কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ৪)

হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ

রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, আধ্যাত্মিক প্লাবন 

ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ কোন রাজনৈতিক বিপ্লব চাননি, চেয়েছিলেন আধ্যাত্মিক প্লাবন।  সঙ্ঘের ভিত্তি ভূমি শক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে ত্যাগ তপস্যার আগুনে পুড়ে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ১৮ বছর বয়সে তিনি তখন ব্রহ্মচারী, গ্রেপ্তার হলেন ‘ফরিদপুর ষড়যন্ত্র মামলায়।’পরে মাদারীপুরের আইনজীবী মথুরানাথ দাসের প্রচেষ্টায় তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। তখন বাংলার বিপ্লবীরা ভেবেছিলেন ব্রহ্মচারী বিনোদ তাদের লোক, তাদের মতাদর্শের লোক। তাঁরা তাদের দলে বিনোদ সাধুকে ডাকলেন। কিন্তু ব্রহ্মচারী বিনোদের  পথ আলাদা। তাদের অনুরোধ সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, আমি আধ্যাত্বিক জাগরণের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের মুক্তি চাই। এ পথ তোমাদের পথের চেয়ে পৃথক। “ভারতবর্ষ ধর্মভূমি, পুণ্যভূমি। এদেশ ধর্মপ্রাণ; ধর্মই এ জাতির জীবন, প্রকৃত মেরুদণ্ড। সেজন্য আমি চাই সনাতন ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠন। তাই নিজের জীবনটি তিনি উৎসর্গ করলেন জাতি গঠনের কাজে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে প্রয়াগ ধামে কুম্ভমেলায় শ্রীমৎ স্বামী গোবিন্দানন্দ গিরিজীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। ব্রহ্মচারী বিনোদের নাম হল আচার্য শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ। সন্ন্যাস গ্রহণ করে ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসের মাঘী পূর্ণিমার পুণ্য দিনে বাজিতপুর সিদ্ধ পীঠে প্রথম সাতজন আশ্রিত সন্তানকে দিলেন সন্ন্যাস। এরা হলেন-

১। ব্রহ্মচারী কুমুদ ( স্বামী সচিদানন্দজী মহারাজ)

২। ব্রহ্মচারী নারায়ণ (স্বামীবিজ্ঞানানন্দজী  মহারাজ)

৩। ব্রহ্মচারী অমূল্য (স্বামী বেদানন্দজী মহারাজ)

৪। ব্রহ্মচারী মধুসূদন (স্বামী যোগানন্দজী মহারাজ)

৫। ব্রহ্মচারী রাজেন্দ্র (স্বামী অদ্বৈতানন্দজী মহারাজ)

৬। ব্রহ্মচারী নিকুঞ্জ (স্বামী আত্মানন্দজী মহারাজ)

৭। ব্রহ্মচারী যতীন্দ্র (স্বামী নির্গুনানন্দজী মহারাজ)

কয়েক বছরের মধ্য তিনি প্রায় ৬০ জনকে সন্ন্যাস দীক্ষা দিলেন।

ধীরে ধীরে সঙ্ঘের ভূমি তৈরি হচ্ছে। বিবেকানন্দ বলেছেন, ত্যাগ ও সেবা ভারতবর্ষের ধর্ম। এই ত্যাগ এবং সেবাকে আদর্শ করেই সঙ্ঘ এগোচ্ছে। তিনি বুঝলেন ভারতবর্ষের ধর্ম আজ বিপন্ন। তাই তিনি মাঠে-ঘাটে বেদান্তের কথা আওড়িয়ে দেশটার সর্বনাশ করতে চাইলেন না।  তিনি ধর্মটাকে তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তববোধের আলোকে বুঝতে এবং বোঝাতে চাইলেন।  বললেন : “কতকগুলো অবোধ, মূর্খ সাধু দেশটার মাথা একবারে খেয়ে দিয়েছে-কথায় কথায় যাকে তাকে বেদ বেদান্তের উপদেশ শুনানো।বোঝে না এর দ্বারা তারা দেশের কত সর্বনাশ করছে। সাধনার চরম অবস্থায় একমাত্র অনুভূতির বস্তু যা তাই নিয়ে মাঠে-ঘাটে, যেখানে সেখানে ছেলে খেলা। আমি তো বলি- বেদ-বেদান্ত এসব এখন কিছুকাল ধামা চাপা দিয়ে রাখ, ওসব পরে বোঝা যাবে।যাদের আজ সামান্য নীতিবোধ নেই, রিপু ইন্দ্রিয়ের বিন্দুমাত্র সংযম যাদের নেই, তাদের নিকট বেদান্ত চর্চা। এখানে ওসব চালাকী, ভণ্ডামীর প্রশ্রয় হবে না।”১২

তখনও সঙ্ঘের কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। তাই তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসের ২ তারিখে Act XXI of 1860 অনুসারে  রেজেস্ট্রি করান। এবং ২৩ জন প্রবীণ সন্ন্যাসকে নিয়ে একটি ‘ট্রাস্ট’ গঠন করে সঙ্ঘের আদর্শ, উদ্দেশ্য, নিয়মাবলী রচনা করান। সেই সঙ্গে কতিপয় অন্তরঙ্গ গৃহীভক্ত এবং সন্ন্যাসীদের নিয়ে সঙ্ঘের সাধারণ সমিতি (General committee ) গঠিত হয়। সঙ্ঘের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়-সনাতন ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠন। এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে  যেকোনো আর্ত, পীড়িত, দুস্থ, বিপন্ন এবং অন্যান্য সকল মানুষের শারীরিক,মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক -সর্বপ্রকার নিঃস্বার্থ সেবাই হচ্ছে এই সঙ্ঘের প্রধান কাজ।

শুধু এইটুকু বললেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সঠিকভাবে বোঝা যাবে না। তখন রামকৃষ্ণ মিশন  তার ত্যাগ ও সেবার আদর্শ নিয়ে স্বমহিমায় বিরাজ করছে। আদর্শগত দিক দিয়ে মিশনের সঙ্গে সঙ্ঘের কোনো বিরোধ নেই। সাংগঠনিক কাঠামোর দিক দিয়ে সঙ্ঘ ছিল মিশনের চেয়ে অনেকাংশে পৃথক। স্বামী প্রণবানন্দজি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মধ্যে দিয়ে চাইলেন প্রাচীন বৈদিক আদর্শ ও ভাবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক দেশ ও জাতির জীবনাদর্শে।

স্বামী দয়ানন্দের আর্য সমাজ ও ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মিলের চেয়ে অমিল ছিল বেশি। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী পরধর্ম ও পরমতের প্রতি অসহিষ্ণু ছিলেন। তিনি নিজ ধর্ম ও মত ছাড়া অপর মতকে সহ্য করতেই পারতেন না। ঠিক এই কারণেই কেশবচন্দ্র সেনকে তিনি পছন্দ করতেন না। যেহেতু কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টধর্মের প্রতি একটা অনুরাগ ছিল। কিন্তু তিনি নিজে ধর্মের মানুষের কাছেও পৌঁছাতে পারেননি। এখন মহানগরীর আর্যসমাজের বেদিগুলিতে ঝাড় দেওয়ার লোক পাওয়া দুষ্কর। স্বামী দয়ানন্দ খুব দৃঢ়ভাবে পুরাণ ও তন্ত্রের নিন্দা করেছেন। পুরানগুলির সম্বন্ধে অশ্লীল কথা, কটুক্তি করেছেন। আর্য সমাজীরা দয়ানন্দের পথ অনুসরণ করে এখনও পুরাণগুলির নিন্দা করে থাকেন। আর্য সমাজীদের পুরাণ নিন্দার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক সন্দীপ কুমার সিনহার বই থেকে। পত্রটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ‘ইন্ডিয়ান মিরর’এ। পত্র লেখক লিখছেন : “পুরাণ- যাকে দয়ানন্দ সরস্বতী জালিয়াতি বলতেন- হিন্দু সমাজের সর্বনাশ ঘটিয়েছে। দয়ানন্দের গুরু স্বর্গতঃ স্বামী বিরজানন্দ পুরাণ সম্বন্ধে এতই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন যে, তাঁর শিষ্যদের কদাপি পুরাণ পড়তে দিতেন না, এবং কথিত আছে তিনি তাঁর শিষ্যদের দিয়ে প্রতিদিন প্রভাতে শ্রীমদ্ভাগবত’লেখা কাগজের উপর পদাঘাত করাতেন, কারণ তার মতে অন্য সকল কিছু অপেক্ষা পুরাণই বজ্জাতির মূল। ব্যাসদেবের নাম নিয়ে বোপদেব যেভাবে কৃষ্ণচরিত্র চিত্রণ করেছেন, তা কৃষ্ণের দিব্য গীতা শিক্ষাকে মিথ্যা করে দিয়েছে, উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করা সর্বোত্তম দেহধারী প্রতিভাধরেরও অসাধ্য। তাই ওসব বস্তু দয়ানন্দ বাতিল করে দিয়েছিলেন।”১৩ অর্থাৎ হিন্দুধর্মের প্রাচীন রীতিনীতিগুলিকে তিনি অস্বীকার করলেন। (ক্রমশ)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *