“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় পূর্বা দাস

দর্শন – অদর্শন

এখনো টিপ টিপ বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। মেঘলা আকাশ সারাদিনই। সন্ধ্যের পর থেকে প্রচুর ঢেলেছে। একটু ধরেছে এখন। বাদুলে হাওয়ার আমেজ চারপাশে। দোতলার দক্ষিণের ঘরে পুরনো আমলের চারপাল্লার জানলার তাকে বসে বহুদিন বাদে একটা বর্ষার রাত উপভোগ করছে রঞ্জিনী। এই বাড়ি,  দক্ষিণের সব তো প্রায় হারাতেই বসেছিল ও চিরজীবনের মত। ঘরের মাঝখানটাতে বিশাল সেকেলে কাঠের পালঙ্কে ঘুমিয়ে পড়েছে দিশানি। রঞ্জিনীর এগারো বছরের মেয়ে। হাওয়াতে মশারিটা ফুলে ফুলে উঠছে। ফ্যান বন্ধ করে দিয়েছে। কামিনী ফুলের গন্ধ মাখা ভেজা হওয়ায় ভালো করে নিঃশ্বাস নিক মেয়েটা ।
তুষার বোধহয় ওদিককার কোন ঘরে এখন গ্লাস সাজিয়ে বসেছে। ভেতরের টানা বারান্দার দিকের জানালাগুলো বন্ধ রেখেছে ও। দরজাটাও। আজ রঞ্জিনীর একার উৎসব। নীচে পেয়ারাতলায় কি একটা আওয়াজ হল। কেউ যেন হেঁটে গেল। কামিনী গাছটা আবার খুব জোরে মাথা দোলালো, যেন খুশিতে। বৃষ্টির গন্ধ, ফুলের গন্ধ ছাপিয়ে একটা ভীষণ ভালো লাগার গন্ধ পায় রঞ্জিনী। এ ঘরে আসলে গন্ধটা ও পাবেই জানে। কিন্তু  অবাক লাগে, যখন ঘরের বাইরেও এই গন্ধটা ওকে সবসময় আগলে আগলে রাখে। মোবাইলে আলো জ্বলে উঠেছে সাথে সুনন্দাদির নাম।
– কি আজ মায়ের ঘরে ফুলশয্যা তো?
– কি যে বলোনা সুনন্দাদি, আমার তো চিরকালই কণ্টকশয্যা। না, না আমি দিশা কে নিয়ে এঘরে।  তোমার দেওর বোধহয় ওদিকে কোথাও বসে মজলিস করছে।
– না,রে ছেলেটা খারাপ না। ওকে এতোটুকু থেকে দেখছি তো। পড়াশোনায় ভালো, নম্র স্বভাব, আসলে ঠিকমতো চাকরি-বাকরি পেল না বলেই… নেট ক্লিয়ার করল, তাও একটা কলেজে ডাক পেল না। সেই থেকে বোধহয় এরকম খিটখিটে।
– আমার কি দোষ বল! আমি তো এ নিয়ে কোনদিন কিছু বলিনি ওকে। আমার কোনো রিগ্রেট নেই আমার দেড় গুণ বয়সের একটা মানুষের সাথে বিয়ে হয়েছে বলে। শুধু যদি একটু ভালো ব্যবহার করত –
সুনন্দাদি তুষারদের প্রতিবেশী। লতাপাতায় কিরকম আত্মীয়তাও আছে। সুনন্দাদির বর উত্তমদা ডাকসাইটে ইঞ্জিনিয়ার। বছরের বেশিটাই বিদেশে থাকেন। বয়সেও অনেকটা বড়। সম্পর্ক ধরে তুষার ওদের দাদা বৌদি বলে। উন্নাসিক বলে পাড়ায় বদনামও আছে ওদের। সুনন্দাদি না থাকলে হয়তো এই বাড়ি, আলমারি, পালঙ্কের কাছে ওর আর কোনদিন ফিরে আসা হত না। রঞ্জিনীর জীবনটাই একটা ক্রমিক দুর্ভাগ্যের রেলগাড়ি। মা চলে গেল ঠিক যখন ওর বয়স দিশানির মতো। বাড়িতে শুধু বাবা, ছোটকাকু আর ও। ছোট কাকু আবার প্যারালাইসিসড। হুইল চেয়ারে চলাফেরা। রান্না আর ঘরদোর পরিষ্কার করতে আসত আভাপিসি। তাছাড়া সারাদিন ওরা তিনজন। রঞ্জিনী সে বয়স থেকেই বেশ গিন্নী। খেতে দেওয়া,  পাত তোলা, গুছিয়ে রাখা – সব পারত। শুধু জানত না,  প্রথম ঋতুমতী হলে মেয়েদের কি করনীয়। স্কুল থেকে ফেরার সময় একদিন শরীরের ভেতর আনচান। তলপেটে ব্যথা। খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে বাড়ি পৌঁছতে চাইছিল। কিন্তু শরীর ভেঙ্গে আসছে। হাঁটুদুটোও।  এমন সময় এক মহিলা কন্ঠ, ” এই মেয়ে, এদিকে এসো তো ”  সম্মোহনী ডাক। ও এগিয়ে গিয়েছিল। “তুমি বাথরুমে যাবে? ”  প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। এভাবে অপরিচিত কোন বাড়িতে একা একা যাওয়া উচিত নয় জেনেও ঢুকে গিয়েছিল ভেতরে। ওর সাদা স্কার্টে তখন বড়সর ছোপ রক্তের।  ভদ্রমহিলা সবকিছু বুঝিয়ে ন্যাপকিন, নতুন প্যান্টি সব দিয়ে ওকে বাথরুমে পাঠালেন। একটা পরিষ্কার ম্যাক্সি দিলেন পরতে। ভীষণ খিদে পেয়েছিল রঞ্জিনীর। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল সদ্য ভাজা লুচি তরকারি নিয়ে উনি দাঁড়িয়ে আছেন। একটা খাটে বসিয়ে একটু একটু করে খাইয়ে দিয়ে ছিলেন। তখনই ও সেই গন্ধটা আবার পেয়েছিল। বললেন,  ” একটু বিশ্রাম করে নাও, আমি পৌছে দেবো তোমাকে বাড়িতে। আপত্তি করেছিল ও।বাবা ভীষণ ভাববেন সেটাও বলেছিল। তবু শুয়ে পড়েছিল ক্লান্তিতে। ঘুমিয়েও পড়েছিল। সন্ধ্যেবেলা ভদ্রমহিলা নিজেই রিক্সা করে ওকে পৌছে দিয়েছিলেন। বাবার চিন্তাক্লান্ত মুখটা সেদিন এক মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠতে দেখেছিল রঞ্জিনী। তারপরে আর কখনো দেখা হয়নি ওঁর সাথে। পরে একবার বন্ধুদের সাথে ওই বাড়িতে গিয়ে শুনেছে ওরকম কেউ নাকি সেখানে থাকেই না।
এখন আর আশ্চর্য হয়না রঞ্জিনী। এরকম তো হবেই, ও জানে। কলেজে ভর্তির সময় সে এক কাণ্ড। ভূগোলে অনার্স করবে বলে ফর্ম জমা দিয়েছিল শুধুমাত্র চন্দননগর কলেজে। বাবা বলেছিল, ” তোর যা মার্কস আছে তাতে ফার্স্ট লিস্ট এর প্রথম দিকেই নাম থাকবে, দেখিস। ” নিজেরও ভরসা ছিল। সত্যিই গত ক’বছরে সত্তর থেকে পঁচাত্তর পার্সেন্ট নম্বর ছিল ভর্তির মাপকাঠি। কিন্তু সে বছরই ভাগ্য বিরূপ। আশি পার্সেন্ট এর  নীচে নামলই না। রঞ্জিনীর চুয়াত্তর।  ভর্তি হতে হবে পাস কোর্সে। কেঁদেকেটে চারদিন ঘর থেকে বেরোলনা ।তারপর একটা ফোন। ভারী গলায়, ”  আমি  মিসেস আর.সেন বলছি। চন্দননগর কলেজের ইকোনমিকসের হেড ডিপ। তুমি ইন্দুমতী গার্লসের ফার্স্ট গার্ল রঞ্জিনী তো? ইকোনমিকসের  একটা সিট খালি আছে, পড়বে? ” রঞ্জিনী দোনামোনা করেছিল। উনি আবার বললেন, ” ঢুকে পড়ো।  পরে ভূগোলে খালি হলে চেঞ্জ করে নিও। যদিও সে সম্ভাবনা কম।”  রঞ্জিনী পরেরদিনই গিয়ে এডমিশনের টাকা পয়সা জমা করেছিল। কিন্তু আর.এস পরে বলেছেন, ওরকম কোন ফোন তিনি করেননি। ওরকম ফোন করতে উনি পারেন না।  প্রটোকলে আটকায়।
সুনন্দাদিও তো প্রায় অচেনা মানুষ। একটা বিশাল বাড়িতে শুধু দুজন। ‘ কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ চূড়ে ‘  কোন অনুষ্ঠানে কখনো দেখা হলে সামান্য ভদ্রতা বিনিময়। দু বাড়ির আসা-যাওয়াতেও কখনো আগ্রহ ছিল না কোন তরফেই। তুষারদের বাড়ির পাশে একটা সরু গলির পরেই ওদের বাড়ি। বিয়ের  দু তিন মাস পর থেকেই তুষার বদলাতে শুরু করেছিল। গালাগালি, চড়-থাপ্পড়, যৌন অত্যাচার সবই যথেচ্ছ। মেয়ে হবার পর শ্বাশুড়িও সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিলেন, ” একমাত্র ছেলে আমার,  এমন বউ হল, বিয়োল একটা মাটির ঢিবি।”  তুষারের ব্যবহার আরো খারাপ হচ্ছিল। মেয়েকে সহ্য করতে পারত না একদম। বছরখানেক বয়স তখন দিশানীর। অফিস থেকে ফিরে সেদিন দেখা পায়নি রঞ্জিনীর। ছোট ছোট কচি দাঁত দেখিয়ে আধো আধো বুলিতে ছড়া বলত মেয়ে।  শুনতে শুনতে জগৎ ভুলে গিয়েছিল ও।  ঘরে ঢুকে ছো মেরে মেয়েকে তুলে নিয়েছিল তুষার।
–  ওঃ! রানীমা এখানে সোহাগ করছেন মেয়েকে নিয়ে।  আমার মা কি তোর…
বুঝতে না পেরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল মেয়ে। কি দেখেছিল সেদিন তুষার!  কি দেখেছিল মেয়ের মধ্যে! ওরকম নীল হয়ে একদম আস্তে আস্তে মেয়েকে খাটে বসিয়ে দিলো কেন? চুপ করে সব দেখল রঞ্জিনী।  এরপর থেকে মেয়ে নিয়ে কোন কথা বলতো না তুষার। ওর মা’কেও বলতে দিত না। রঞ্জিনীর ওপর অত্যাচারও অনেক কমল। মাঝে মাঝে পেটে অ্যালকোহলের পরিমাণ বেশি হলে দুচারবার হাত চালিয়েছে। রঞ্জিনী দাঁতে দাঁত চেপে থাকত। পাছে মেয়ের ঘুম ভেঙে যায়। পাছে ওর গলার আওয়াজে পাশের বাড়ির শান্তিভঙ্গ হয়। সে ভীষণ লজ্জার কথা। বাবাকে,  কাকুকে কোনদিন বলেনি কিছু। কিন্তু বাবা কি বুঝতে পারত না!  ওর চোখের তলায় কালি,  দিনদিন চুপ হয়ে যাওয়া –  বাবাকে আরো তাড়াতাড়ি বুড়ো করে দিল। মারা যাবার আগে এই বাড়ি আর ব্যাংকের অনেকগুলো টাকা সব রঞ্জিনীর নামে ট্রানস্ফার করে তুষার কে ডেকে বুঝিয়ে দিল। না,  তুষারকে সেভাবে অবিশ্বাসের কোন কারণ তখনো ঘটেনি।
মেয়ে বড় হচ্ছে। রঞ্জিনীও ব্যস্ত থাকে ওর পড়াশোনা, গান, ছবি আঁকা নিয়ে। মাত্র আধঘন্টা দূরত্বে নিজের বাড়িতে আর যাওয়া হয় না আজকাল। একদিন তুষারকে ধরল।
– আমাদের বাড়িটা একটু রেনোভেট করলে হয় না?  বাবা নেই, কাকুও চলে গেল। বাড়িটা ঝাড়পোঁছও হয়না।  একটু সারালে আমরাও মাঝেমধ্যে গিয়ে থাকতে পারি।
– বাড়ি! বাড়ি কিসের? ও বাড়ি তো বিক্রি করে দেব। কথাবার্তা হয়ে গেছে। এডভান্সও নিয়ে নিয়েছি আমি।
আকাশ থেকে পড়ে রঞ্জিনী। ওর অনুমতি ছাড়া বাড়ি বিক্রি!  তাও কি সম্ভব?  সেই প্রথম ওর রাগ, দুঃখ দুর্দম হয়ে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গিয়েছিল।
–  কোথায়, কোন বাড়ি বিক্রি?  দেখাও আমাকে সব কাগজপত্র।
একটুখানি থতমত খেলেও ঘাবড়াবার পাত্র নয় তুষার।
–  কি,  কি বললি?  কাগজ দেখাবো?  তোকে?  খেতে পরতে দিচ্ছি এই না কত।  না পোষালে যা – বিদায় হ…বিদায় হ বাড়ি থেকে ।
একটা বেহিসেবি লাথি কষিয়ে ছিল রঞ্জিনীর কোমরে। রোয়াক থেকে ও ছিটকে পড়েছিল উঠোনে। ঠিক তখনই উঠোনের বড় কাঠের দরজা খুলে এসে দাঁড়িয়েছিল সুনন্দাদি।
–  আর একবার যদি দেখেছি তুষার, আমি সোজা থানায় যাব। কি ভেবেছ তুমি, একটা এইটুকু মেয়ের ওপর এত অত্যাচার! আর বাড়ি বিক্রির কথা কি বলছ তুমি?  আমি সব জানি।  কাকে বিক্রি করেছ, কত টাকা নিয়েছ, কিভাবে দলিল তৈরী করেছ, সব। তিনদিনের মধ্যে তুমি অরিজিনাল দলিল রঞ্জিনীকে ফিরিয়ে দেবে।  অ্যাডভান্স যা নিয়েছ,  তার কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার।
– সুনন্দাদি, একটা কথা বলো তো, সেদিন তুমি যে বললে দলিল জাল করার কথা, বাড়ি বিক্রি করার কথা তুমি জানো;  সত্যি,  জানতে?
– দূর বোকা। আমি তো শুধু ভয় দেখানোর জন্যে বলেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি কাজ হবে ভাবিনি। তবে হ্যাঁ, ও না শোধরালে তোকে নিয়ে পুলিশ স্টেশন যেতামই। চোখের সামনে একটা মেয়ে মার খাচ্ছে, দেখতে পারবো না বাপু।
–  অতো ভয় তোমাকেই বা পেলো কেন ও?  দেখেছিলে,  ও আর ওর মা কেমন তাড়া খাওয়া কুকুরের মত যেন লেজ গুটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
– হ্যাঁ রে।আমিও অবাক হয়েছিলাম। ওইটুকু ধমকে যে তুষার একদম কেঁচো হয়ে যাবে –  যাকগে।  ছাড় ও সব কথা।  শোন,  তোদের আম্রপালি গাছটায় তো প্রচুর আম হয়। এবার কিন্তু আমার এক ঝুড়ি আম চাই। আগে আগে মেসোমশাই আসলে নিয়ে আসতেন।  কি স্বাদ আর ঘ্রাণ। তোর কিপটে শ্বাশুড়ি তো এক দুটো মাত্র চাখতে দিত।  এবার বেশি করে দিবি আমায়। আহা!  তোর বাড়ি উদ্ধার করলাম,  এটুকু প্রণামী দিবি না!
হেসে গড়িয়ে পরে দুজনে।
কি শান্তি। কি আনন্দ। আস্তে আস্তে মশারী তুলে মেয়ের পাশে শোয় রঞ্জিনী। দিশানী পাশ ফিরে  মা’র গলা জড়িয়ে ধরে। দিশানীর গায়েও যে অবিকল সেই গন্ধটা। সেই গন্ধটা এখন ওকে জড়িয়ে ধরছে। আদর করছে।
মা যখন শেষবারের মত হসপিটালে ভর্তি হলো, তার আগের রাতে ওকে বুকে নিয়ে শোয়ার সময় বলেছিল, ” আমি যদি মরেও যাই রঞ্জু, জানবি আমি তোর খুব কাছাকাছিই আছি। তোর যখনই মনে হবে আমাকে দরকার, শুধু মনে মনে ‘ মা ‘  বলে একটা ডাক দিস। যেখানেই থাকি, দেখিস… মা তোর কাছেই আছে। ” ঠিক তাই তো করে এসেছে এতকাল রঞ্জিনী।  মায়ের আলমারি, মায়ের চিরুনি,  মায়ের বিছানার চাদর – সব যত্ন করে রেখেছে ও।   জানে, মা আছে, মা থাকেই, সব সময়। এই বর্ষারাতের অলৌকিকতায় নয়, তুষারের হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠায় নয়, তারও বেশি কিছু… ভীষণ বাস্তব…ভীষণ লৌকিক… ওর অস্তিত্বের মধ্যেই মা  বাস করে। সেই যে মা শিখিয়েছিল সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা –
“তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি।।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।