মার্গে অনন্য সম্মান খুশী সরকার (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৯৭
বিষয় – স্মৃতি

আজো উজ্জ্বল সেই দিন

এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ছিল বাড়ি ভর্তি লোকজন। চারদিকেই বিষাদের ছায়া ছড়িয়ে আছে এখনো আনাচে-কানাচে,আর এক-একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ উঠে আসছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, আছড়ে পড়ছে মনের উপকূলে। এইমাত্র সবাই চলে গেলে প্রতিমা ঘরের এক কোণে বসে আছে এক মনে। দাওয়াই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে নিখিল। শুধুমাত্র মেয়েটা মাত্র পাঁচ বছর বয়স যার, সেই শুধু বুঝে উঠতে পারছে না ইতিমধ্যে কি ঘটে গেছে তার বাবা -মা”র জীবনে। তাই অবুঝ সেই মেয়েটি একবার মা’র কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়ায় আর একবার বাবার কাছে এসে পাশে বসে কিন্তু এমন থমথমে ভাব তাদের কিছু বলার সাহস পায় না। হঠাৎ ছুটে আসে দূর সম্পর্কের নিখিলের কাকিমা। এসেই বিমূঢ় হয়ে বুঝতে পারে না কি করবে সে? মেয়েটির অবস্থা দেখে বিপন্ন হয়ে কোলে তুলে নেয় তাকে।
“সোনা, তুমি আমার কোলে এসো, আমার কাছে থাকো মা’র মন খারাপ তো এখন মা’র কাছে যায় না সোনা,কেমন?” শৈলবালা আদর স্নেহে কপালে চুমু দিয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়।
“দেখো না ঠাম্মা মা কিছুতেই কথা বলে না, শুধু চুপ করে বসে বসে কাঁদছে। বাবাও কথা বলে না। কি হয়েছে গো ঠাম্মা?, ঔৎসুক্য চাহনিতে মেয়েটি জিজ্ঞেস করে ঠাকুমাকে। শৈলবলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিভাবে বোঝাবে সে অবোধ মেয়েকে, তাদের জীবনে কি বিপর্যয় নেমে এসেছে? মুখ থেকে সেই কথা কিছুতেই বের হতে চায় না তাই নাবালিকা সেই মেয়েকে ভোলাবার চেষ্টায় বলে, “তোমার খিদে পেয়েছে সোনা। চলো তোমাকে কিছু খেতে দেই।”
“না ঠাম্মা আমি মা’র কোলে যাবো। মা কেন বসে আছে?” কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে শৈলবালা ভাবে,নাঃ, এই মেয়েকে অন্ধকারে রাখা ঠিক নয়। এও শেষে অসুস্থ হয়ে পড়বে তাই যতটা সহজ করে বলা যায় ততটাই চেষ্টা করে বলে, তোমার একটা ছোট ভাই হয়েছিল না? আজ ও আকাশের তারা হয়ে গেছে সোনা”।
“কেন? ভাইকে আমি কোলে নিবো তো”।
হ্যাঁ নিবে তো। আবার ভাই ফিরে যখন আসবে তখন নেবে।”
“কবে আসবে গো,ঠাম্মা? কোথায় গেছে ভাই ?”
“ওই যে আকাশে তারা হয়ে জ্বলছে, এবার চলো তোমাকে খেতে দেই হ্যাঁ”
বাটিতে করে শুকনো মুড়ি চিনি দিয়ে মেখে খেতে দেয় শৈলবালা।
মেয়ে ওই মুড়িটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সবে রাত আটটা। ধীরে ধীরে শৈলবালা প্রতিমার পাশে গিয়ে বসে। বলে, এত কাঁদলে তোমার নিজের শরীর যে খারাপ হয়ে যাবে মা? যতদিন তোমার ছিল ততদিন তোমার কোল ভরে ছিল। সেতো ওইটুকু সময় নিয়েই এসেছিল। এবার নিজেকে বোঝাও।
“কি করে বোঝাবো কাকিমা? মন যে মানতে চায় না কত কষ্টের ধান আমার কত দিনের প্রতীক্ষার ফল। সব শেষ হয়ে গেল। আশালতা ছিঁড়ে গেল আমার নির্মূল হয়ে গেল, কি নিয়ে বাঁচবো আমি”
যা তোমার নয়, তাকে নিয়ে আর ভেবো না। শরীর খারাপ হয়ে গেলে মেয়েটার কি হবে বলতো? যা যাবার তা গেছে, যা আছে তাকে নিয়ে বাঁচো। ওই যে মেয়েটা, দেখো কি নিষ্পাপ চোখ দুটো? বড্ড ভয় পেয়েছে গো। তোমরা কেউ কথা বলছো না। ও ঠিক বুঝতে পারছে না কি করবে? বড্ড ভয় পেয়েছে
মেয়েটা।” ওর কাছে যাও।”
কি করে ভুলবো? ভোলা কি সম্ভব? আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেদিনটা——
দীর্ঘ নয় মাস প্রতীক্ষা। কিছুতেই শুতে পারতাম না তবুও মনের মধ্যে একটা আশা জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল প্রদীপের মত। শেষে এলো সেই শুভ দিন। যখন সিজার হল তখন আমি তো অজ্ঞান পরে শুনেছি ওর চিৎকারে বাইরে অপেক্ষায় থাকা নিখিল, আমার বাবা-মা সবাই আনন্দে আটখানা হয়ে উঠেছিল। মেয়ের পরে ছেলে দারুন খুশি সবাই। জ্ঞান ফেরার পরে আমিও সেই চাঁদপানা ছেলের মুখটা দেখে বিস্ময়াবিষ্ট। দেখলাম মাথা ভর্তি চুল, কপালটা প্রায় ঢাকা। টিয়া পাখির মত তীক্ষ্ণ নাক। টানা টানা পটল চেরা চোখ। ধবধবে দুধ সাদা রঙ। একদম মেয়ের ছাঁচে ঢালা।সমস্ত কষ্ট ভুলে গেলাম মুহূর্তেই। কর্পূরের মত উড়ে গেল আমার যত যন্ত্রণা।

বেশ চললো কয়েকদিন। বাড়ি ফিরে আসার আগের দিন আয়া মাসি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এসে বলল, “বাচ্চা ঠিকমত দুধ টানতে পারছে না, দুধের বোতলে মুখ দিলে কেমন যেন ছটফট করে। খুব ধীরগতিতে কোনোমতে পাঁচ/দশ এম.ল দুধ খায়।” আমি শুনে একটু অবাক হলাম। ভাবলাম নিজে খাওয়াই তো,দেখি কি ব্যাপার। খাওয়াতে গিয়েই দেখি হ্যাঁ, আয়া মাসির কথাই ঠিক। বাচ্চা ঠিকমতো বোতলের নিপিল টানতে পারছে না অথচ শরীরে কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। বিষয়টা আয়া মাসি নিখিলকে জানালো। শুনে সেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। ইশারায় আশ্বস্ত করলাম।

তারপরে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ধীমান পালকে দেখানো হলো। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন, “পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
খুব আনন্দে ছেলে কোলে নিয়ে সাতদিন পর ফিরে এলাম বাড়িতে। কিন্তু সেই আনন্দ যেন মুহূর্তেই উড়ে গেল। বাচ্চা খিদেই প্রচন্ড ছটফট করছে অথচ দুধ খেতে পারছে না সন্তানের এই কষ্ট, মায়ের বুকে যে কতটা বাজে তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।
হ্যাঁগো বৌমা শুনেছিলাম তো কিন্তু তারপরে না তোমরা কলকাতায় নিয়ে গেলে?
“হ্যাঁ কাকিমা।” আমরা আর অপেক্ষা করিনি। সন্তানের কষ্ট সহ্য করা মুশকিল তাই কোনো কিছু ভাবনা না ভেবে সোজা নিয়ে গেলাম কলকাতার এক নামী নার্সিংহোমে।
সেই নার্সিংহোমের নিয়ম নীতি দেখে অবাক হলাম। আমার কোল থেকে বাচ্চাকে কোলে তুলে সোজা পা দুটো উপরে তুলে মাথা নিচু করে নিয়ে গেল ঘরের ভেতর। সেই দৃশ্য দেখা যায় না—– বাইরে থেকে অন্ততঃ একবার দেখবার জন্য পাঁচিলের উপর উঠেছি। ছটফট করে ঘুরে বেরিয়েছি নার্সিংহোমের চারদিকে। ক্ষুধা তৃষ্ণা সব মাথার উপর। নার্সিংহোমের খোলা বারান্দায় শুয়ে রাত কাটিয়েছি দু’জনে তবু সান্ত্বনা ছিল আমাদের মত অনেকেই ছিল সেখানে।প্রত্যেকেই বাচ্চার কিছু না কিছু সমস্যা নিয়ে এসেছে।
প্রায় ১০ দিন পর বাচ্চাকে দেখার অনুমতি পাওয়া গেল। গেটের সামনে দূরে দাঁড়িয়ে আছি কখন একবার দেখবো, চাতকের মত চেয়ে আছি দরজার দিকে, এমন সময় একজন সিস্টার এসে বললেন, “অনির্বাণের বাড়ির লোক কে?”
মুহূর্তে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বললেন,আপনি ভিতরে আসুন। পাগলের মত ছুটে গেলাম ভেতরে। চারদিক চেয়ে দেখছি অস্থির চোখে, ঠিক তখনি কর্তব্যরত সিস্টার এসে বললেন, “এই যে আপনার বাচ্চা, আপনি এখানে বসুন।”
বসতেই বাচ্চা কোলে দিয়ে বললেন, “আপনি ওকে নিজের হাতে এই চামচ দিয়ে দুধ খাওয়ান।”
বাচ্চাকে কোলে পেয়ে যেন মনের অশান্ত ঝড় থেমে গেল মুহূর্তে। কালবৈশাখীর শেষে যখন বৃষ্টি নামে সেই বৃষ্টিতে ধরার তৃষ্ণার্ত বক্ষের জ্বালা জুড়িয়ে যেমন শীতল হয় তেমনি আমার বক্ষের জ্বালা জুড়লো পুত্রের শীতল পরশে। পরম আদরে চামচ দিয়ে দুধ খাওয়ালাম। ঈশ্বরের কি মহিমা! ছেলে চামচে তোলা দুধ গিলে ফেললো অনায়াসে। সেদিনটা তারার মতো জ্বলজ্বল করছে এখনো।
চামচে করে যতবারই তার মুখে দুধ দিয়েছি ততবারই সে খেয়েছে। আসার আগে ডাক্তারবাবু এসে বললেন, “আপনার বাচ্চা সুস্থ হয়ে গেছে। বাড়ি নিয়ে যান। আর ঠিক এইভাবেই পাঁচ ছয় মাস খাওয়াতে পারলে বাচ্চার গ্রোথ হলেই আর কোনো অসুবিধে হবে না। প্রচণ্ড আশায় উদ্বেল হয়ে ফিরে আসি বাচ্চাকে নিয়ে।
“তাহলে আবার কি হলো বৌমা? বাচ্চাকে সুস্থ করে নিয়ে আসলে তারপরে এমন কি ঘটলো যার পরিণতি এমনভাবে হয়ে গেল মর্মান্তিক?”
“হ্যাঁ, কাকীমা ঠিকই বলেছেন। সুস্থ করেই তো নিয়ে এসেছিলাম। কয়েকদিন যেতে না যেতেই একই সমস্যা আবার দেখা দিল। প্রচণ্ড কষ্ট তার দুধ খেতে।
ক্ষিধে পেলে ছটফট করে অথচ খাওয়াতে গেলেই হাত পা এমনভাবে ছোড়াছোড়ি করে যে সে কষ্ট আর সহ্য করা যায় না।”
“তারপরেই কি ভেলোর গেলে তোমরা?”
না, সেই মুহূর্তে যাওয়া সম্ভব হয়নি কাকিমা,কারণ সেই মুহূর্তে হাতে যা পয়সা ছিল সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই টাকা জোগাড় করতে প্রায় ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো।
“মা, ও মা”ঘুম ভেঙে যেতেই উঠে বসে ডাকতে থাকে মেয়ে। মেয়ের কান্না ভেজা ডাকে প্রতিমা ধীর পায়ে হেঁটে এসে মেয়েকে কোলে নেয়। ততক্ষণে নিখিল‌ও
কপালে হাত রেখে শুয়ে থাকে বারান্দায়। গোটা বাড়িতে তিন চারটি প্রাণী মাত্র। নিস্তব্ধ নির্জন চারদিক। কাকিমা আর অপেক্ষা না করে বলে, যা হবার তো হয়েই গেল, এখন একটু কিছু তোমরা মুখে দাও বৌমা। আমারও তো বয়স হয়েছে, বেশি রাত আর জাগতে পারি না। তোমাদেরও একটু শুকনো কিছু খাবার দিই। চিড়ে মুড়ি যাইহোক যদি থাকে আমিও একটু খাই,অনেক রাত হল। একটু তুইও কিছু খেয়ে নে বাবা। দেখ্,আমিও তো অতদূর থেকে এসেছি শরীরটা বড় খারাপ। আমিও সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়বো তোরাও একটু খেয়ে নে।”
“আজ আর গলা দিয়ে কিছু নামবে না কাকিমা।”

নিখিল‌ও হয়তো কিছু খেতে পারবে না আজ। নিজের হাতে ছেলেটার শেষ কাজ করে আসলো—- কি করে সম্ভব বলতে বলতেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ে প্রতিমার। আপন মনেই বলতে থাকে আবার, “খুব কষ্ট করেছে এই ছয় মাস ধরে। দীর্ঘ ছয় মাস লড়াই শেষ হয়ে গেল আজ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে শৈলবালার দিকে তাকিয়ে বলে প্রতিমা, “কাকিমা, আপনি কিছু খেয়ে নিন। কালকে দেখা যাবে।

খুব সকালে উঠে পড়ে নিখিল। উসকো খুসকো চুল, কোটরে চোখ, উদাসীন ভাবে চেয়ে আছে ঘরের কোণে জমে থাকা ওষুধের শিশিগুলোর দিকে, বিড়বিড় করে বলে, কত ওষুধ! ওষুধ কিনতে কিনতে এমন হল শেষে আর পয়সা নেই কিন্তু ওষুধ না কিনে কি থাকতে পারি! ছেলে আমার ছটফট করছে ক্ষুধায়,দুধ না খেতে পারলেও তাকে তো ওষুধ খাইয়েই বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
“ওরে নিখিল আপন মনে বকতে বকতে পাগল হয়ে যাবি তো বাবা, একটু শান্ত হ’। কি করবি ভাগ্যে যা ছিল হলো। এখন একটু মেয়েটার কথা ভাব না বাবা।”
“কি করে ভাববো কাকিমা, ভাবতে যে আর কিছু পারছি না। তুমি তো জানো না, কি ভয়ংকর দুর্বিসহ দিন আমরা কাটিয়ে এসেছি ভেলোরে।
জানো, হঠাৎ একদিন কেবিনে গিয়ে প্রতিমা আর ছেলেকে খুঁজে পাই না। কি হলো ভেবে পাচ্ছি না ওরা কোথায় গেল! আগের দিন সন্ধ্যায় ওদের সঙ্গে দেখা করে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলাম ভাড়া বাসায়।আর সকালে গিয়ে দেখি সেই বেডে অন্য বাচ্চা আর মা বসে আছে, আমার ছেলে বউ নেই? তুমি বুঝতে পারছো তখন মনের অবস্থা কেমন হয়! তখন দৌড়তে দৌড়তে গেলাম অফিস ঘরে। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করি, আটান্ন নম্বর কেবিনের দু’শ চার নম্বর সিটের পেশেন্ট কোথায়?”
ঠিক সেই সময় এক মাত্র বাঙালি ডাক্তার সবে ঘরে ঢুকেছেন, আমার কথা শুনে উনি আমাকে বাংলায় বললেন, “আপনার পেশেন্ট মানে বাচ্চার নিউমোনিয়া হয়েছে, তাকে আমরা তিন তলায় শিফট করেছি। আপনি সেখানে পঁচিশ নম্বর কেবিনের ১০১ নং বেডে তাদের পাবেন।”
মুহূর্ত অপেক্ষা না করে আবার দৌড়ে গেলাম লিফটের সামনে গিয়ে দেখি লিফ্ট তখন উপরে উঠেছে। আর অপেক্ষা নয়, এইবার সিঁড়ি দিয়েই উঠতে লাগলাম তিনতলায়। তারপর যখন খোঁজাখুঁজি করে ওদের কাছে পৌঁছালাম তখনই দেখছি ছেলের ব্লাড নিচ্ছে। ভয়ংকর কষ্ট। দিনের পর দিন না খেয়ে শরীর শীর্ণ হয়ে মিশে যাচ্ছে শয্যায় অন্যদিকে দিনের পর দিন নেওয়া চলছে ব্লাড। যতোটুকু রক্ত তৈরি হচ্ছে,তার চেয়ে যেন নেওয়া হচ্ছে বেশি।
তবুও মুখ বুজে সব কষ্ট সয়ে যাচ্ছিলাম শুধু একটি আশায়, যদি একবার ছেলেকে সুস্থ করে নিয়ে ফিরতে পারি।কিন্তু তার হলো না”—–!
“কেন দেখতে পারতিস শেষ অবধি” শৈলবালা সহমর্মিতার সুরে নিখিলকে বলে।
মেয়েকে কোলে নিয়ে বাইরে আসতে আসতে প্রতিমা বলে, না কাকিমা, তা হতো না”
কেন শেষটা তো দেখতে পারতে তোমরা। আসলে কাকিমা ওদের আমার ডাক্তার‌ই মনে হয়নি। হ্যাঁ ব্যবহার ভালো, খুব চেষ্টা করেছে কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে ওই ব্লাড নেওয়া, কারেন্টে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হার্ট স্পিড দেখা— সব বিষয়গুলোতেই যেন মনে হতো ওরা ডাক্তার নয় রাক্ষস। যখনই দেখতাম ওরা আমার ছেলের দিকে এগিয়ে আসছে, মনে হতো এই বোধহয় গিলে খাবে আমার ছেলেকে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠতাম কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না। আর যখনই ছেলেটা একটু ঘুমতো তখনই জুনিয়ার ডাক্তাররা এসে এমন উল্টে পাল্টে তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত যেন মনে হতো আজব কোনো জন্তু তারা এই প্রথম দেখছে। বাচ্চার সুস্থতার থেকে অসুস্থতার কারণ তারা নির্ণয় করতেই ব্যস্ত ছিল। তাই আর শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলাম না। মুহূর্তে অধৈর্য হয়ে নিখিলকে বললাম, চলো আর নয়, যা হবে নিজের বাড়িতেই হবে।”
ঠিক সেভাবেই টিকিট কাটল। ভালোভাবেই ফিরে এলাম বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু বারবার তার নিঃশ্বাসে প্রবল বিঘ্ন ঘটতে লাগলো। বারবার নার্সিংহোমে নিয়ে গেলাম। শেষের দিন যখন পূরবী নার্সিংহোম থেকে বাড়ি নিয়ে এলাম সন্ধ্যায় সেদিন রাতের আর মাসি পাওয়া গেল না। ভয়ে আতঙ্কে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলাম, “ঠাকুর, এই কষ্ট থেকে তুমি আমার ছেলেকে রক্ষা করো। আর এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। নাকে নল ঢোকানো। সেই নল দিয়ে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। বেশ কয়েকদিন ধরে কষ্টে ছেলেটা প্রায় আধমরা হয়ে গেছে। সেই দিন রাতে দুধ খাওয়াতে নিয়ে দুধ ঢুকে গেল শ্বাসনালীতে।প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আয়ামাসিকে ডাকতে যেতে বললাম নিখিলকে। কিন্তু মাসি আসতে হয়ে গেল অনেক দেরি। ছেলেকে কোলে নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে আছি। আমার চোখের সামনেই ছেলের নিঃশ্বাস থেমে গেল। নিষ্প্রাণ নিথর সন্তান কোলে নিয়ে মাসির অপেক্ষায়, তখনো মনের মধ্যে সেই অবিশ্বাসী আশা নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে যদি ফিরে আসে আর একবার—–উৎকণ্ঠা আর সমবেদনায় সেই প্রত্যুষেই বাড়িতে লোকের ভিড়েও নৈশব্দের পাহাড় জমে উঠছে একটু একটু করে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।