আছাড় “ । ওর ভেতরের মানে টা কি জানেন , মার খেলে পালটা মার দেবার শক্তি তৈরি হবে। আজ যদি মারের ভয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকেন , তা হলে সমস্যার সমাধান হবে না।“
নেতা বললেন “ আমাদের পার্টি সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করে” ।
শ্যামলী বললো “ আমাদের কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নন্দলাল কে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন। সে নন্দ কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠবে না। দেশের জন্যে না কি ওর জীবনটা অক্ষুণ্ণ রাখতেই হবে, ভাই কলেরায় মরলেও তার হুঁশ ফেরে না। “
নেতা গর্জে ওঠেন “ আমাকে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”
“ বোঝাবো আর কি মশায়, আপনি তো সব বুঝে বসে আছেন। আপনার পার্টি সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করে, আর আপনার শ্রমিক মাফিয়ার পেটানির ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকে । ভাল গল্প ফেঁদেছেন যা হোক। “
নেতাটি জোর দিয়ে বলেন “ দেখবেন বিপ্লব একদিন হবেই ।“
শ্যামলী বলে “ কি হবে না হবে সে তো আপনার মুখ চেয়ে হবে না। বইকে মাথায় ঠেকিয়ে রেখে দিলে বিদ্যে হয় না, বইটা রোজ পড়তে হয়, পড়াটা বুঝতে হয় অভ্যাস করতে হয় । তবে যদি কাজে লাগে। আপনাদের যা থিওরি , তাতে বিপ্লব তো হবেই, কিন্তু তাতে গরিবের সমস্যার কিছু সমাধান হবে না । তবে আপনারা দু চার জন মন্ত্রী সান্ত্রী হতে পারবেন। আপনাদের বিপ্লব ওই রকম।“
নেতা রাগ করে বাইরে বেরিয়ে যান। মুখ টিপে হাসতে থাকে শ্যামলী ।
১১৩
নেতা চলে যাবার পরে মিস্ত্রী দের ডাকলো শ্যামলী । বললো – “আমি আজ তোমাদের মজুরি মিটিয়ে দিতে চাই । যে যেটুকু কাজ করেছ, তার হিসেব দেখে রেখেছি । সেভাবে পয়সা মেটাবো। আর যে গাড়ি সারিয়ে পয়সা কোম্পানির ঘরে ঢোকে নি, সে পয়সা দেবো না।“
শ্রমিকেরা জানতে চাইলো “ছোড়দি, তুমি এখনি মজুরি মিটিয়ে দেবে?”
শান্ত গলায় শ্যামলী বলে “ হ্যাঁ দেবো ।“
নগদ টাকা হাতে এলে সকলেরই ভাল লাগে। তবু দু একজন বললো “ হপ্তা দিচ্ছিলে, সেই তো ভাল । মাঝখানে টাকা পেয়ে গেলে সপ্তাহের শেষে খাব কি?”
“ কেন? টাকা গুছিয়ে রেখে দেবে। ধার দেনা থাকলে মিটিয়ে দেবে, তাহলে মহাজন আবার ধার দিতে আপত্তি করবে না।“
শ্রমিকেরা মানতে চায় না । বলে ” ছোড়দি, গরিবের হাতে টাকা থাকে? নিত্য দিন তার অভাব অনটন লেগেই আছে। টাকা হাতে পেলেই কোথায় উড়ে যায় জানো ?”
শ্যামলীর মন বলে – জানি । মজুরের মাইনে বাড়ানোর আন্দোলনটা শেষ কথা নয় । মাইনে বাড়ালে তাদের যে সুবিধেটা হয় বলে লোকে ভাবে, কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় সেটা হয়ে ওঠে না। শ্যামলী মুখে বলে – “ তোমার কাজের পয়সা তোমায় ধরিয়ে দেব, তার পর তোমার কি সমস্যা সে আমি কি জানি? তোমাদের সংগঠন আছে, তোমরা একজোট হয়ে আমায় আজ কতো কি বলে নিলে, নিজের পয়সা কি করে নিজের ট্যাঁকে রাখবে, সে না হয় তোমাদের নেতাই বলে দেবে!”
আবার শ্রমিকেরা বলে “ তোমার দেওয়া হপ্তার জোরে সারা সপ্তাহ পেট চালাই। মাঝখানে টাকা দিলে সে টাকা কোথায় উড়ে যাবে ।“
মজুরদের দিকে চেয়ে শ্যামলী বলে “শোনো তোমরা, যদি মনে করে থাকো কারখানা চালাবার দায় একা ম্যানেজারের, তাহলে কে গলা চড়িয়ে শাসিয়ে গাড়ি বিনে পয়সায় সারিয়ে নিয়ে গেল, সেটা না হয় তুমি দেখো না। মালিক দরকার বুঝলে কারখানার গেটে পাহারাওলা বসাবে। বন্দুকবাজ দারোয়ান রাখবে। কিন্তু শোনো, আমাদের দেশের হাজার হাজার ছোট কারখানার পক্ষে পাহারাওলা দারোয়ান পোষা সম্ভব নয়। তাই যদি মাল চুরি হওয়া ঠেকানো না যায়, তাহলে আমায় ব্যবস্থা নিতেই হবে। আমি কাল একটা হেস্ত নেস্ত করবো। তাতে আমার যা খুশি হতে পারে। তাই তোমাদের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছি ।
মজুরেরা শ্যামলী কে জিজ্ঞাসা করে “ ছোড়দি, কি করবে তুমি কাল?”
শ্যামলী বললো “সেটা আমি তোমাদের বলবো কেন? গুণ্ডা মাফিয়া চোখ রাঙিয়ে গাড়ি সারিয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যায়, আর তোমরা এতগুলো সা জোয়ান পুরুষ মানুষ একজোটে তাসদের ঠেকাতে পারো না, কাল আমি কি করবো কেন বলবো তোমাদের ?”
মজুরেরা বললো “বলছি তো ওরা হেড মিস্ত্রীকে মেরেছিল বলে আমরা ভয় পাই।“
শ্যামলী জানতে চায় “তাহলে হেড মিস্ত্রীকে যারা পিটিয়েছিল, এবারও তারাই চোখ রাঙিয়ে কাজ হাসিল করেছে?”
শ্রমিকেরা মাথা নিচু করে থাকে ।
শ্যামলী গর্জে ওঠে – লজ্জা করে না তোমাদের ? নিজেদের জাতভাই কে বিনা দোষে পেটানি খেতে দেখে মুখে কুলুপ দিয়ে থাকো ? সবাই মিলে জোট বেঁধে ধাওয়া দিতে পার না? আমি বার বার লস খাব না? কাল আমি হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়বো । ওই জন্যে পয়সা মিটিয়ে দিলাম ।“
কয়েকটা কিশোর শ্রমিক বলে – “ছোড়দি আমরা তোমার সঙ্গে থাকবো ।“
বিরক্ত শ্যামলী বলে “না, তোদের কাউকে আমার চাই না, যা। আমি যা জানি আমি একাই করে দেখাবো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।