আমরা আট মাস হলো এই কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছি।এখানে এ,বি,সি করে তিনটে ব্লক। কমপ্লেক্সে ঢুকতে ডান দিকের তিনটে ব্লক ই কমপ্লিট হয়ে গেছে,আর অনেক ফ্ল্যাট বিক্রিও হয়ে গেছে।লোকজন যে যার ফ্ল্যাটে বাস করতেও শুরু করেছে।বাঁদিকের ব্লক গুলোর কাজ চলছে। ওখানেও এরকম ব্লক করে ফ্ল্যাট তৈরী হচ্ছে। আমরা থাকি এ ব্লকের 5th ফ্লোরে।বিল্ডিং গুলো সব কটি আট তলা।এই ব্লক গুলো র ছাদ একটার সঙ্গে আর একটা জুড়ে দেওয়া আছে,মানে যে কেউ ইচ্ছ করলে “এ” থেকে সোজা “সি” ব্লকে চলে যেতে পারে।এখানে কেউ চাইলেই মর্নিং ওয়াক বা ইভনিং ওয়াক করতে পারে ,দৌড়াতেও পারে।বিশাল জায়গা ছাদে। বাচ্চারা বিকেলে মুখে মাস্ক লাগিয়ে(কখনো আবার মাস্ক খুলে রেখে)এখানে ক্রিকেট খেলে।
প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা আমি আর আমার হাজবেন্ড ছাদে যাই হাঁটতে।ছাদে গেলে আমার শুধু মনে হয় পাহাড়ের উপরে কোনো এক সুন্দর হোটেলের ব্যালকনিতে বসে আছি।ছাদ থেকে বহুদূর পর্যন্ত বাড়িঘর আর আকাশ দেখতে অপূর্ব লাগে।সন্ধে হলে মনে হয় আলোর মালায় সব বাড়ি গুলো যেন সেজে উঠেছে।যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় মনেহয় যেন দূরে দূরে সব ছোট ছোট পাহাড় এর মাথায় আলো জ্বলছে।” উদয়ন” এয়ারপোর্ট এর মোটামুটি কাছে বলে প্লেনগুলো যখন ল্যান্ড করে তা ছাদ থেকে বোঝা যায়।দেখতে বেশ লাগে তখন।সব মিলিয়ে আমার ছাদটি বেশ অদ্ভুত সুন্দর লাগে।রাতে যেন এক মায়াবী সাজে সেজে ওঠে চারদিক।
সেদিন আমরা যখন হাঁটছিলাম ,আমার হাজবেন্ড কি একটা দরকারে নীচে নেমে গেল।বললো মিনিট দশেকের মধ্যে আবার ছাদে আসবে।ও নেমে যাওয়ার পর আমি একদম একা। কি আর করি….এ ব্লক থেকে সি ব্লক কত স্টেপ হয় গুনে গুনে হেঁটে চললাম। একেবারে সি ব্লকের শেষ দিকটায় যখন গেলাম তখন হঠাৎ খুব সুন্দরী এক ভদ্র মহিলা (বয়স এই চল্লিশ/বিয়াল্লিশ হবে)ছাদে উঠে এল।মনে হলো সি ব্লক থেকে সে উঠল।ছাদের সব আলো জ্বলছিল না তখন।আসলে ইচ্ছে করে ই দুটো আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম। চোখে বড্ড লাগছিল বলে। যাইহোক,ঐ অল্প আলোতেই দেখলাম ভদ্রমহিলার দুধে আলতা গা এর রং। বাঙালি মেয়েদের গড় উচ্চতা থেকে সামান্য বেশী তার উচ্চতা। ঐ পাঁচ ফুট তিন সাড়ে তিন ইঞ্চি হবে। ,স্লীম। অপূর্ব সুন্দরী। দারুণ একটা লাল রঙের শাড়ি পরেছে।লম্বা চুল খোলা রয়েছে,কি সিল্কি চুল তার!লাল লিপস্টিক ,কপালে বড় লাল টিপ,গলায় লম্বা এবং একটু চওড়া একটা সুন্দর সিটি গোল্ড (বা সত্যি গোল্ড ),এর হার।দু হাতে সুন্দর পুরানো ডিজাইনের দুটো বালা।কি অপূর্ব তার রূপ মাধুর্য না দেখলে বোঝানো মুশকিল। পেলবতা সারা শরীর জুড়ে,চোখ দুটো যেন মায়ায় ভরা।
আমাকে দেখে নিজে থেকেই কথা বললো। প্রথমেই বললো “ছাদটা খুব সুন্দর তাই না? আপনারা তো রোজ সন্ধ্যায় হাঁটেন আমি দেখি।দাদা সঙ্গে থাকেন বলে আর কথা বলি না।আজ আপনি একা তাই আলাপ করতে এলাম।”
আমি বললাম “আপনি আমাকে চেনেন?”
তখন সে বলল,”হ্যাঁ চিনি তো।দেবমাল্য দা র বৌদি তো আপনি। আপনাদের এখানে প্রায় সবাই চেনে।চলুন ঐ দিকটায় দাঁড়িয়ে কথা বলি।”
চলে গেলাম যে দিকে সে যেতে বলল সে দিকে।
কথায় কথায় ভদ্রমহিলা খুব হো হো করে হাসছিল। মনে হচ্ছিল হাসিতে যেন মুক্তো ঝরছে।নাম জিজ্ঞেস করলাম ,বললো, সুস্মিতা”। আমি মনে মনে ভাবলাম সুস্মিতা ই বটে। কিন্তু নাম করণের সময় মা বাবা কি করে বুঝেছিলেন যে বড় হয়ে তাদের মেয়ের হাসিটি এত সুন্দর হবে কে জানে।
আমাদের গল্প চলতে লাগলো। আধঘন্টা হয়ে গেল কিন্তু আমার হাজবেন্ড আর ছাদে ওঠেনি ,ফোন করে জানিয়ে ছিল আর উঠবেনা।কাজেই আমার আর সুস্মিতার গল্প খুব জমে গেল।সুস্মিতার এক ছেলে,এক মেয়ে। দুজনে ই স্কুলে পড়ে।ওর হাজবেন্ড কোন একটা কর্পোরেট অফিসে উঁচু পোষ্টে চাকরী করে।ওরা সি ব্লকে ফ্ল্যাট কিনেছে সেকেন্ড ফ্লোরে।
আমি ওর অত সাজের কারণ জিজ্ঞেস করতে বললো,”আজ আসলে আমার একটা গানের লাইভ প্রগ্ৰাম ছিল ফেসবুক এ।তাই সেজেছি। ভাবলাম ছাদ থেকে ঘুরে এসে একেবারে চেন্জ করে নেব। আজ ছেলে মেয়ে দুজনকে এই সন্ধ্যেটা ছুটি দিয়েছি।ওরা ওদের মত রয়েছে। সারাটাদিন অনলাইন ক্লাস,তারপর গানের রেওয়াজ সব করে করে ওরাও ক্লান্ত। তাই দু ঘন্টা রেষ্ট।”
সুস্মিতার সাথে যখন কথা বলছিলাম মনে হচ্ছিল ও আমার কত চেনা,কত আপন কেউ একজন।ও যে ভীষণ কথা বলতে পছন্দ করে সেটা দু মিনিটে ই বুঝে গেছি।এক একজন এরকম হয়,যার সঙ্গে কথা বলতে,যার কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগে।যাকে ভীষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।সুস্মিতা দারুণ গান গায়। খুব করে বলাতে “আমার মন কেমন করে”গান টার কটা লাইন গাইল। অপূর্ব লেগেছিল শুনতে।প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট কথা বলার পরে হঠাৎ সুস্মিতা বললো ,”এবার যাই ওর চলে আসার সময় হয়ে গেছে।ঘরে ঢুকে আমাকে দেখতে না পেলে আবার তার মুড অফ হয়ে যাবে। বেশী ভালো বাসলে ও জ্বালা।জানোতো ও ভীষণ কেয়ারিং আর সত্যি বলতে খুব ভালোবাসে আমাদের সবাইকে। এতদিন বিয়ে হয়েছে,বয়স হয়ে গেল এখনো আমাকে এক দিনের জন্য ও ছাড়বে না।বলে ওর নাকি ভালো লাগে না আমি বাড়ি না থাকলে।তবে আমার স্বাধীনতা য় ও কখনো হস্তক্ষেপ করেনা। আমি তো গানের প্রগ্ৰাম করে কত রাতে মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরি।সেসব মেনে নেয়।চলি গো। খুব ভালো লাগলো কতদিন পরে একজন মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারলাম। এখন তো আর আমি কারো সঙ্গে ইচ্ছে করলেও কথা বলতে পারিনা।”আমি বললাম “কেন? কথা বলতে ইচ্ছে করলেও বলতে পার না কেন?”ও বললো ,”সে অনেক কথা।পরে একদিন সব তোমাকে বলব।”
আমি ও ওর কথায় সায় দিয়ে নীচে চলে এলাম।যাবার সময় সুস্মিতা বললো”আবার সামনের শনিবার দেখা হবে। আবার অনেক গল্প হবে। সেদিন তোমার আবৃত্তি শুনব।”
নীচে এসে আমি দেখি আমার দেওর আর তার দাদা খুব আড্ডা মারছে।দেওর ও আমাদের “এ ব্লক” এ ই থাকে।তবে ওর ফ্ল্যাট টা থার্ড ফ্লোরে।ও যখন তখন আমাদের ফ্ল্যাটে চলে আসে।বিয়ে থা করেনি বলে নো ঝামেলা।বিন্দাস থাকে,আড্ডা জমায়। আমি এত সময় ছাদে কি করছিলাম একা একা জিজ্ঞেস করাতে আমি দুই ভাইকে সব বললাম।
আমার দেওর এই কমপ্লেক্স এর শুরু থেকেই এখানে আছে।প্রোমোটার এর সঙ্গে ওর দারুন খাতির। আমরা তো মাত্র আট ‘মাস আগে এসেছি।ও সব শুনে বড় এক “,হা”করে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো'”বৌমনি তুমি সব ঠিক বলছ তো?”আমি বললাম “হ্যাঁ তো। শুধু শুধু তোমাদের বানিয়ে কেন বলতে যাব!”তখন ও বললো,”শোন তাহলে….. আমি প্রথম থেকে সব জানি।সব বলছি। সি ব্লকে ওরকম একটা ফ্যামিলির আসার কথা ছিল।ফ্ল্যাট বুক করার জন্য ওরা এখানে এসেও ছিল। ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাট দেখানো হয়েছিল ওদের।ভদ্র মহিলা কে দারুণ দেখতে।একটা লাল রঙের শাড়ি পরেছিল।লং হেয়ার। চোখে পড়ার মত সুন্দরী। ওরা এত বছর আসামে ছিল। ভদ্রলোকের কলকাতায় পোষ্ষ্টিং হওয়াতে ওরা এখানে ফ্ল্যাট বুক করার কথা ভেবেছে। খুব পছন্দ হয়েছিল ঐ ফ্ল্যাট টা কিন্তু ওদের আর ফ্ল্যাট টা কেনা হয়নি। কারণ ঐ ফ্যামিলি টা একদিন লং ড্রাইভে বেরিয়ে ছিল,ওদের গাড়ি ব্রক্ষ্ণপুত্রের পাশ দিয়ে যাবার সময় সোজা নদীতে পড়ে যায়।সবার সলিল সমাধি হয়।”
দেওরের মুখে সব শুনে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।সোফায় বসে পড়লাম। মাথাটা যেন ঘুরে গেল। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে আমার মনেহয় ঘন্টা খানেক সময় লেগেছিল।এ ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আজ ও আমি খুঁজে পাইনি।ঐ রাতের পরে আর কোনদিন একা একা রাতে সি ব্লকের ঐ ছাদে যাইনি। আর এতদিন পরেও সুস্মিতা কে ভুলতে পারিনি।