• Uncategorized
  • 0

গল্পেরা জোনাকি তে মধুপর্ণা বসু

গরম ভাত

এখন রাত প্রায় শেষ, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া শরীরটা বিছানায় পড়ে আছে, শরীরে একটা ঝড় বয়ে যায় রোজ। মাসি একটু আগে মুখে ঠুঁসে দিয়ে গেছে ঠান্ডা একটা এগরোলের টুকরো।
এমনই হয় রোজ, এতো ধকলের পরে খাওয়ার হুঁশ থাকেনা, আর হয় মাসি বা চন্দা ববি কেউ একটা আধখাওয়া ডিম রোল বা নেতিয়ে যাওয়া বিরিয়ানি দিয়ে যায় বিন্দুকে।
এই ব্যবসায়ে আসলে এটাই নিয়ম, রক্ত চামড়ার বেওসা বাবা! ভদ্দরনোকেরা তাই বলে,
বেবুশ্যেদের আজকাল কত কি নামে ডাকা হয় — বেশ্যা, খানকি, রাঁড় এসব পুরনো, সেকেলে বাতিল।
এখন escort, street girl, slut কি সব.. বিন্দু এতো কিছু বোঝেনা, শুধু জানে গতর নিঙড়ে দিলে খেতে পাবে, থাকার জায়গা, পড়ার জামাকাপড় পয়সা আর বেঁচে থাকার চেষ্টা।
ছোট বেলা থেকে তাই বুঝে এসেছে।
বড় খিদে বিন্দুর, পেটে যেন একটা চুলা বসে আছে। শুধু হাঁ করে গিলতে চায়।
আহা! দুপুর বেলা একথালা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত।
কতো দিন তার ভাত জোটেনি, কত দিন হবে..
সে ছিল কোন ছোট বয়েসে, কতো হবে তখন সে?  বারো তেরো, আম্মি সাত বাড়ি কাজ সেরে ফিরে এসে  কাঠের আঁচে ঝুলকালি সিলভারের হাঁড়িতে ভাত বসাতো, সাথে দু’একটা আলু, কুমড়ো, এদিক সেদিক থেকে কুড়িয়ে আনা শাকপাতা, তাই ছিল অমৃত। আম্মি সে আর ভাই মিলে তৃপ্তি করে খেত। সে ছিল আম্মির আদরের বিলকিস।
তারপর একদিন তার ভাত খাওয়া উঠে গেল, যেদিন করিম চাচা আর পাড়ার কজন মিলে আম্মিকে মাটি দিয়ে এলো।
মুখে রক্ত তুলতে তুলতে মরে গেল আম্মি।আর ভাইটাও যে কোথায় পালালো..
দুচারদিনে তার আশপাশ বদলে ঠাঁই হল এই শহরের কানা গলি। অন্ধকার চারদিক বন্ধ। আসলে এখানে আলোর রোশনাই অনেক, পান বিড়ির দোকান, দেশী মদের ঠেক, কাম উত্তেজক শেকড়বাকর, ওষুধ, কনডোম আর রক্ত মাংসের গন্ধে ঘিনঘিনে এই বেশ্যা পাড়া। কবে যে শরীর শরীর খেলা শুরু হয়ে গেল বিন্দুরও,
সেসব দিন, তখন মাসি রোজ কিসব ওষুধ দিত যাতে তার নরম মাটিতে কোদাল কোপানোর যন্ত্রণা কম হয়।
তারপর মুন্সিগঞ্জের এই লাল বাড়িটাই তার ঘর, তার পৃথিবী তার অন্ধকার জগৎ।
এখানে আকাশ বলতে গোলাপি সিলিং, সবুজ দরজা, আর একটা রট আয়রনের খাট। রোজ রাতে নিত্যনতুন মিনসে। লোভে আর কামে নালঝোল পড়ে যাওয়া কটা জন্তু। এখন আর লজ্জা ভয়, এসব হয়েনা বিন্দুর। বিলকিস এখানে বিন্দু, ভারি বুক নিয়ে এখানে আসতে ওই বাড়িউলি মাসিই তাকে বললো, “বাবা, এযে হিন্দি ফিলিমের বিন্দু রে!”
রাতে রোজ যখন এঁটো শরীরটাকে নিয়ে কলঘরে বসে, দুই উরুর খাঁজে গরম জল ঢালে, বিন্দুর খিদে পায়, বসে বসে ইচ্ছে হয় গরম ভাত খেতে আর ঘরে ফিরে ভুলে যায় সব।
ঘুমে অসার হয়ে যায় শরীর, স্বপ্নে আম্মি আসে ভাতের থালা হাতে, মুখে হাল তুলে দিতে গিয়েই কোথায় হারিয়ে যায়।
ভোর হয় বেশ্যা মাগীগুলোর  চীৎকার আর খিস্তিতে। মাঝেমধ্যে এই ঘরের বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। খদ্দেররা কখনো নিয়ে যায়, সস্তার হোটেলে, গড়ের মাঠে বা কোন পার্কে, নাচের কদর আছে তার,  দুএকবার ওই যে বলে মদের বার তাতেও গেছে।
আজ সকালে কি মনে হল, সকালে তো তেমন ভিড় থাকেনা। তাই মাঝে মধ্যে এটা সেটা কিনতে আশেপাশের সাজগোজের দোকানে যায়। কি মনে হল আজ, একটা জামা গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিন্দু।
পিঠের চেন টানা নেই, তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই মাগীর, শরীরে ঝামা ঘসতে ঘসতে আর পুরুষের নোংরা হাতের খুবলে খাওয়া সহ্য করে শরীর নিয়ে কোন সতীপনা তার কবেই ধুয়েমুছে গেছে।
এখানে আশেপাশে বেশ কতগুলো ঝুপড়ি বাড়ি, পান বিড়ির দোকান আছে। ঝুপড়ি গুলোয় বাচ্ছা শুয়ে ঘুমোয়, বুক খোলা ব্লাউজ আর ছেঁড়া কাপড় অথবা শত ফাটা নাইটি পড়ে রোগা বউগুলো রাস্তার ধারে বাসন মাজে, মরদ গুলো কেউ, রাস্তা ঝাঁট দেয়, কেউ সরকারি গাছে জল দেয়, কেউবা ভ্যান চালায়। বিন্দুকে এই মিনসে গুলো চেনে তবে তার শরীর ধামসানোর পয়সা নেই।বউ গুলো জুলজুল করে তাকায়। দুএকবার নিজের পুরনো জামা জুতো চুমকি শাড়ি এদের দিয়ে যায় সে।
ঘোরের মতো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বিন্দু। একটা বউ কি যেন নাম?
আরে ওরই একটা পুরনো শাড়ি জড়িয়ে উনুন জ্বালিয়েছে, তার ওপর ঝকঝকে তোবড়ানো সিলভারের হাঁড়িতে ভাত বসিয়েছে।
পাশে শুয়ে আছে বছর দুয়েকের একটা ন্যাংটো ছেলে, ককিয়ে কাঁদছে। নাক থেকে সর্দি গড়াচ্ছে। বউটা গজগজ করতে করতে,’ উফফ, শালা পেটের শত্তুর, ভাত হবে তবে তো গেলাবো, দাঁড়া বাপ।’ একটা খুন্তিতে তুলে ভাত দেখছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিন্দু ; চোখের পলক পড়ে না।
গরম ভাত, সেই কবেকারের ইচ্ছে তার..
বউটা তাকে দেখে প্রথমে চোখ কুঁচকে কি যেন বোঝার চেষ্টা করলে, তারপর ধড়ফড় করে উঠে তার কাছে এসে বলে ‘ ওমা, দিদি যে, হ্যাঁ গো তোমারই শাড়ি এখানা, সেই কবে দিছিলে? আর দুটো আছে।
বিন্দু যেন শুনলোই না, চেয়ে আছে ভাতের হাঁড়ির দিকে। তার সাত জন্মের খিদে যেন চাগাড় দিয়ে উঠেছে।চোখে উনুনের আগুন জ্বলছে, বুকে যেন উপোষী একটা শিশু গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে।
‘ কিগা দিদি? এই ভাত হল বলে, ছেলেটা খিদেয় কেমন..
ও দিদি, বলতে নজ্জা করে এই দুপুর রোদে হাঁড়ির সামনে এসে পড়লে, কি বলি মানে যদি কিছু মনে না নাও খাবে নাকি দুটো গরম ভাত? ‘
বিন্দুর চোখে থেকে টপটপ করে ঝরে পড়লো জল।
‘ এমা হেই দেখো, রাগ করলে নাকি? আসলে ভাতের মুখে কাউরে দুটি না দিলে যে খারাপ হয়, তাই..
বিন্দু যেন সেই বারো তেরোর বিলকিস, আস্তে আস্তে ফুটপাতে বাচ্ছাটার পাশে বসে পড়লো, তাকালে একবার বউটার দিকে।
কি বুঝলো কে জানে বউটা…
তাড়াতাড়ি বউ ভাতের ফ্যান ঝেরে একখানা কলাইয়ের থালা পেতে তাতে তুলে দিল ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত,  সাথে দিল নুন আর একদলা আলু সেদ্ধ। বললে, ‘ খাও গো দিদি, তোমার জামা শাড়ি পমেটম সব আমি যত্নে তুলে রাখি। গেরস্তের ঝুপড়ি তে আজ এয়েচো,  দুটো গরম ভাত বইত নয়।’
আজ এই ঝুপড়ি ঘরই হয়ে গেছে বিন্দুর আম্মির দাওয়া, এই দুনিয়াটা পুরোই গিলে নিতে সাধ হচ্ছে আজ।
মুন্সিগঞ্জের হাসিনা, বিন্দু রানী ফুটপাতে তার অন্নপূর্ণার কাছে হাত পেতেছে।
কি এক অসম্ভব খিদেয় গরম ভাত তৃপ্তি করে খাচ্ছে এক অচ্ছুৎ ঈশ্বরী।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *