T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় মানস চক্রবর্ত্তী
by
·
Published
· Updated
আমার রবীন্দ্রনাথ
আমি যেদিন প্রথম “গীতবিতান” কিনলাম , একটু জানিয়ে রাখি গান আমি নিজে গাইতে পারি না ; কিন্তু গানের প্রতি একটা মোহ , একটা নস্টালজিয়া আছে | বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান | রবীন্দ্রনাথের গানকে আমার বাণী বলে মনে হয় , মন্ত্র বলে মনে হয় | লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো রবীন্দ্রনাথের শব্দচয়ন খুব একটা বড়ো ব্যাপার | মনে হয় তিনি নিজেও এ ব্যাপারে খুঁতখুতে ছিলেন | “গীতবিতান” কেনা এই কারণেই শব্দের প্রতি একটা মোহ | এই মোহটা আমাকে বাঁধেনি , সংকুচিত করেনি , বরং সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে | এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে আজও আধুনিক | তাই কবিগুরুর কথাতেই বলতে ইচ্ছে করে , “ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা / প্রভু তোমার পানে , তোমার পানে , তোমার পানে |” যুক্তি দিয়ে বললে বলতে হয় যাঁর চিন্তা , কাজ সমকালকে উর্ত্তীণ করে তিনি আধুনিক | রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে সফলকাম | আমি একবার একটি প্রোগ্রামে শুনেছিলাম – একজন বিধবা নারী রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ করে “গীতাঞ্জলি” কে অবলম্বন করে তাঁর পরবর্তী বাঁচাটা বেঁচে ছিলেন |
রবীন্দ্রনাথের বাণী আমাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তার একটা উদাহরণ দিই – “গীতবিতান” প্রথম পড়ার পর আমি একটা কবিতা লিখলাম -” গীতবিতান জীবনের জন্য” | যাঁদেরকে শোনালাম তাঁদেরও ভালো লাগল | আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “প্রেমে অপ্রেমে” তে প্রকাশিত হলো কবিতাটি | রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদেরকে- আমাকে প্রতি মুহূর্তেই হাত পাততে হয় | রবীন্দ্রনাথের লেখা আমার কবিতার একটি শক্তিশালী উপাদান |
যেহেতু আমার রবীন্দ্রনাথ তাই ব্যক্তিগত কথা কিছু আসবে , তবে তা অবশ্যই রবীন্দ্রকেন্দ্রিক | একদিন পাঠচক্রের বৈকালিক প্রোগ্রামে গেছি | হীরালাল জেঠু শোনালেন কবিগুরুর একটি গান
“জড়ায়ে আছে বাধা , ছাড়ায়ে যেতে চাই-
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে | “
মনে হলো এতো আমারই মনের কথা |
“জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম ,
এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম ,
তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে || “
কী নির্মম সত্য কবিগুরুর কলমে উচ্চারিত | সত্যিই আমরা নিজের ভালো চাইতে পারি না –
“আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই
ভয় যে আসে মনোমাঝে ||”
আবার ভয়জয়ের মন্ত্র কবিগুরুই দিয়েছেন –
“বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা –
বিপদে আমি না যেনো করি ভয় |
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা ,
দুঃখে যেনো করিতে পারি জয় || “
সত্যি কথা বলতে কী এই গানখানি আমার জীবনের সঙ্গে অনেকখানি জড়িত | আমার একবার খুব শরীর খারাপ হয় | ২০১৯ সাল | সম্পূর্ণ ঘরবন্দি অবস্থা | তখন আমি গুরুমহারাজ ও রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেছিলাম | “বিপদে মোরে রক্ষা করো …..” গানটা খুব গাইতাম | সুর তাল ছন্দ মেনে হতো না ঠিকই – নিজের মনে গুনগুনিয়ে গাইতাম | কী আশ্চর্য সেইসময় যাঁরা আমাকে দেখতে এসেছিলেন তাঁরা বলেছিলেন , মুখে রোগভয়ের কোনো ছাপ পড়েনি | কে জানে হয়তো এই গানের প্রভাবটা আমাকে তীব্রভাবে ধরে রেখেছিল |
আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষের জয়গান গেয়েছেন | “ঘরে বাইরে ” উপন্যাসে নিখিলের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ বলছেন , “মানুষ মরণাত্মক দুঃখ পাবে , কিন্তু মানুষ কোনোদিনও মরবে না |” যেখানে মানুষের অপমান হয়েছে সেখানে তিনি চুপ করে থাকতে পারেননি | তিনি লিখছেন ,
“হে মোর দুর্ভাগা দেশ , যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান |
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ ় যারে ,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান ,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান | “
কারণ তাঁর কাছে মানুষ ছিল ভগবান |
“হেথায় দাঁড়ায়ে দুবাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে,
উদার ছন্দে, পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে | “
তিনি মানুষের বন্দনা করেছেন | যাঁর সৃষ্টির মূলে মানুষ | যাঁর সাহিত্যসৃষ্টি মানুষকে ঘিরে আবর্তিত এহেন রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় – আমার রবীন্দ্রনাথ |
আমার রবীন্দ্রনাথ মানুষের অপমানে দেবতার আরাধনাকে অস্বীকার করেছেন | চৈতালী কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন , –
“দেবতা কহিল , ‘মোরে দূর করি দিলে |’
জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়াতরে ,
গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে |”
এই রবীন্দ্রনাথ আমার রবীন্দ্রনাথ | আমি রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথকে বলি, “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে |”