কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ৬)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ

ব্রহ্মচারী বিনোদের আহার ছিল নুন এবং ভাত। তিনি অনুরাগী ছেলেদেরও আহার সংযমের উপদেশ দিতেন।  বলতেন :“অক্ষুধায় খেলে শরীর নষ্ট হয়। নিয়মিত ও পরিমিত আহার শরীরকে রক্ষা করে। আর অনিয়মিত ও অপরিমিত আহার শরীরকে ধ্বংস করে।”পরবর্তীকালে শিষ্যগণকে বলতেন : “না খেয়ে কয়জন লোক মরে? খেয়েই মরে বেশী। যত রোগ ব্যাধি দেখিস -সবই আহারে অসংযমের ফল, -যা’তা খেয়ে।”

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রধান শিক্ষকরূপে বীরেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য বাজিতপুরে এলেন। তখন ব্রহ্মচারী বিনোদের বয়স ১৬-১৭ বৎসর। বিনোদ তখনই সম্পূর্ণ নিদ্রাজয়ী। তিনি তাঁর অন্তরঙ্গজনকে সাবধান করে দিয়ে বলতেন : “পাঁচ ঘন্টার বেশি নিদ্রা যাবে না। দিনে ঘুমাবে না। অতিরিক্ত আহার ও অতিরিক্ত নিদ্রা বীর্য্য নষ্ট করে দেয়।”

বাক্ সংযমের প্রতি ব্রহ্মচারীর বিশেষ লক্ষ ছিল। তিনি ব্রহ্মচারী থাকা অবস্থায় নিজে অত্যন্ত প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতেন না। এবং যাকে বলতেন তিনি ভিন্ন অন্য কেউ শুনতে পেতেন না।  বাক্য এবং বীর্যকে কৃপণের মতো পরম যত্নে রক্ষা করতে উপদেশ দিতেন। বলতেন : “বাক্ সংযম  না থাকিলে সংকল্পশক্তি নষ্ট হইয়া যায়।”আরো বলতেন : “ভাবের গাম্ভীর্য্য, মনের স্থৈর্য্য, চিত্রের একাগ্রতা, চিন্তার গভীরতা এবং অন্তরের শান্তি বিনষ্ট হয়।”

যে দৃশ্য দেখলে মনে খারাপ চিন্তা আসে  তিনি সেই দৃশ্য দেখবে না। দৃষ্টি সংযম প্রসঙ্গে রামায়ণের লক্ষ্মণের উদাহরণ দিতেন। লক্ষ্মণ একত্রে সীতার সঙ্গে বসবাস করলেও কখনও  সীতার মুখের দিকে তাকান নাই।

 বলতেন-সঙ্কল্প রক্ষাই সত্যের সাধনা। এইজন্য প্রথম প্রথম ছোটো ছোটো সঙ্কল্প করে তা অটুটভাবে রক্ষা করবে। আজ এইটুকু পরিমাণ খাদ্য খাব, এতটুকু সময় ঘুমাব, এত পরিমাণ জপ না করে খাবার খাব না-এইরূপ ছোটো ছোটো সঙ্কল্প গ্রহণ করে তা পালন করার মধ্যে দিয়েই শরীর ও মনের ধৈর্য স্থৈর্য ও সহিষ্ণুতা বাড়ে। ইচ্ছাশক্তির  বিকাশ,পরিপুষ্টি ও দৃঢ়তা ঘটে।

 অন্তরঙ্গদের বলতেন,”প্রতিদিন ১০ জন মৃত ব্যক্তির কথা চিন্তা করবে।এই মৃত্যুচিন্তা বা বৈরাগ্যসাধনার দ্বারাই- বুদ্ধের বুদ্ধত্ব, শঙ্করের শঙ্করত্ব, চৈতন্যের চৈতন্যত্ব।” ব্রহ্মচর্য পালনকারী যুবকগণের ব্রহ্মচর্য সাধনের বিস্তারিত আলোচনা ‘ব্রহ্মচর্য্যম পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে। আচার্যদেব মনে করতেন ব্রহ্মচর্য পালনকারী যুবকগণকই যথার্থ দেশ গঠনের উপযোগী।

।।সঙ্ঘের সেবা, কর্মবিস্তার ও মঠ-আশ্রম প্রতিষ্ঠা।।

ভগবতী ইচ্ছায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মাঘী পূর্ণিমার পুণ্য দিনে বাজিতপুরধামে সঙ্ঘের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল।এবার আচার্যদেব চাইলেন কর্মচক্রের করুণাধারা সেবার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করুক। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ১৩২৬ সালে এক ভয়াবহ দুর্যোগ সংগঠিত হল সমগ্র পূর্ববঙ্গ জুড়ে। মানুষের জীবন একবারে দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়াল ধ্বংসের করাল গ্রাসে। তখন তিনি ব্রহ্মচারী বিনোদ। ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেবক দল নিয়ে সেবাকার্যে। মাদারীপুরের সেই সময় খ্যাতিমান জননেতা  সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস সহ আরও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের চেষ্টায় গঠিত হল রিলিফ কমিটি। কলকাতায় ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গঠিত হল ‘East Bengal Cyclone Relief Committee.’ যোগাযোগ হল ব্রহ্মচারী বিনোদের সঙ্গে। তারা অংশগ্রহণ করলেন ব্রহ্মচারীর সেবাকার্যে। পূর্ববঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল ব্রহ্মচারী বিনোদের সেবাকার্যের প্রশংসা। সেবাকার্যের শেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের উদ্যোগে ব্রহ্মচারী বিনোদের অনুপ্রেরণায় মাদারীপুরে গঠিত হল ‘মাদারীপুর সেবাশ্রম।’ আচার্যদেব প্রেরিত ত্যাগী সেবক স্থানীয় যুবকগনের সহায়তায় মুষ্টিভিক্ষা ও চাঁদার উপর নির্ভর করে শুরু করলেন দরিদ্র নারায়ণের সেবা, দুঃস্থের সেবা, মৃতদেহের সৎকার প্রভৃতি কাজ।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বাজিতপুর সেবাশ্রমের কার্য পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আচার্যদেবের দুই অন্তরঙ্গ শিষ্য কুমুদ ও মধুসূদন খুলনা শহরে এলেন। তাঁদের মধুর ব্যবহার ও নিঃস্বার্থ সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে নগেন্দ্রনাথ সেন জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ (এরা পেশায় দুজনে উকিল) স্থানীয় আরো কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে দুই ব্রহ্মচারীকে সেবাশ্রম স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তারপর সকলে সদিচ্ছায় খুলনা সেবাশ্রম স্থাপিত হল। পরে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে খুলনা শহরের অন্য পাড়ে ভৈরব নদের তীরে এক খন্ড জমি ক্রয় করে স্থায়ী খুলনা সেবাশ্রম গড়ে তোলা হল।

 ১৯২১ খ্রিস্টাব্দেই খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমায় আবার নেমে এল বিপর্যয়ের কালো মেঘ। শুরু হল ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। সচল ভগবানের প্রাণ কেঁদে উঠল। আচার্যদেব তাঁর প্রিয় সন্তানদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেবাকার্যে। স্কুল কলেজ থেকে ৫০০ কর্মী সেবাকাজে অংশগ্রহণ করলেন। কিন্তু অর্থের তীব্র সংকট। সেই দুর্দিনে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এসে দাঁড়ালেন আচার্যদেবের পিছনে। দুর্ভিক্ষজনিত সেবা কাজের শেষে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হল আশাশুনি সেবাশ্রম। সঙ্ঘের সেবাকাজ আরও বৃদ্ধি পেল। বুধহাটা, তেতুলিয়া, প্রতাপনগরে সঙ্ঘের শাখা আশ্রম খুলে গ্রামের মানুষ থেকে স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে শুরু হল কুটির শিল্পের কাজ। তাছাড়া অবৈতনিক বিদ্যালয়র দাতব্য চিকিৎসালয়ও খোলা হল। সেইসঙ্গে স্থাপিত হল ধর্মসভা।

সারাদেশে সঙ্ঘের কর্মবিস্তার করতে হলে কলকাতা শহরকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে। তাই আচার্যদেব ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় পদার্পণ করলেন। ভাদ্র মাসে ১১৮ নং শোভাবাজার স্ট্রীটে ১৮ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে দুটি কোঠাঘর ভাড়া নিয়ে কলকাতা আশ্রম স্থাপিত হল। ১৯২৪ শে আশ্রম উঠে এল ২৭ নং বহুবাজার স্ট্রীটে। ১৯২৬ এ ১৭২ নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে, ১৯২৭এ ২৪/৩ নাম মির্জাপুর স্ট্রীটে, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বালিগঞ্জের ডিহি শ্রীরামপুর লেনে শ্রীযুত অবনী বসু ও শ্রী ধরণীধর বসুদের গৃহে অস্থায়ী বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। কারণ বালিগঞ্জের ২১১ নং রাসবিহারী এভিনিউতে সঙ্ঘের নতুন গৃহ নির্মিত হচ্ছিল‌।  ঐ বছরেরই আগস্ট মাসে  গুরু পূর্ণিমার শুভদিনে বালিগঞ্জে নিজস্ব জমিতে নতুন গৃহে আনুষ্ঠানিকভাবে আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হল।(ক্রমশ)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *