তাঁর বকুলফুল সই রাবেয়ার কথা বলতে বলতে বারবার আমার দিদা কনকলতা মুখার্জীর গাল বেয়ে নেমে আসত মুক্তো দানা।
একদিন সকালে উঠে শুনেছিলেন দেশটা ভাগ হয়ে গেছে। পর হয়ে গেছে তাঁর নিজেরই দেশটা। বোস পুকুর পাড়াটা নাকি আর তাদের নেই, জোড়া অশ্বত্থতলা নেই, শিমুলতলির মাঠটা নেই– যেখানের রাবেয়া, ফতেমা, পুতুল, পরীদের সাথে খেলাধূলো করতেন তিনি । সেটাও বেমালুম পর? এ কেমন কথা রে বাবা! শীতলা মায়ের থানটা তাদের নেই, কুলতলার মাজারটাও নেই— যার বাইরে রাবেয়ার জন্য তিনি অপেক্ষা করতেন! তাঁর প্রাণের সখী রাবেয়া। সেও কি পর? কী আশ্চর্য! তা আবার হয় নাকি? আজ এই আকাশ-বাতাস-নদনদী সবই তাদের পর! নিষ্ফল আক্রোশে কনকলতার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ত।
চোখ মুছিয়ে দিয়ে সই রাবেয়া বলত, “চিন্তা করিস না রে, কনক। আব্বু কইছেন তিনি বাঁইচ্যা থাকতে তগো কেও ভিটা ছাড়া করবার পারব না। কেও তগো উদ্বাস্তু করবার পারব না। আমরা দুই সই কনকলতা মুখার্জী আর রাবেয়া হায়দার খান আজীবন বন্ধু থাকুম এইভাবেই জড়াইয়া জাপটাইয়া।”
চারদিকে তখন দাঙ্গার লেলিহান শিখা জ্বলছে । ঠিক আগের দিন পাড়ার প্রতিমাদির ছিন্নভিন্ন দেহটা পাওয়া গিয়েছিল বোস পুকুরের ধারে। দিনটা ছিল আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথি। সন্ধে বেলায় রাবেয়ার বাবা হায়দার চাচা এসে ফিসফিস করে খুব সাবধানে কনকের বাবাকে বললেন, —-“সুরেশবাবু, আপনাগো এইখানে থাকাটা আর বোধকরি নিরাপদ হইব না। তৈরি হয়া নেন। খুব ভোরে বাইর হইতে হইব। আমরা সপরিবারে আপনাগো ছাইড়া আসুম ইন্ডিয়া বর্ডারে। তাইলে কেও সন্দেহ করবো না।”
সেদিন কনক পরেছিল রাবেয়ার পোষাক আর বোরখা। আর রাবেয়া, কনকের শাড়ি, ব্লাউজ। দুই সখী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল হাপুস নয়নে।
বর্ডার পেরোনোর ঠিক মুহূর্তে রে রে করে তেড়ে এসেছিল রক্তখেকোর দল।
পিছু ফিরে কনকলতা দেখেছিল, তরো- য়ালের কোপে লুটিয়ে পড়ল রাবেয়ার রক্তাক্ত দেহ। আর দেরী না করে শক্ত হাতে চেপে ধরে কনককে নৌকোয় টেনে তুলেছিলেন তার বাবা।
কিন্তু আজীবন তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল। আমরা রাবেয়া দিদার কথা শুনতে শুনতেই বেড়ে উঠেছিলাম।
—– কেমন পাকা গমের মতো রঙ ছিল তাঁর। কেমন চমৎকার গানের গলা ছিল। কেমন করে নকশীকাঁথায় তিনি ফুটিয়ে তুলতেন গাছ, ফুল পাখী, ঝরনা। কেমন ছিল আকাশের মতো উদার মন তাঁর …
মুক্তোদানাগুলো ঝরত টপ্ টপ্।