ধলেশ্বরীর অন্য ধারায় ভ্রমণ কাহিনীতে লোকমান হোসেন পলা

রিসাং ঝর্ণায় সৌন্দর্য প্রাকৃতিক সৃষ্ট ওয়াটার স্লাইডিং দুর্গম এবং কালো দিক রয়েছে সেতায়

খাগড়াছড়ি জেলা সবুজের আবাসভূমি এই জেলার প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে উঁচু-নিচু পাহাড় আর টিলা। সাপ মারা রিসাং ঝর্ণা নামে পরিচিত ঝর্ণাটি খাগড়াছড়ি জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি।
দুর্গম এই ঝর্ণাটির সৌন্দর্য সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি। তবে ঝর্ণাটির কালো দিকটা একপ্রকার অজানাই থেকে গেছে আমাদের কাছে। আজ এই ঝর্ণাটির আদ্যোপান্ত বর্ণনার চেষ্টা করব।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে মাটিরাঙ্গা উপজেলার সাপমারা গ্রামে এই পাহাড়ি ঝর্ণাটি অবস্থিত। রিসাং শব্দটি এসেছে মূলত খাগড়াছড়ির মারমা সম্প্রদায়ের ভাষা থেকে। মারমা ভাষায় রিং শব্দের অর্থ পানি আর সাং এর অর্থ উঁচু স্থান হতে কোনো কিছু গড়িয়ে পড়াকে বোঝায়।
অর্থাৎ রিসাং শব্দ দ্বারা উঁচু স্থান হতে জলরাশি গড়িয়ে পড়াকে বোঝায়। স্থানীয় ভাষায় এই ঝর্ণাটির অপর নাম তেরাং তৈকালাই। আনুমানিক ১৯৯৩-৯৪ সালে পাহাড়ের গায়ে জুম চাষের সুবাদে এই প্রাকৃতিক ঝর্ণাটি আবিষ্কৃত হয় বলে জানা যায়।
খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে মূল মহাসড়ক হতে আরও দুই কিলোমিটার গভীরে রিসাং ঝর্ণা অবস্থিত। চাঁদের গাড়ি অথবা সিএনজিতে করে এই দুর্গম পথের কিছুটা যাওয়া গেলেও বাকি পথটা হেঁটেই পাড়ি দিতে হয়। ইট বিছানো পাহাড়ি সরু রাস্তা ধরে প্রায় ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর রিসাং ঝর্ণায় যাওয়ার মূল সিঁড়িপথে পৌঁছে যাবেন।
চাইলে চাঁদের গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়িপথ পর্যন্ত এই পথটা মোটর সাইকেলে করে যেতে পারেন। অত্যন্ত সরু হওয়ায় এই রাস্তায় মোটর সাইকেল ছাড়া অন্য কোনো যান চলাচল করতে পারে না। মটর সাইকেল ভাড়া ৫০ টাকা প্রতিজন। তবে ট্রেকিংয়ের আসল মজা পেতে হলে হাঁটা ছাড়া বিকল্প পন্থা নেই।
সবুজের আবাসভূমি খাগড়াছড়ি, প্রায় ২৩৫টি সিঁড়িধাপ নিচে নেমে রিসাং ঝর্ণার মূল ছড়া পথে পৌঁছে যাবেন। এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। শ্যাওলা জমে সিঁড়ি ধাপগুলো অনেক পিচ্ছিল হওয়ায় নামতে বেশ বেগ পেতে হয়। তাই ট্রেকিং শু নিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সিঁড়িপথ ধরে নেমে হালকা উপরে উঠেই পৌঁছে যাবেন অবিরাম ঝরে পড়া রিসাং ঝর্ণার ঠিক নিচে পাথুরে জায়গায়টায়।
পুরো এই দুর্গম পথটা পাড়ি দিতে দিতে আপনি সবুজের এক অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাবেন। উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলতে চলতে যে কারো চোখ আটকে যাবে সবুজের সমারোহে। আমাদের দেশটা কতটা সুন্দর, কতটা বৈচিত্র্যময় সেটা এই এক দৃশ্য থেকেই উপলব্ধি করা যায়। বর্ষাকাল, যখন ঝর্ণার যৌবনকাল চলে তখন সিঁড়িপথ দিয়ে নামার সময়ই পানি পড়ার তীব্র শব্দ কানে বাঁধে। সেই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখার পর এতটা পথের ক্লান্তি যেন নিমেষেই ভুলে যাবে মস্তিষ্ক।
রিসাং ঝর্ণায় যাওয়ার
পিচ্ছিল পাথুরে পথ মাড়িয়ে ঝর্ণার ঠিক নিচে যাওয়া যায়, যা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পাহাড়ি লতার শিকড় ধরে ধরে এগুতে হয়, না হলে নিচে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেকোনো সময়। পানির গতিপথ ঢালু হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে ওয়াটার স্লাইডিংয়ের সৃষ্টি হয়েছে, যা এই ঝর্ণার প্রধান আর্কষণ।
মূলত এই কারণেই এই ঝর্ণাটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রাকৃতিক এই ওয়াটার স্লাইড দেশের আর কোনো ঝর্ণায় আছে নাকি আমার জানা নেই। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল পাথুরে পথে স্লাইড দেয়ার অনুভূতি সত্যিই খুব রোমাঞ্চকর।
সিঁড়িপথ শেষে রিসাং ঝর্ণা হতে সৃষ্ট ছড়া;
তবে এই মূল আকর্ষণের আদতে এই ওয়াটার স্লাইডিং আসলে একটি মরণফাঁদ। অত্যন্ত পিচ্ছিল পাথুরে স্লাইডিং পথটার ঠিক পাশেই রয়েছে খাঁজকাটা পাথরের বাড়তি অংশ। আর স্লাইড দেয়ার পাথুরে পথটার নিচে রয়েছে বিশাল পাথরের বাড়তি অংশ।
অসাবধানতাবশত কিংবা অনিয়ন্ত্রিতভাবে স্লাইড করতে গিয়ে পাথরে বাড়ি লেগে মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। হয়ে যেতে পারে অপূরণীয় ক্ষতি। রিসাং ঝর্ণা নিয়ে তেমন কোনো আর্টিকেলেই এই ভয়ানক অনিশ্চয়তার উল্লেখ নেই, যা আমাকে অবাক করেছে। বর্ষাকালে এই ঝর্ণা আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করে।
সাত জনের ক্ষুদ্র দলের চারজন স্লাইড দিয়েছি। পাথুরে পথের ঘর্ষণে প্যান্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল প্রায় সবার। আর হাত পা ছিলে যাওয়া তো আছেই।
সাবধানতা অবলম্বন করার কারণে কেউ গুরুতর আহত হইনি। পরিস্থিতির কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
সত্যবলতে কি ভয় আর উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চয়তা আমার মনেও ছিল। সিঁড়িপথ
দিয়ে উঠে এসে ছাউনির মতো জায়গাটায় বসে বিশ্রাম নিতে থাকি। সেখানের দোকানে লেবুর শরবত খেতে খেতে দোকানদারের কাছ থেকে জানতে পারি, এখানে স্লাইড দিতে গিয়ে মারা গেছে দুইজন এবং নিয়মিত এখানে প্রায়ই মানুষ বিপদে পরে যায়।
তবুও কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই এই ঝর্ণাটিকে কীভাবে আরও নিরাপদ করা যায়। ঝর্ণাটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিশাল পর্যটন শিল্পের। ঝর্ণাটিকে নিরাপদ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মিনতি জানাচ্ছি।
ফিরতি পথে পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠে আসা বেশ কষ্টসাধ্য।মনের দম না থাকলে এটি দেখতে যাবেন না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।