সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ১০
by
·
Published
· Updated
মর্তকায়ার অন্তরালে
||১০||
একবার এক ভদ্রলোক ধর্ম সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের কাছে জানতে চাইলেন : ” ধর্ম নিয়ে বাঙলাদেশে বড় হুলস্থূল পড়েছে | যার যা ইচ্ছা , বলে যাচ্ছে | এ বিষয়ে কিছুই ঠিকানা নেই | আপনি ছাড়া এ বিষয়ে মীমাংসা হবার সম্ভাবনা নেই |
বিদ্যাসাগর বললেন : ” ধর্ম যে কী , মানুষের বর্তমান অবস্থায় তা জানার উপায় নেই ; এবং জানারও কোনো দরকার নেই | ”
বিদ্যাসাগর আরো বললেন : ” পৃথিবীর আরম্ভ হইতে এ’রূপ তর্ক চলিতেছে ও যাবৎ পৃথিবী থাকিবে তাবৎ এই তর্ক থাকিবেক , বোধ হয় যে কস্মিনকালেও ইহার মীমাংসা হইবে না | তাহার দৃষ্টান্ত দেখুন মহাভারতে ব্যাসদেব লিখিয়াছেন, বকরূপী ধর্ম্মরাজ এই মর্ম্মে ধর্ম্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলে যুধিষ্ঠির উত্তর করিলেন –
বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্নাঃ নাসৌ মুনির্যস্য
মতং ন ভিন্নং
ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং মহাজনো
যেন গতঃ স পন্থ || ” ১৪
অর্থাৎ ধর্ম বা ঈশ্বর নিয়ে তর্কের পিচ্ছিল পথ তিনি সযতনে এড়িয়ে গেছেন |
বিদ্যাসাগর নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ছিলেন আস্থাশীল , কিন্তু ধর্মপথে কাউকে চলতে অনুরোধ অথবা উপদেশ দানে তিনি ছিলেন বিরোধী | তাঁর অভিমত , ” এ দুনিয়ার একজন মালিক আছেন তা বেশ বুঝি | নিজে যেমন বুঝি , তেমনি চলি | কেউ পীড়াপীড়ি করলে বলব , ‘ এর বেশি বুঝতে পারিনি | ‘ কিন্তু এ পথে না গিয়ে ও পথে গেলেই স্বর্গে যেতে পারব , তাঁর প্রিয় হব , এসব বুঝিও না , কাউকে বোঝানোরও চেষ্টা করি না | ” ১৫
বিরুদ্ধ পক্ষ থেকে যুক্তি উঠতে পারে , ‘ এ দুনিয়ার একজন মালিক আছেন ‘ এ জাতীয় কথা বিদ্যাসাগরের ঈশ্বর সম্পর্কে সদর্থক ধারণা নিঃসন্দেহে মেনে নেওয়া যায় না |
স্যার জন লরেন্স নামে একখানা স্টিমার ডুবে গেলো | তার ফলে জলে পড়ে মারা গেলো সাত-আটশো মানুষ | খবর শুনে খুব দুঃখ পেলেন বিদ্যাসাগর | বললেন : ” দুনিয়ার মালিক কি আমাদের চেয়ে নিষ্ঠুর ? আমি যা পারি না , কেমন করে পরম করুণাময় হয়ে তিনি তা পারলেন , কেমন করে তিনি ডুবিয়ে মারতে পারলেন সাত আটশো মানুষ ? এই কি দুনিয়ার মালিকের কাজ ? এ সব দেখলে এই দুনিয়ার কেউ মালিক আছেন বলে সহসা মনে হয় না | ” ১৬
বিদ্যাসাগর আবার অন্যত্র বলেছেন : ” ঈশ্বরকে ডাকবার আর কী দরকার ! জেঙ্গিস খাঁ যখন লুটপাট আরম্ভ করলে তখন অনেক লোককে বন্দী করলে ; ক্রমে প্রায় একলক্ষ বন্দী জমে গেল | তখন সেনাপতিরা এসে বললে , মহাশয় , এদের খাওয়াবে কে ? সঙ্গে এদের রাখলে আমাদের বিপদ | কি করা যায় ? ছেড়ে দিলেও বিপদ | তখন জেঙ্গিস খাঁ বললেন , তাহলে কি করা যায় ; ওদের সব বধ কর | তাই কচাকচ করে কাটবার হুকুম হয়ে গেল | এই হত্যাকাণ্ড তো ঈশ্বর দেখলেন ? কই একটু নিবারণ তো করলেন না | তা তিনি থাকে থাকুন , আমার দরকার বোধ হচ্ছে না | আমার তো কোনো উপকার হল না | “১৭
” দুষ্টু লোকে একজন বিধবার সর্বস্ব চুরি করে নিয়েছে | অত্যাচার করছে | বন্ধুদের কাছে সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে বিদ্যাসাগর বললেন – এই জগতের মালিককে যদি পাই , তাহলে একবার দেখি | এ জগতের মালিক থাকলে কি এত অত্যাচার সহ্য করে ? ” ১৮
নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে এ অভিমানের কথা | স্বামীজিও একসময় প্রশ্ন তুলেছিলেন , ” শিবের রাজ্যে এত অশিব কোথা হইতে আসিল | ” ১৯ অথবা ” যে ভগবান এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারে না , তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখবেন – এ আমি বিশ্বাস করি না | ” ২০ – এটা ঈশ্বরের প্রতি সন্দিহান বা সংশয় প্রকাশ নয় | তাঁর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাও নয় | প্রেমিক হৃদয়ের একটি সুন্দর অভিব্যক্তি এটি | হৃদয়ে কতখানি প্রেম , দরদ থাকলে এইরূপ অভিমান প্রকাশ সম্ভব |
বিরুদ্ধ পক্ষ আবার প্রশ্ন তুলবেন – বিদ্যাসাগর যদি জগতের একজন মালিক আছেন জানতেন , তাহলে নিজের দলিলে নানা কাজকর্মে অর্থ বরাদ্দ করেননি কেন ? দেবসেবা বা দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা কল্পে এক কানাকড়িও ব্যয় করেননি কেনো ? এর উত্তরে বলতে হয় – তিনি ভগবানে বিশ্বাস করলেও দেশাচারে- লোকাচারে খুব একটা আস্থাশীল ছিলেন না | তাঁর কাছে মানব সেবাই মাধব সেবা | মানব সেবাই তাঁর কাছে মুখ্য আর সব কিছুই গৌণ | আবার এও বলা যেতে পারে এটি তাঁর মায়েরই শিক্ষে |
একবার বিদ্যাসাগর মাকে জিজ্ঞাসা করলেন – বছরে একদিন ঘটা করে পুজো করে অযথা ছ- সাতশো টাকা খরচ করা ভালো ? না , ওই টাকায় গ্রামের গরীব -দুঃখীদের মাসে মাসে কিছু কিছু সাহায্য করা ভালো ?
মা বললেন – গ্রামের গরীব-দুঃখীরা প্রত্যেক দিন খেতে পেলে পুজো করার দরকার নেই | ২১
বিদ্যাসাগর যেমন হিন্দুধর্মের লোকাচারকে খুব একটা প্রাধান্য দেননি , ঠিক তেমনই ইয়ংবেঙ্গলের মতো হিন্দুধর্মকে তীব্র আক্রমণের পথেও যাননি | আবার তিনি যে লোকাচার বা দেশাচার কিছুই মানেননি একথা জোর দিয়ে বলাও তাঁর প্রতি সুবিচার করা হবে না | কারণ তিনি সন্ধ্যা-বন্দনা না করলেও উপবীত ত্যাগ করেননি | হিন্দুয়ানি মতে পারলৌকিক শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়ার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেননি | অর্থাৎ তিনি লোকাচার মানলেও সেই লোকাচার যখন মানবধর্মকে অতিক্রম করার চেষ্টা করত সেখানেই তিনি ছিলেন খড়্গহস্ত |
রামতনু লাহিড়ী একবার ব্যস্ত হয়ে ব্রাহ্মণ পাচকের খোঁজ করছিলেন | বিদ্যাসাগর তাঁকে বললেন : ” তুমি তো জাত মান না , তবে ব্রাহ্মণ পাচকের কি দরকার ? ” রামতনু জানালেন , না হলে গৃহিণীর চলবে না | শুনে বিদ্যাসাগর বলতে ছাড়লেন না , ” বাপের কথায় পৈতে গাছাটা রাখতে পারলে না ; এখন পরিবারের কথায় বামুন খুঁজতে বেরিয়েছ ?
আর একবার এক খ্রিস্টান পাদরী শিবনাথকে আক্রমণ করলে বিদ্যাসাগরের হাতে তাকে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল |
বিদ্যাসাগর একবার পিতৃদর্শনে কাশীতে গিয়ে সাধারণ ভক্তের মতো কৃত্রিম ভক্তির ভাব দেখিয়ে পুণ্য অর্জনের জন্য ব্যস্ত হননি | কাশীর লোভী ব্রাহ্মণদের স্বভাব সম্পর্কে অবগত হয়ে তিনি ব্রাহ্মণদের প্রতি কোনোরূপ বাড়তি আগ্রহ প্রকাশ করেননি | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ বিদ্যাসাগর চরিত ‘ এ ঘটনার উল্লেখ আছে | – ” এখানে আছেন বলিয়া , আপনাদিগকে যদি আমি ভক্তি বা শ্রদ্ধা করিয়া বিশ্বশ্বর বলিয়া মান্য করি , তাহা হইলে আমার মত নরাধম আর নাই | ” উত্তরে কাশীর ব্রাহ্মণেরা বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে ক্রোধান্বিত হয়ে বলেন : ” তবে আপনি কী মানেন | ” বিদ্যাসাগরের উত্তর ছিল : ” আমার বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা , উপস্থিত এই পিতৃদেব ও জননীদেবী বিরাজমান | ” ২২
এই ঘটনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ণ যথাযথ : ” যে বিদ্যাসাগর হীনতম শ্রেণীর লোকেরও দুঃখমোচনে অর্থব্যয় করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না , তিনি কৃত্রিম কপট ভক্তি দেখাইয়া কাশীর ব্রাহ্মণের প্রার্থনা পূর্ণ করিতে পারিলেন না | ইহাই বলিষ্ঠ সরলতা , ইহাই যথার্থ পৌরুষ | ” ২৩