গদ্যের পোডিয়ামে মধুপর্ণা বসু

রবি ঠাকুর, তোমায়

আমার মনে পড়ে, তখনও প্রথাগত গানের শিক্ষা শুরু হয়েনি, জীবনের প্রথম গান শিখেছিলাম স্কুলে ছয় বছর বয়েসে,
“এদিন আজি কোন ঘরে গো, খুলে দিল দ্বার,”
” সারাজীবন দিল আলো সূর্য, গ্রহ চাঁদ ” আর একটি গান, ” তুমি আমাদের পিতা, তোমায় পিতা বলে যেন জানি..।”
সেই যে ছয় বছরের অবুঝ মেয়ে তাঁকে পিতা বলে মেনে নিলো, সেই পিতৃত্ব ধীর, স্থাবর এক অলৌকিক গতিতে চলছে আজও। তিনি আমার হাজার বছর আগে গত বহু জন্মের পিতা, কোন জন্মে পুরুষ, কোন জন্মে প্রেমিক, কিন্তু তিনিই দীর্ঘ, তিনিই সচল, তিনিই দোষে গুনে, ভালো মন্দে, কাপুরষ মহাপুরুষে, পাপে, পূন্যে আমার আরাধ্যদেবতা, রয়ে গেলেন।
তিনি সবার কোন বা কোন সবল বা দুর্বল মুহুর্তের সখা, পুরুষ, ত্রাতা, প্রেম, বন্ধু, শত্রু, বিভিন্ন রূপে আরাধ্য রবি ঠাকুর। কবি পক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে আজ তাকে যাপনের শুরু, আসলে তাঁকে স্মরণ, তাকে অনুসরণ, জ্ঞানে অজ্ঞানে প্রতিনিয়তই করি। গৃহবন্দী মন, ঘরের সীমায় থেকেও তার শিক্ষাতেই ঘুরে ফেরে সারা বিশ্বে, তোমাতে আমাতে, নারী পুরুষে, বন্ধু শত্রুতে, রোগে ভোগে, আনব্দে, বেদনায় রবি ঠাকুর সবসময়ই মনের মধ্যে পায়চারী করেন, ওই শুভ্রকেশ, সফেন দাড়ি, আর, লম্বা জোব্বার আড়ালে।
সেই “এদিন আজি কোন ঘরে ” র পরে মেঘের কোলে, ধানের ক্ষেতে, বজ্র মানিক দিয়ে র যুগ, পার করে আমি তখন ষোড়শী।তখন, গল্পগুচ্ছ, গোরা, শেষের কবিতা, কিশোরীর হৃদয় তখন ” হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়” তখন সেই কবিই হয়ে উঠেছেন “জীবনের ধ্রুবতারা”, তিনি হলেন জীবনদেবতা,তিনিই আবার ‘অমিট রে’। তারপর তারুণ্যের স্বপ্ন বোনা চলার পথে, এই মানুষের ঠাকুর হয়ে উঠলেন, “পরম ধন হে”। সাহিত্য পড়তে পড়তে সেই দেওয়ালে টাঙানো দাড়িওয়ালা ছবিটি হয়ে উঠলো ফিলোসফার এন্ড গাইড। তিনিই ভেতর থেকে বলে দিলেন এবার দেখতে হবে বিংশ, একবিংশ কে, নতুন লেখা, মতামত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন কে। তার সাথে বিশ্ব সাহিত্যের যে আমূল ভাঙাচোরা, বদল, দুঃখবাস, মৃত্যুচেতনা, অস্তিত্বের সংশয়, রাজনৈতিক পালাবদল, সব কিছুতেই চোখ খোলার নির্দেশ পেলাম যেন তাঁর থেকেই।
তারপর একদিন তোমায় নিয়েই পড়াশোনা, কাটাছেঁড়া, প্রবন্ধ, চিঠিচাপাটি, তোমার সাথে প্রাণের আলাপ। তখন আমি যুবতী, তখন তুমি যে বৃদ্ধ সেই বৃদ্ধই। তবুও কি অমোঘ টান, কি ভীষণ সত্যি, কি যুগোত্তীর্ণ তুমি! কতো ব্যঙ্গ, রসিকতা, শ্লেষ, সমালোচনা, অনায়াসে অতিক্রম করে আজও দেখো, সেই তোমাকে নিয়েই প্যারোডি, মিম, ট্রোল, এসব তুমি বুঝবেনা।এসব এযুগের যাকে বলে টেকনিক্যাল হ্যাজার্ড। তোমার কবিতায় অশ্লীল শব্দ, তোমার গানে খিস্তি, কিন্তু দেখো, কি বোকা ওরা,
তুমি যদি হও ব্যাকডেটেড, অবসোলেট, মানে অচল, তাহলে সেই জোব্বাধারী বুড়োটাকে নিয়েই কেন এত গবেষণা? কেন তোমার কথা, তোমার সুরে, তোমার কবিতায় ছুরি চালানো?
এর একটাই মানে, আসলে তুমি ছিলে, আছো, এবং থাকবে, ভীষণ ভাবে থাকবে।

আমি জানি, আমিই তোমার ‘সাধারণ মেয়ে’, আমিই সেই মৃন্ময়ী, চারু, আমি বন্যা, মৃণাল, আমার মধ্যেই রয়ে গেছে বিনোদ, সুভা, আমাকেই কোথাও ছুঁয়ে গেছে কেটি, কুমুদিনী। আমিই হরিপদ কেরানীর সেই নামহীনা ‘পরণে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর ‘।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।