সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ৬

মাস্টারমশাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

|| ৬ ||

হাতে ভাজ করা কবিতার বই | পরনে ধুতি , পাঞ্জাবির ওপরে কালো জহরকোট | চিত্রটা কার হতে পারে ? নিশ্চয় কোনো মাস্টারমশাই ? হ্যাঁ | তিনি আমাদের পরিচিত মাস্টারমশাই ,টেনিদার স্রস্টা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় |
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় একাধারে গল্পকার , ঔপন্যাসিক , কিশোর সাহিত্য রচয়িতা | টেনিদা ছিল আমাদের ছোটোবেলাকার প্রাণের দোসর | কবিতা , নাটক , প্রবন্ধ , গল্প সবতেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সিদ্ধহস্ত |
অন্যদিকে আবার তিনি জনপ্রিয় অধ্যাপক | এখন আমাদের আলোচনার বিষয় অধ্যাপক হিসাবে তিনি কেমন ছিলেন ? কেমন মাস্টারমশাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ?
মাস্টারমশাই হিসাবে তিনি কতখানি সফল প্রথমে তেমন দু’টি ঘটনা একটু দেখে নিই | – ” আমরা অনেক অধ্যাপকের ক্লাসেই পেছনের বেঞ্চে বসে গল্প করেছি | কয়েকটা ক্লাসে কেবল প্রক্সি দেবার জন্যই যেতাম | ক্লাসের সেই দু-তিন জন মহিলা যাদের আমরা কোনোদিন ‘ ইয়েস স্যার ‘ বলা ছাড়া আর কিছু কখনো বলতে শুনিনি , আমরা ওদের মাথার ওপরের ফ্যান বন্ধ করে দিয়েছি , কারণ সুইচ বোর্ডটা আমাদের মাথার পাশে | যখন অন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রবল উৎসাহে নোট নিচ্ছে , তখন আমরা সোফিয়া লোরেন থেকে ওয়াহিদা মাধবী নিয়ে ব্যস্ত | অথচ একমাত্র নারায়ণ বাবুর ক্লাসে আমরা কখনো কথা বলিনি | গোলমাল করা তো দূরের কথা , তখন আমরা সব অতি শান্তশিষ্ট সুবোধ সহবত বিশিষ্ট বিনীত ছাত্রের দল , তখন সত্যেন দত্তের কীটসের অনুবাদ ছাড়া আমরা আর কিছু জানি না , অথচ অন্য সময় বিশেষ কারো ক্লাসে আমরা নানা আলোচনায় ব্যস্ত থেকেছি , কেউ বা ঘুমিয়েছি | বিশ্ববিদ্যালয়ে যতগুলো স্ট্রাইক হয়েছে কোনো স্ট্রাইকের দিন বোধহয় নারায়ণ বাবুর ক্লাস ছিল না , অন্তত আমরা সেরকম মনে করতাম | V.C র কাছে ডেপুটেশনটা যাতে নারায়ণবাবুর ক্লাসের আগে কিম্বা পরে হয় সে চেষ্টা প্রায় সময়ই সাকসেসফুল হয়েছে | ………ক্যারাম খেলতে খেলতে আঠাশের মাথায় ক্যারাম ছেড়ে হনহন করে উঠে গেছি , কারণ সেদিন স্পেশাল ক্লাসে নারায়ণবাবুর ‘ যোগাযোগ ‘ পড়ানোর কথা | “১ উপরের স্মৃতিচারণটি প্রলয়শূর মহাশয়ের | কবি শঙ্খ ঘোষ লিখলেন , ” তিনশো ছেলেমেয়ের দাবীতে একদিন এক স্পেশাল ক্লাস , অনেকেই বসবার জায়গা পর্যন্ত পায়নি , নোট নেবার চেষ্টা চলেছে দেওয়ালে বা এ ওর পিঠে খাতা রেখে | এই দৃশ্যে স্পষ্টতই অভিভূত মাস্টারমশাই – কিন্তু সে ভাবটা কাটিয়ে নেবার জন্য ঈষৎ পরিহাসে বলে উঠলেন , ‘ আগে জানলে তো রিপোর্টারদের একটা খবর দিতাম , ছবি নিয়ে যেত | ‘ ” ২ অথচ সেই তিনিই কিনা বলছেন , ” ‘ খেয়া ‘ তোমাদের পাঠ্য , সেই খেয়ার যোগ্যতম কাণ্ডারী প্রমথনাথ বিশী তোমাদের পারে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন | অতএব ‘ খেয়া’ র কথা আমার কাছে শোনার আর দরকার নেই , ‘ খেয়া’র যোগ্য নাবিক হবার সৌভাগ্য তো আমি অর্জন করিনি | ” ৩
উপরের দুই ধরণের চিত্র থেকে অধ্যাপক হিসাবে তাঁর জনপ্রিয়তা এবং মানসিক স্থিতি লক্ষ করলাম | লক্ষ করলাম অন্য অধ্যাপককে সম্মান জানানোর নির্ভেজাল অঙ্গীকার |
বিবেকানন্দ বলেছেন , ” সম্প্রদায় থাকুক , সাম্প্রদায়িকতা দূর হোক | ” নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই মতেই বিশ্বাসী ছিলেন | সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ঘৃণা করতেন | সাম্প্রদায়িকতা বিরর্জিত জীবন একজন শিক্ষকের মস্ত বড়ো গুণ | পুত্র অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় তাঁর সাম্প্রদায়িকতা বর্জনের কথা প্রকাশ পেয়েছে | ” প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন | সরস্বতী পুজোয় পটলডাঙার বাড়িতে মুসলমানদেরও প্রসাদ খেতে দেখেছি , ঈদ সম্মেলন হয়েছে আমাদের বাড়িতে | সেখানে আবু সয়ীদ আইয়ুব থেকে শুরু করে বহু মুসলমান বুদ্ধিজীবী এসেছিলেন | ” ৪
মাস্টারমশাই হিসেবে কোনো শিক্ষকের যেটা সবচেয়ে বড়ো গুণ হওয়া উচিত তা হলো ছাত্রপ্রীতি | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সেই জায়গাতেও সফল | চিত্তরঞ্জন ঘোষ তাঁর স্মৃতিচারণায় এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন |

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।