সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্ত্তী – ২০

শিক্ষয়িত্রী নিবেদিতা

কেউ কোনো অন্যায় করলে নিবেদিতা তার দিকে এমন কঠোর দৃষ্টিতে তাকাতেন যে তার শান্তি হয়ে যেত |
অনেক সময় তিনি নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেন এবং লক্ষ্য করতেন মেয়েরা কেমন পড়াশুনা করছে | মেঝেতে পিঁড়ির উপর কুশন পেতে তখন বসার ব্যবস্থা ছিল | কেউ কুজো হয়ে বা সামনের দিকে ঝুকে বসলে তৎক্ষণাৎ তিনি ঘরে ঢুকে পিঠে হাত দিয়ে সোজা করে তাকে বসিয়ে দিতেন | নিয়মের প্রতি সর্বদা তার কঠোর দৃষ্টি থাকত |
বিদ্যালয়ের সামান্য জিনিস কেউ অপচয় করুক এটার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি | সামান্য জিনিস যেমন সুতা , পেনসিল , কাপড়ের টুকরো যাতে মেয়েরা নষ্ট না করতে পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন |
নিবেদিতা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী হলেও সব ছাপিয়ে হয়ে ওঠেছিলেন আদর্শ শিক্ষিকা | কীরূপ অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে ছাত্রীগণকে পর্যবেক্ষণ করতেন তা তাঁর স্বহস্তে রচিত একটি রিপোর্ট থেকে জানতে পারা যায় | প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা মাতাজির “ভগিনী নিবেদিতা” পুস্তকে উল্লেখ আছে পঁয়তাল্লিশ জন ছাত্রীর মধ্যে আঠাশ জনের রিপোর্ট প্রস্তুত করেন | নিচে তাদের মধ্যে দুজনের রিপোর্ট উল্লেখ করা হলো –
সুভাষিণী দত্ত : জাতি কায়স্থ | ৬০ দিনের মধ্যে ৫১ দিন উপস্থিত | শুনিতে পাই , পিতামহীর সঙ্গে তাহার সম্ভাবের বেশ মিল আছে | তাঁহারই মতো বুদ্ধিমতী , মিশুক , অমায়িক | তবে চপল প্রকৃতির | মেয়েটিকে আমার ভালো লাগে |ইংরেজী ভালই শিখিতেছে | তাহার রঙ এর কাজ চমৎকার | হাতের কাজে গভীর অনুরাগ এবং উহাতে সে তন্ময় হইয়া যায় ; বার বার করিয়াও ক্লান্ত হয় না | সহজেই ভদ্র ব্যবহার শিখিতেছে |
জ্ঞানদাবালা : এক মজার নিম্নশ্রেণির বালিকা | অন্ত:করণ খুব ভাল | বাড়ির কাজকর্মের বাতিক আছে | পড়াশোনা একেবারেই পছন্দ করে না এবং তাহাকে শিক্ষা দেওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার | কিন্তু যদি ক্লাস ঘর পরিষ্কার করিতে হয় , তাহা হইলে খুব খুশী | প্লেগের সময় আমি যখন কাজ পরিদর্শন করিতে যাইতাম সে সর্বদা আমার সহিত ঘুরিয়া বেড়াইত | পরে জানা গেল , তাহার মার একটি ক্ষুদ্র দোকান আছে এবং সে-ই উহার দেখাশুনা করে | একদিন আমি যখন কিছু কলা কিনিবার জন্য ঐ দোকানে গিয়াছিলাম তখন সে তাহার মা অপেক্ষা অনেক বেশি উদারতা দেখাইতে চাহিয়া ছিল , আর সেজন্য মার নিকট তিরস্কৃত হইয়া লজ্জায় কিরূপ আরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল , তাহা আমি ভুলিতে পারি না | ৫
এই রিপোর্ট থেকে এটা স্পষ্ট যে, তিনি ছাত্রীদের স্বভাব , চরিত্র ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে কতখানি ওয়াকিবহাল ছিলেন | যাঁরা শিক্ষকতার কাজে যুক্ত তাদের কাছে রিপোর্টটা নিসন্দেহে শিক্ষণীয় |
সেই সঙ্গে শিক্ষণীয় তাঁর শিক্ষা দেওয়ার কৌশলটি | তাঁর শিক্ষা দেওয়ার কৌশলটি ছিল স্বাজাত্যবোধের | ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা | এখানে উল্লেখ্য স্বামীজির শিক্ষায় নিবেদিতা হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় | স্বামীজি একবার নিবেদিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন , “মার্গট, তোমার দেশের নাম কী ?” নিবেদিতা উত্তর দিয়েছিলেন , “ইংল্যাণ্ড |” স্বামীজি বললেন , “না ভারত |” নিবেদিতাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন প্রকৃত অর্থেই ভারতবাসী |
একদিন ক্লাসে নিবেদিতা জিজ্ঞাসা করলেন , “আচ্ছা মেয়েরা বলত তোমার দেশের রানি কে ?” দু’তিনটি মেয়ে বলল, “Queen Victoria -আমাদের দেশের রানী |” নিবেদিতা গর্জন করে উঠে বললেন , “Queen Victoria কখনও তোমাদের দেশের রানি হতে পারেন না – তোমাদের দেশের রানী হলেন সীতা দেবী- শুদ্ধ হতে শুদ্ধতরা |”
অন্য একদিন নিবেদিতা তাঁর ছাত্রীদের প্রশ্ন করলেন , মহাভারতে বর্ণিত নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বীর কে ? মেয়েরা কেউ বলল দ্রৌপদী , কেউ বলল কুন্তী , কেউবা বলল সুভদ্রা | নিবেদিতা বুঝিয়ে দিলেন যে মহাভারতের সবচেয়ে বীর রমণী গান্ধারী | তুলনাহীন তাঁর পতিভক্তি , পতি দৃষ্টিহীন বলে চোখ থাকতেও তিনি সারাজীবন ইচ্ছা করে পৃথিবীর আলো থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছেন | কিন্তু স্বামীর অন্যায় আচরণ তিনি কখনও সমর্থন করেননি | আপন সন্তানের প্রতি তাঁর অসীম মমতা , তবুও যুদ্ধযাত্রার আগে দুর্যোধন আশীর্বাদ চাইলে তাঁকে তিনি জয়ী হবার আশীর্বাদ দিলেন না | বললেন, “যে পক্ষে ধর্ম সে পক্ষেরই জয় হোক |” যুদ্ধে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রদের মৃত্যু হবে জেনেও তিনি অধর্মের পক্ষে যেতে পারলেন না |
একবার ইতিহাসের ক্লাসে রানি পদ্মিনীর কথা পড়া যাচ্ছে | বিধর্মীর হাত থেকে নিজেদের পবিত্রতা রক্ষার জন্য রানি শত শত রাজপুত রমণীদের নিয়ে জহরব্রতের আয়োজন করেছেন | অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জনের আগে তারা করজোড়ে অগ্নিস্থল প্রদক্ষিণ করছেন – এইটুকু পড়ার পর তিনি বইটি রেখে দিয়ে করজোড়ে বসে পড়লেন ও বললেন , “এস, আমরা মেয়েরা , আমরাও রানি পদ্মিনীর এই মনোভাবের কথা চিন্তা করি |” করজোড়ে গভীর ভাবের সঙ্গে বলতে লাগলেন , “আহা কী সুন্দর , কী অপূর্ব |” ছাত্রীদের ইতিহাস পাঠ দিচ্ছেন সে কথা তখন তাঁর আর মনে নেই | পদ্মিনীর শেষ চিন্তায় সেই মুহূর্তে তাঁর মন লীন হয়ে গেল | চিতোরের রানী পদ্মিনীর কাহিনী তাঁর চিত্তকে বিশেষরূপে অধিকার করেছিল | ছাত্রীদের তিনি বলতেন , “তোমরা সকলে এইরকম বীর হও , ক্ষত্রিয়জাতির এইরূপ আচরণ | ভারতবর্ষের কন্যাগণ তোমরা এই ক্ষত্রিয় বীরব্রত গ্রহণ কর |”

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।