সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ৯
by
·
Published
· Updated
মর্তকায়ার অন্তরালে
|| নয় ||
হৃদয়ের প্রসারতাই হলো ধর্মতত্ত্বের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ | স্বামীজি একবার আবুরোডে তুরীয়ানন্দকে বলেছিলেন : ” হরিভাই , আমি এখনও তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না | …..কিন্তু আমার হৃদয় খুব বেড়ে গেছে এবং আমি অপরের ব্যথায় ব্যথা বোধ করতে শিখেছি | বিশ্বাস করো , আমার তীব্র দুঃখবোধ জেগেছে ! ” ৯ সুতরাং হৃদয়ের প্রসারতা ও মানব প্রেমের মধ্যেই ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব নিহিত এটা বিদ্যাসাগর ভালোভাবেই হৃদঙ্গম করতে পেরেছিলেন |
বিদ্যাসাগর সুস্থ মানবতাবাদে বিশ্বাসী | চণ্ডিদাসের মতো বিদ্যাসাগরও বিশ্বাস করতেন , ” সবার উপরে মানুষ সত্য | ” তাই মানুষের ইহলৌকিক স্বাচ্ছন্দ্যবিধানই তাঁর কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল | মানুষের দুর্দশায় তিনি বিচলিত হয়েছেন | দুর্দশা দূর করবার জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছেন | ঋণজালে জড়িয়েছেন, তবু বিফল মনোরথ হননি |
এখন বিদ্যাসাগরের মানব প্রেমের ধারাটি একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব আমরা | শ্রীম কথিত ‘ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত ‘ এর তৃতীয় ভাগের প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে অঙ্কিত হয়েছে একটি চিত্র – ” টেবিলের উপর যে পত্রগুলি চাপা রহিয়াছে তাহাতে কী লেখা রহিয়াছে ? কোনও বিধবা হয়তো লিখিয়াছে – আমার অপোগণ্ড শিশু অনাথ , দেখিবার কেহ নাই , আপনাকে দেখিতে হবে | কেহ লিখিয়াছেন , আপনি খরমাতার চলিয়া গিয়াছিলেন , তাই আমরা মাসোহারা ঠিক সময়ে পাই নাই , বড় কষ্ট হইয়াছে | কোনও গরিব লিখিয়াছেন , আপনার স্কুলে ফ্রি ভর্তি হইয়াছি , কিন্তু আমার বই কিনিবার ক্ষমতা নাই | কেহ লিখিয়াছেন , আমার পরিবারবর্গ খেতে পাচ্ছে না – আমাকে একটি চাকরি করিয়া দিতে হবে | তাঁর স্কুলের কোনও শিক্ষক লিখিয়াছেন – আমার ভগিনী বিধবা হইয়াছে , তাহার সমস্ত ভার আপনাকে লইতে হইয়াছে | এ বেতনে আমার চলে না | হয়তো কেহ বিলাত হইতে লিখিয়াছেন , আমি এখন বিপদগ্রস্থ , আপনি দীনের বন্ধু , কিছু টাকা পাঠাইয়া আসন্ন বিপদ হইতে আমাকে রক্ষা করুন | কেহবা লিখিয়াছেন , অমুক তারিখে সালিশির দিন নির্ধারিত , আপনি সেদিন আসিয়া আমাদের বিবাদ মিটাইয়া দিবেন | “
বিদ্যাসাগর চরিত্রের সর্বপ্রধান গুণ কী ? সর্বজীবে তার অতুলনীয় দয়া | বাছুরের কষ্ট দেখে একসময় দুধ খাওয়া ছেড়েছিলেন | ঘোড়ার কষ্ট দেখে ঘোড়ার গাড়িতে চাপা বন্ধ করেছিলেন একথার উল্লেখ পূর্বেই করেছি | এর সঙ্গে আরো যোগ করতে চাই – ” একদিন দেখলেন একটি মুটে কলেরা রোগে আক্রান্ত হইয়া রাস্তায় পড়িয়া আছে , কাছে ঝাঁকাটা পড়িয়া আছে | দেখিয়া নিজ কোলে করিয়া তাহাকে বাড়িতে আনিলেন ও সেবা করিতে লাগিলেন | ” ১০
বিদ্যাসাগর স্বহস্তে ‘ ওলাউঠা ‘ রোগীর মলমূত্র পরিষ্কার করিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি | তিনি অসহায় বিপন্না পতিতা নারীর অসঙ্কোচে ঔষুধপত্র দিয়ে সেবা করেছেন | উপকৃত ব্যক্তি অনেকসময় উপকার কর্তার নামই জানতে পারতেন না | অনেক সময় লোকের উপকার করার জন্য মিথ্যা অভিনয় করতেন | এ’রূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করি – ” একটা পাড়া-গাঁয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন বিদ্যাসাগর | একটা বাড়ি থেকে একজন মেয়ের কান্না শুনলেন | হয়েছে কী ? জিজ্ঞেস করলেন একজন লোককে | শুনলেন – মেয়েটির স্বামী মারা গেছে | গহনাপত্র বিক্রি করে সর্বস্ব খরচ করে মেয়েটি স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছে | এখন স্বামীর অভাবে তার কি দুর্দশা হবে বুঝতেই পারছেন |
বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন – ওই স্বামীর কী নাম বলতে পারো ?
– রাম |
বিদ্যাসাগর তখনি ‘ রামদাদা , রামদাদা , বাড়ি আছে ‘ বলতে বলতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন |
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল – তিনি আর নেই গো | অ্যাঁ , রামদাদা মারা গেছেন ! তিনি আমাকে যে বড়ই বিপদে ফেলে গেছেন |
শুনে আরো ভয় পেয়ে গেল মেয়েটি ; ইনিও একজন পাওনাদার নাকি ?
বিদ্যাসাগর তাড়াতাড়ি বললেন – অনেক টাকা তিনি আমাকে দিয়ে গেছলেন , বিপদে পড়লে আমার কাছ থেকে চেয়ে নেবেন বলেছিলেন | সেসব টাকা আমি তোমাদের একসঙ্গে দেব না | তোমাদের যখনি যা দরকার হবে আমার কাছ থেকে নেবে | আর মাসে মাসে আমি মাসহারা দেব | ” ১১
১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দের মাঝামাঝি দারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল এদেশে | বিদ্যাসাগর বীরসিংহে একটা অন্নছত্র খুললেন | সেই অন্নছত্রের কাজে সর্বদাই বারোজন পাচক ও কুড়িজন পরিবেশক নিযুক্ত থাকত | কিন্তু দরিদ্র অভুক্ত মানুষের সংখ্যাধিক্য দেখে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন : ” যত টাকা খরচ হোক , কেউ যেন অভুক্ত না থাকে | সকলেই যেন খেতে পায় | ” ১২
আবার পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরি | এবার ঈশ্বর বা ধর্ম সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করা যাক |
মাস্টারমশাই ( শ্রীম ) একদিন বিদ্যাসাগরের কাছে ঈশ্বর সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম | বিদ্যাসাগর উত্তরে জানিয়ে ছিলেন : ” তাঁকে তো জানবার জো নেই | প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত , যাতে জগতের মঙ্গল হয় | ” ১৩ বিদ্যাসাগর বোধহয় এটাই বোঝাতে চাইলেন ঈশ্বর বাক্যমনাতীত | তাই জীবের সেবাই শ্রেষ্ঠ কর্তব্য কর্ম মনুষ্যের |