• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ৮

মর্তকায়ার অন্তরালে

|| আট ||

বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, না আস্তিক ?

সাধারণ ধারণা অনুযায়ী যে ব্যক্তি ঈশ্বর সম্পর্কে সদর্থক ধারণা পোষণ করেন , মন্দির-মসজিদ-গির্জায় যায় , পুজো-পাঠে আস্থাশীল – তিনিই ধার্মিক পদবাচ্য | কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবন পর্যালোচনা করলে উপরের কোনোটিরই সার্থক প্রতিফলন দেখা যাবে না | এমনকি উপনয়নের পর সন্ধ্যাবন্দনাদির মন্ত্রও ভুলে গিয়েছিলেন এমন প্রমাণও আছে | ঈশ্বরচন্দ্রের কাকা কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্দেহ হলো ঈশ্বর সন্ধ্যা-বন্দনা ভুলে গেছে | কালিদাস একদিন সরাসরি ঈশ্বরকে বললেন : ” আমরা বিষয়ী লোক , তুমি সংস্কৃত পড়েছ , তোমার শুদ্ধ হবে , অতএব একবার সন্ধ্যাটি তুমি আবৃত্তি করো , আমি শুনতে চাই | ” ১ ঈশ্বর কিছুই বলতে পারলেন না | কালিদাস ঠাকুরদাসকে ব্যাপারটা জানালেন | বললেন : ” ঈশ্বর সন্ধ্যা সমস্ত ভুলে গেছে | মিছিমিছি কেবল হাত পা নেড়ে কাজ সারে | ” ২ ঠাকুরদাসও ঈশ্বরকে খুব প্রহার করলেন এবং বললেন : ” সন্ধ্যা শেখা না হলে কিছু খেতে দেব না | ” ৩ পুঁথি দেখে ঈশ্বর আবার মুখস্ত করলেন |
বাবার মারের ভয়ে তখনকার মতো মুখস্ত করলেও উত্তরকালে অর্থাৎ পরিণত বয়সে তিনি কখনো সন্ধ্যা করেননি | ক্ষুদিরাম বসু লিখছেন : ” অনেকদিন এমন কেটেছে যে বিকেল থেকে ঠায় ঘরে বসে গল্পগুজব হ’তে হ’তে রাত হ’য়ে গেছে , সেইখানেই খাবারটাবার এল, সকলের সঙ্গে তিনিও খেলেন , সন্ধ্যা-আহ্নিক করতে ত দেখিনি | ” ৪ ইন্দ্রমিত্রও আমাদিগকে জানিয়েছেন – বিদ্যাসাগর কারো কাছে মন্ত্রদীক্ষা নেননি | ঠাকুমার পীড়াপীড়িতেও নেননি | ৫
বিদ্যাসাগর কোনো দেবমন্দিরে যেতেন না | বিদ্যাসাগরকে পুজো-পাঠ করতে দেখেছেন এমন ব্যক্তিরও সাক্ষাৎ কেউ কোনোদিন পেয়েছেন বলে কোথাও শুনিনি বা পড়িনি | ক্ষিতিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : ” বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রতীক পূজা ও স্বস্ত্যয়ন প্রভৃতি অযৌক্তিক , এই হিসাবে কোনও দিন প্রশয় দেয় নাই | মানুষ সাধারণতঃ মৃত্যুর সন্নিকটে এলে , বিশেষতঃ রোগে তিল তিল করে যন্ত্রণা পেয়ে অন্তিম সময়ের দিকে এগিয়ে চললে কিছু দুর্ব্বল চিত্ত হয় | কিন্তু এই দৃঢ় কঠিন যুক্তিবাদী পুরুষ দুর্ব্বলতাকে শেষ সময়েও প্রশয় দেন নাই | “৬ তিনি আরো জানিয়েছেন – বিদ্যাসাগরের কন্যা একবার কলকাতার বাড়িতে হোম করিয়াছিলেন | বিদ্যাসাগর কিন্তু সে ঘরে প্রবেশ করে নাই | কন্যার বিশেষ অনুরোধেও নয় | শুধু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঈষৎ হেসে বলেছিলেন : ” মা , এইখানেও ধোঁয়া আসছে ; মনে দুঃখ রাখিস না ” ৭
বিদ্যাসাগর কোনো সাধুসন্তের কাছে গমন করেছেন এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না | যদিও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎ ও কয়েকঘণ্টা কাল অতিবাহিত হয়েছে | এক্ষেত্রে ঠাকুরই এসেছেন বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে | ঠাকুর অবশ্য ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো রূপ সিন্ধান্ত বাক্য বিদ্যাসাগরের মুখ থেকে আদায় করতে পারেননি | বিদ্যাসাগর তা সযতনে এড়িয়ে গেছেন |
তাহলে বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে | প্রতিবাদী কণ্ঠে একদল বলে উঠবেন , মশাই , বিদ্যাসাগরের চিঠিপত্র দেখেছেন ? সেখানে ‘ শ্রী দুর্গা ‘ , ‘ শ্রী হরি সহায় ‘ নামোল্লেখতো আস্তিকতারই প্রমাণ |
কিন্তু চিঠির শুরুতে শ্রী দুর্গা বা শ্রী হরির নামেল্লেখ বিদ্যাসাগরের ঈশ্বর ভক্তি প্রমাণের সর্বোত্তম যুক্তি হতে পারে না | কারণ ওটি ছিল একটি সামাজিক আচার | বিদ্যাসাগর ভাইয়ের বিবাহ অথবা পিতৃমাতৃ শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া প্রভৃতি সামাজিক আচারগুলিকে অমান্য করেননি | চিঠির শুরুতে ভগবানের নাম স্মরণ কতটা সে’রূপ |
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য এরা বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক বলে দাবী করেছেন | আবার হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন – ” সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম ” – এই অনুভব বিদ্যাসাগরের হয়েছিল | কিন্তু আমার মনে হয় এই দুই ধরণের অভিমতের কোনোটাই পুরোপুরি সত্য নয় | তা আমরা এই প্রবন্ধের পর্যায়ক্রমিক আলোচনায় বুঝতে পারব |
বিদ্যাসাগর যে নাস্তিক ছিলেন এমন কথা জোর দিয়ে কখনোই বলা সম্ভব নয় | তবে তিনি ধর্মের বাহিক্য আচরণ বিধি নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না | কিন্তু শাস্ত্রে ধার্মিক হৃদয়ের যে যে লক্ষ্মণের কথা উল্লেখ রয়েছে সেগুলির সবগুলিই বিদ্যাসাগরের মধ্যে পুরোমাত্রায় বর্তমান ছিল | ‘ শ্রীমদ্ভাগবত পুরানের ‘ মতানুযায়ী ধর্মের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে –
” নৈতাদৃশঃ পরোধর্মো নৃণাং সদ্ধর্মমিচ্ছতাম্ |
ন্যাসো দণ্ডস্য ভূতেষু মনোবাক্কায়জস্য যঃ || ”
( ৭/১৫/৮ )
অর্থাৎ সৎ ধর্ম পালনে ইচ্ছুক ব্যক্তির কাছে কায়মনোবাক্যে কোনো জীবকে কোনোরকমে কষ্ট না দেওয়াই বড়ো ধর্ম |
বিদ্যাসাগর এর সার্থক রূপায়ণ | মানুষের কথা ছেড়েই দিলাম , সামান্য কুকুর বিড়ালের মৃত্যুতেও কেঁদে আকুল হতেন | ” বিদ্যাসাগরের দয়া কি কেবল মানুষের জন্য ? সর্বজীবে দয়া | একসময়ে মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর | বাছুরেরা মায়ের দুধ পায় না দেখে এককালে দুধ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন ; দুধ তো নয়ই , দুধের তৈরি কোনো জিনিসই খেতেন না | ঘোড়া নিজের কষ্ট বলতে পারে না ; কিছুকাল বিদ্যাসাগর তাই ঘোড়ার গাড়িতে চড়েননি | ” ৮
মহাত্মা কপিলমুনি তাঁর মাকে শোনাচ্ছেন ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব –
” যে মাং সর্বেষু ভূতেষু সন্তমাত্মানমীশ্বরম্ |
হিত্বার্চাং ভজতে মৌঢ্যাদ্ভস্মন্যেব জুহোতি সঃ || ”
( শ্রীমদ্ভাগবত ৩/২৯/২২)
আমি সর্বাত্মা , সর্বভূতে বিরাজমান | তথাপি যে মোহ বশে প্রকৃত আমাকে উপেক্ষা করে প্রতিমা পূজায় ব্যস্ত থাকে , সে তো কেবল ভস্মেই ঘৃতাহুতি দেয় |
বিদ্যাসাগরের জীবন পর্যালোচনা করলে সততই প্রমাণিত হয় তিনি মানবসেবার কাজটি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন | বিবেকানন্দও স্বীকার করে নিয়েছেন , রামকৃষ্ণের পর তাঁর গুরু বিদ্যাসাগর | | স্বামীজির এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন নিশ্চয় বিদ্যাসাগরের উদার হৃদয় ও মানুষের প্রতি সর্বোত্তম প্রেম বিতরণের জন্য |

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।