সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ১৭

মর্তকায়ার অন্তরালে


নিবেদিতার সঙ্গে বিপ্লব আন্দোলনের সংস্রব ছিল ১৯১০সালের ২০জানুয়ারি র‍্যাটফ্লিক লেখা চিঠিতেই তার প্রমাণ মেলে |

এত কথার বলার অর্থ এইমাত্র যে নিবেদিতার রাজনৈতিক কার্যকলাপ না জানলে বিবেকানন্দের বৈপ্লবিক সত্তা বোঝা কঠিন হবে|

বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সাক্ষাৎকারে সেই কথাই উঠে এসেছে | “সুভাষচন্দ্র আমাকে বলেছিলেন : ‘ভারতবর্ষকে আমি ভালোবেসেছি বিবেকানন্দ পড়ে | আর বিবেকানন্দকে আমি চিনেছি নিবেদিতার লেখায় |’ বস্তুতঃ বিবেকানন্দের দেশপ্রেমের ফায়ারকে নিবেদিতা তাঁর জীবনের মধ্যে ধারণ করেছিলেন | শুধু ধারণই করেননি তিনি, সেই আগুনকে তিনি বহনও করেছিলেন ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত | ……স্বামীজীর বাণী ও আদর্শের প্রবল বেগকে তিনি মহাদেবের মতো নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন, আবার ভগীরথের মতো সেই দুর্মদ স্রোতধারাকে তিনি বহন করে বেড়িয়েছেন |”২৯

মহাযোগী, মহাঋষি, মহাবিপ্লবী, মহান স্বদেশ প্রেমিক ছিলেন শ্রী অরবিন্দ ঘোষ | ইংরেজদের ভাষায় – দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান | সেই অরবিন্দ প্রসঙ্গে দীনেন্দ্রকুমার রায় বলছেন : “অরবিন্দ স্বামী বিবেকানন্দের বাংলা প্রবন্ধগুলি পাঠে বড়ই আনন্দ উপভোগ করিতেন | আমাকে বলিতেন, স্বামীজীর ভাষায় প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়; ভাষার ভাবের এ’রূপ ঝঙ্কার, শক্তি ও তেজ অন্যত্র দুর্লভ |”৩০

শ্রী অরবিন্দও তাঁর সাধনজীবনের পথপ্রদর্শক হিসাবে স্বামীজিকে স্বীকার করে নিয়েছেন | “আমি উপরের নানা স্তর সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না | বিবেকানন্দই প্রথম আলিপুর জেলে এসে আমায় সম্বোধিস্তর দেখিয়ে দেন এবং প্রায় মাসাবধি সম্বোধি সমন্ধে আমায় শিক্ষা দেন |”৩১ এই প্রবন্ধ তা আলোচনা করার উপযুক্ত ক্ষেত্র নয় | অরবিন্দের রাজনৈতিক জীবন মোটামুটি ১৯০২ থেকে১৯১০ পর্যন্ত | এই সময় তাঁর জীবনে স্বামীজির ভাব ও আদর্শ লক্ষ্য করা গেছে | ১৯০৫ সালে ‘ভবানী মন্দির’ এ বললেন : “সিংহহৃদয় বিবেকানন্দ তাঁর যে বাগ্মিতার দ্বারা পৃথিবী প্রকম্পিত করতে চেয়েছিলেন – তার মর্মকেন্দ্র গঠিত হয়েছিল কোন বস্তুতে; – তা আর কিছু নয়, ঈশ্বর আছেন – এই সত্যে |”৩২

বিবেকানন্দের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রী অরবিন্দ লিখলেন : “বিবেকানন্দের প্রভাব এখনও বিপুলভাবে কাজ করছে আমরা দেখতে পাই …..যা এমন কিছু, যা সিংহপ্রতিম, বিরাট সম্বোধিদীপ্ত; যা সমুদ্রের জোয়ারের মতো প্রবেশ করেছে ভারতের মর্মকেন্দ্রে এবং তা দেখে আমরা সোচ্ছ্বাসে বলে উঠি, ঐ দেখ, বিবেকানন্দ এখনও জেগে মাতৃমর্মে, মাতৃসন্তানদের মর্মলোকে |”৩৩

অরবিন্দের রাজনৈতিক কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো মুরারি পুকুর বোমার মামলা | অর্থাৎ প্রথম জীবনে তিনি সশস্ত্র রাজনৈতিক বিপ্লবকেই সমর্থন করেছিলেন | অবশ্য ভগবান তাকে বেশিদিন রাজনীতিতে রাখেননি | তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়- তাঁর এই অল্প রাজনৈতিক জীবন ও কর্মে স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব অনস্বীকার্য।

||৩||

গোয়েন্দা রিপোর্ট ও ঐতিহাসিকদের মন্তব্য

বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে বিবেকানন্দোর রচনাবলী এবং রামকৃষ্ণ মঠের প্রতি ব্রিটিশ পুলিশের কড়া নজরদারী ছিল | এমনকি স্বামীজি জীবিতকালেই ব্রিটিশদের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়েছিল | লক্ষ্য রাখা হতো তাঁর গতিবিধির উপর |

স্বামীজির জীবনে সমস্ত কার্যাবলীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠা | উল্লেখযোগ্য এই কারণেই প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই আজ অবধি আমরা শিক্ষা , স্বাস্থ্য আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা এর সুফল ভোগ করে চলেছি | সেই রামকৃষ্ণ মিশন কিন্তু বিট্রিশদের সন্দেহের তালিকার ঊর্ধ্বে ছিল না | সরকার একসময় রামকৃষ্ণ মিশনকে বেআইনী ঘোষণা ও বেলুড়ে মিশনের সদর দফতর বন্ধ করে দেবার কথা ভেবেছিলেন | প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখায় এর উল্লেখ আছে | “একদিন এইরূপ একটি গোপনীয় ফাইলের উপরে দেখিলাম লেখা আছে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ | আমি একটু আশ্চর্য বোধ করিয়া ফাইলটি আমার বসিবার ঘরে নিয়া পড়িতে লাগিলাম | ফাইলের সর্বনিম্ন তলে একটি পুলিশ রিপোর্ট আছে – তাহাতে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইয়াছে যে, রামকৃষ্ণ মিশনের ৮/১০জন সাধু পূর্ব জীবনে বিপ্লবী এবং গুপ্ত সমিতির সভ্য ছিলেন, কেহ কেহ ডাকাতি করিয়াছেন এবং নানা ভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করিতেন |

তাঁহাদের পূর্বেকার এবং বর্তমান সাধু অবস্থার নামও দেওয়া আছে | ইহার অনেক প্রমাণও ঐ ফাইলে ছিল | এই বিবরণের পর কয়েকজনের উচ্চ পদস্থ ইংরেজ কর্মচারীরা এ বিষয়ে যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহাও পরপর পৃষ্ঠায় লিখিত আছে | সর্বশেষ সেক্রেটারী এইসব মন্তব্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়া বড়লাটের কাছে পাঠাইবার সময় প্রস্তাব করিলেন যে বেলুড় মঠকে বেআইনী ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হউক |

এইসব মন্তব্য পড়ে বড়লাট ফাইলে লিখিয়াছেন : “পুলিশের রিপোর্ট ও সেক্রেটারীর মন্তব্য খুব সম্ভব বেলুড় মঠের কর্তৃপক্ষ জানিতে পারিয়াছেন | কারণ মাত্র কয়েকদিন পূর্বে একজন আমেরিকান মহিলা (মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড) আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন, যদি বেলুড়মঠ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় তাহা হইলে আমেরিকায় ইহার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হইবে | এ সময় (খুব সম্ভব বিশ্বযুদ্ধে যখন বিপন্ন ইংরেজ আমেরিকার সাহায্যের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করিতেন ) কোনভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধভাজন হওয়া যুক্তিযুক্ত নহে | সুতরাং বেলুড়মঠ বন্ধ না করিয়া সাদা পোশাকে কয়েকজন পুলিশ কর্মচারীকে সদা বেলুড়মঠে নিযুক্ত করা হউক | যে সমুদয় বিপ্লবীদের নাম পূর্বোক্ত বিবরণীতে আছে তাহাদের গতিবিধির উপর যেন কড়া নজর রাখা হয় |”

ক্রমশ…….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।