সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ৮

|| ৮ ||

নারায়ণবাবুর স্মৃতিশক্তির আর একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করব | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তেতলার ঘরে বসেছে আড্ডা | নারায়ণবাবু তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন | কয়েকজন সহকর্মী ও চা সহযোগে আড্ডা বেশ জমে উঠেছে | আড্ডাতে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও রয়েছেন | এমন সময় বিষাদগ্রস্থ মন ও মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন প্রমথনাথ বিশী | মানে প্র.না.বি | আড্ডাস্থল থেকে ঘোষিত হলো আজ নারায়ণবাবু প্র.না.বি কে চা খাওয়াবেন | কিন্তু প্রমথ বাবুর মুখ ভার কমল না | ব্যাপারখানা কী ? প্র.না.বি নতুন কবিতার বই প্রকাশ করতে চলেছেন | কিন্তু ‘বঙ্গশ্রী ‘ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতা সংকলনে রাখতে চান , অথচ কবিতাটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না | নারায়ণবাবু কবিতাটার নাম জানতে চাইলেন | প্রমথবাবু নামটা জানালেন | লাজুক হাসি হেসে নারায়ণবাবু জানালেন , ” আমার পুরো কবিতাটিই মনে রয়েছে | প্রয়োজনে আপনি লিখে নিতে পারেন | ” শুনে প্রমথনাথ তো অবাক | একটু গম্ভীর গলায় বললেন , ” দেখুন এত স্মৃতি ভালো নয় , ভালমন্দ সবই আপনি মনে রাখতে পারেন দেখছি | ” হো হো করে হাসির রোল উঠল আড্ডাশালায় |
অধ্যাপক হিসাবে তিনি খ্যাতিমান ছিলেন সেকথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি | অধ্যাপক হয়েও তিনি যে বেশ রসে-বশে থাকতেন সেই রসালো গল্প একটু শোনা যাক |
এক বর্ষার দুপুর | অনার্স ক্লাসের ছাত্ররা দরজা ভেজিয়ে গাইছে – আজি বরষণ মুখরিত …| কোরাস গান আর বেঞ্চের ঠেকায় আসর জমে উঠেছে | হঠাৎ দরজা ঠেলে নারায়ণবাবুর প্রবেশ |
সব চুপচাপ | সকলেরই দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর মতো অবস্থা | ” গাও | ” কিন্তু ছাত্ররা পূর্ববৎ | ” পুরো গান শেষ না করলে ক্লাস নেব না | ” বাদশাহী মেজাজ দেখে ছাত্ররা ঠেলে সৌমিত্রকে মানে পরবর্তীতে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে তুলে দিল | সৌমিত্র কোনো রকমে কনডেমড সেলের আসামীর মতো কাঁপা কাঁপা গলায় গেয়ে সে যাত্রায় নিস্তার পেল | তারপর ‘ রক্ত করবী’ র বিশুপাগলকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলো |
পড়ানোটা যে একটা ব্রত , লেকচারটা যে একটা আর্ট নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ | অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন : ” যখন লেখক তখন লেখক , যখন অধ্যাপক তখন অধ্যাপক | গ্রীষ্মের অসহ্য গরম , কলেজ স্কোয়ারের দিক থেকে গরম বাতাসের হলকা ক্লাসরুমে ঢুকছে , ফ্যানের বাতাস ঘরটাকে দমবন্ধ করে তুলেছে , দরদর করে ঘামছেন নারায়ণবাবু , ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির ঘাড়টা ঘামে ভিজে যাচ্ছে ; কিন্তু মাস্টারমশায়ের পড়ানোতে কোনো বিরাম নেই ,শ্রান্তি নেই | কথা যে কত সুন্দর করে বলা যায় , একটা ক্লাসকে যে কতখানি আকর্ষক, গভীর মূল্যবান করে তোলা যায় , শ’দেড়েক ছাত্রের মনকে কী অসামান্য ঐন্দ্রজালিক গুণে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তার এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় | ৮
তিনি নামযশের কাঙাল ছিলেন না | বরং ছিলেন আদন্ত্য বিনয়ী | অপরকে সম্মান দিতে তিনি কোনো কার্পণ্য করতেন না – সে কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি | তিনি বাংলা সাহিত্যে এম, এ তে প্রথম শ্রেণির প্রথম | স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন , কিন্তু সেকথা মুখ ফুটে কাউকে বলতেন না | ডক্টরেট হয়েও নিজের নামের আগে কখনও ডক্টর শব্দটি বসাননি | বোধহয় তিনি খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়তে চাননি |
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় শিক্ষক হিসাবে জনপ্রিয়তার আর একটি কারণ কবি শঙ্খ ঘোষ উল্লেখ করেছেন – ” তাঁর ছাত্রদের তিনি স্পর্শ করতে জেনেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে , সুখ-দুঃখময় মানুষ হিসেবে , তাদের বয়সের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে | ক্লাসের বাইরে ছেলেমেয়েদের রাজনৈতিক , পারিবারিক , অর্থনৈতিক সংকটের অন্তরঙ্গ হতে জানতেন বলেই খুব সহজ ছিল তাঁর ওপর নির্ভর করা , তাঁর সাহায্য নেওয়া , তাঁকে আত্মীয় বলে বোধ করা | ” ৯
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে আমাদের প্রাপ্তি কম ছিল না | সেই স্বপ্নময় প্রাপ্তি ড: গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা শেষ করব |
” আজ মনে হয় তিনি …কি দিয়েছিলেন আমাদের ? অসামান্য অধ্যাপনা ? ছাত্রদের কাছে এক সুন্দর সংস্কৃতিমান জীবনযাত্রা ? জীবনের এক মানবীয় বোধ ? মনে হয় , তিনি আমাদের দিয়েছিলেন স্বপ্ন | এক স্বপ্নের ভুবন | ” ১০
————————————————————-
তথ্যপ্রাপ্তি :
১| নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় : মাস্টারমশাই, কোরক , জানুয়ারি২০১৮ , পৃঃ ৯৮ | ২| ঐ , পৃঃ ৬৮ | ৩| ঐ , পৃঃ ৯৯ | ৪| ঐ , পৃ: ১১৮ | ৫| ঐ, পৃঃ ৫২ | ৬| ঐ, পৃঃ ৫২-৫৩ | ৭| ঐ, পৃ: ৩১ | ৮| ঐ, পৃঃ ৭০ | ৯| ঐ , পৃঃ ২৩ | ১০| ঐ , পৃঃ৬৮ | এবং আনন্দবাজার পত্রিকা ( ২৯.১০.২০১৬ )

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।