• Uncategorized
  • 0

মার্গে অনন্য সম্মান খুশী সরকার (সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৪৯
বিষয় – কাঁচের ঘর / নৌকাডুবি

আত্মিক বন্ধন

মিঠুর খবরটা শুনে অনিতার মনটা খুব খারাপ। আজ আর টিভি দেখতে ভালো লাগছিলো না। অনিও পাশের ঘরে মুখ গুজে রয়েছে কম্পিউটারে। কেমন যেন হৃদয়ের ভিতর উদাস একটা ভাব অনিতার। একা ঘরে থাকতে কিছুতেই ভালো লাগছিল না তার।মিঠুর খবরটা অনিকে না দেয়া পর্যন্ত তার মনটা উসখুস করছিল,তাই বাধ্য হয়েই অনির কাছে গেল। খুব সহজভাবেই বললো, কি গো তুমি কি মুখ গুঁজে এভাবেই পড়ে থাকবে?
অনি মানে অনির্বাণ বসু কম্পিউটারের স্ক্রিনে মুখ রেখেই জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?
—- আরে সব সময শুধু একা একা কাজকর্ম নিয়ে থাকা যায় নাকি? মেয়েটাও তো পড়াশোনা নিয়েই থাকে, কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করলে কার সঙ্গে বলবো বলো তো? একটু তো কথাবার্তা বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু তোমার তো কম্পিউটার থেকে মুখ সরেই না। সারাক্ষণ ওই এক কাজ, কোনো দিকেই তাল নেই তোমার।
—-কি বলবে বলো না, আমি শুনছি তো।
— ওই যে আমাদের মিঠু গো, আমার সেই বান্ধবীটা, ওদের গতকাল নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে।
—ও–তাই। হবেই তো যদি আত্মিক বন্ধন না থাকে তাহলে কি বিয়ে টিকে বলো?
—- অবশ্যই, শুধু সাতপাক ঘুরে বিয়ে হলেই কি বিয়ে বলে, বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য দুজনের মধ্যে একটা শক্ত বাঁধন চায়, যেটা সব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও অটুট থাকবে। আজকাল তো দেখি প্রায়শই বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে কিন্তু এর জন্য দায়ী শুধু মেয়েরাই নয়, ছেলেটার‌ও অনেক দায়িত্ব আছে বৈকি।
—- সত্যি খুব দুঃখের। একটা বাচ্চা হওয়া সত্ত্বেও যদি এইভাবে বিয়ে ভেঙে যায় তাহলে বাচ্চাটার খুব কষ্ট। এসব ঘটনা শুনলে খুব খারাপ লাগে।
—- কোনো মেয়েই চায় না তার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হোক। নিশ্চয়ই মিঠু চেষ্টা করেছে। শুনেছিলাম স্বামীটা বড্ড কুঁড়ে, কাজকর্ম তো করেই না, উল্টে বদ অভ্যাস আছে। মাঝেমধ্যে নেশা-টেশা করে,এটা হয়তো মিঠু মানিয়ে নিতে পারে
নি। এই যে তুমিও তো একই গোত্রের। দিনরাত এক কম্পিউটার নিয়ে মেতে থাকো।মেয়ের পড়াশোনা হল কি হল না,আমাকে একটু হেল্প করা দরকার কি দরকার না, কোনো দিকে নজর রাখো না। একটা মানুষ কি একা হাতে সব করতে পারে? একটু বিবেচনা করে বলো না?
— এখন আমাকে নিয়ে পড়লে, তোমার কোনো কাজ নেই আর, একটু রাগান্বিত স্বরে বলে অনি।
— আরে তোমাদের মত পুরুষদের জন্যই তো সংসারে ভাঙন ধরে, সব দায়িত্ব বউয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা ঠিক আরামে সুখ ভোগ করতে ভালোবাসো। চিরদিন কি স‌ওয়া যায়?রাগ তো হয়‌ই। আমারও তো রাগ হচ্ছে ভীষণ।
—আসলে মিঠু নয়, আমাকেই তুমি কথা শোনাবে সেই জন্যই তো এই ঘরে এসেছো।
— দেখলে তো, আঁতে ঘা লেগে গেল। অথচ বিবেক দিয়ে একটু বুঝবার চেষ্টা করো না। সম্পর্ক বা বন্ধন একা একা কি টিকিয়ে রাখা যায়?আত্মিক বাঁধন তৈরি করতে হলে দুজনকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিশেষ করে সংসারের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনের পরিপূরক। সুখের এবং শান্তির সংসার গড়তে হলে দু’জনকেই দুজনে বুঝতে হয় কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ পরিবারেই দেখা যায় ছেলেরা স্ত্রীর উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজের চাকরি বা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সংসারের অন্যান্য বিষয়ে কোনো দায়িত্ব পালন করতে চায় না। অন্যদিকে স্ত্রী ঘরের-বাইরের সব দায়িত্ব পালন করতে করতে একসময় ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে। দুঃখে ক্ষোভে পেতে চায় মুক্তি ফলে সম্পর্কে ধরে ফাটল। আর এই ফাটলের সম্পূর্ণ দোষ চাপানো হয় স্ত্রীর উপর।
—-আমি তোমাকে কোনো দোষ চাপিয়েছি? রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে অনি।
—-না মুখে কিছু বলোনি কিন্তু হাবভাব দেখে তা-ই মনে হয়। আমিও যদি মিঠুর মতো—–
—-কি বলছো আজে বাজে? পাগল হয়ে গেছো নাকি?
—–তোমার মনে হচ্ছে পাগল, হতেই পারে কিন্তু আমি চিন্তা করেই বলছি। তাহলে মেয়েটার কী হবে একবার ভেবে দেখেছো?
—না,আমার ভাববার দরকার নেই। চিৎকার করে ওঠে অনি।
—জানি চিৎকার করে ঘর ভরাবে তবু নিজেকে বদলাবে না।
—আমাকে কি করতে বলছো?
—নাও, কম্পিউটার বন্ধ করলাম।
— সত্যি কথা শুনবার ক্ষমতা লাগে,বুঝলে?এই যে সংসারের যাবতীয় কাজ রান্না থেকে শুরু করে সমস্ত—-নিজের চাকরি, মেয়েকে পড়াশোনায় সাহায্য করা একজনের পক্ষে কি সম্ভব?
—–কাজের লোক রেখে নাও।
—টাকা আসবে কোথা থেকে?
—-সংসার থেকে, আবার কোথা থেকে?
—এমনিতেই সংসারে টানাটানি, তার উপর লোক রেখে আরো খরচ বাড়াবো, তাই না? অথচ তুমি ঘরে বসে থেকে কিচ্ছু করবে না,এটাই তোমার শেষ কথা।
অনিতার কথা শুনে অনির্বাণের প্রচণ্ড রাগ হয়। গুম হয়ে বসে থাকে একা চেয়ারে। অনিতাও রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মনে মনে ভাবে, এই রাগটাই তোমার গত দশবছর ধরে দেখে আসছি। আর মেনে নেয়া সম্ভব নয়। একজন আরেকজনকে যদি না বোঝে তাহলে আন্তরিক বন্ধন কোথা থেকে তৈরি হবে?
মেয়ে ঘুমিয়ে ছিল ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে।
মেয়ের নিষ্পাপ মুখটা দেখে অনিতার মন বদলে যায়। মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে ভাবে, আমি মিঠুর মতো হতে পারবো না, আমার পক্ষে এ বাঁধন ছেঁড়া সম্ভব নয়। সে যা-ই হোক, যত কষ্টই হোক, এতদিনের এত টান ছেঁড়া কিছুতেই সম্ভব নয় কিন্তু হাবভাবে সেই রাগ বজায় রেখে মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। পরক্ষণেই তার রাগ পড়ে যায়। ভাবে অনি কি না খেয়ে শুয়ে পড়লো? কেমন যেন অনির জন্য মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আর শুয়ে থাকতে পারলো না। উঠে এলো অনির ঘরে, দেখে অনি না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। খেতে ওঠবার জন্য অনেকবার ডাকলো কিন্তু অনি কিছুতেই সাড়া দিল না। শেষে নিজে রাগ করে আবার এসে শুয়ে পড়লো কিন্তু না, চোখে তো ঘুম আসে না। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে অনিতার।আবার উঠে গেল। ‘কই গো,ওঠো’ খেতে হবে তো, আদরমাখা স্বরে ডাকতে লাগলো অনিতা। কোনো কথা বলল না অনি। নিজের ঘরে গেল অনিতা। রাত যত বাড়ে তার মনে তত কষ্ট হতে থাকে। ভাবে এমন করে না বললেই পারতাম, না খেয়ে শুয়ে রইলো। কিন্তু অনি তো একদণ্ড না খেয়ে থাকতে পারে না।
আবার না খেয়ে থাকলে ওর রাগটা আরো বেশি বেড়ে যায় তাই অনিতা নিজের দুঃখ নিজেই চেপে আবার যায় অনির ঘরে। যে কোনোভাবে তাকে খাওয়াতে হবেই, মনে করে অনিতা। আবার যায় অনির ঘরে গিয়েই তার চক্ষু চড়কগাছ। অনি তো বিছানায় নেই, কোথায় গেল? বুকটা ধড়াস্ করে উঠল অনিতার। কি করবে এখন? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর এ-ঘর, ও-ঘর সে-ঘর খোঁজাখুঁজি করে কিন্তু অনিকে খুঁজে পায় না। দৌড়ে যায় ছাদে,ভাবে, অনেক সময় রাগ হলে অনি ছাদে যায় কিন্তু আজ অনি ছাদে যায়নি। তবে গেল কোথায়? বড্ড চিন্তায় পড়ে গেল অনিতা। অজানা ভয়ে কাঁপতে লাগল সে। এদিকে মেয়ে ঘুমাচ্ছে, পাড়া-প্রতিবেশী ততক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এক মুহূর্তে অনুভব করে অনিতা, বড্ড ফাঁকা লাগছে মনটা তার, শরীর যেন হাল্কা হয়ে গেছে, একটা শীতল রক্তের হিমবাহ যেন শরীরের শিরা উপশিরা ধমনী বেয়ে পা দিয়ে নীচে নেমে আসছে।পা টলছে তার। হঠাৎ মনে পড়লো যদি বাথরুমে গিয়ে থাকে।ওই অবস্থায় ছুটে গিয়ে বাথরুম দেখল, না সেখানেও নেই অনি। এই প্রথম সে নিজের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলো, সে মুখে যা-ই বলুক না কেন, অনিকে সে খুব ভালোবাসে। অনি ছাড়া তার জীবন অস্তিত্বহীন। এটা সে আজ প্রথম বুঝতে পারল এবং এই ভালোবাসা এতটাই গভীর যে অনি ছাড়া গোটা জগৎ যেন ফাঁকা। মনে হচ্ছে তার সব অন্ধকার ,কেউ নেই তার এই জগতে,বড়ো অসহায় একা। সঙ্গে সঙ্গে অনিতা নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা করে যে, এবার যদি অনিকে সে খুঁজে পায়, আর কখনো তাকে ব্যথা দিবে না, দুঃখ দেবে না, ভালো-মন্দ যা-ই হোক, অনিকে সে ভালোবাসে এবং এই ভালোবাসা তার নিখুঁত, তার প্রমাণ সে আজ‌ই পাচ্ছে। হঠাৎ কাগজের খসখসানি একটা আওয়াজ তার কানে এলো। কান খাড়া করে বুঝতে চাইল আওয়াজটা কোন্ দিক থেকে এবং কোথা থেকে আসছে? মুহূর্তেই বুঝতে পারল অন্ধকার বেলকনির কোণা থেকে সেই আওয়াজ। দৌড়ে গেল সেই অন্ধকার জায়গায়। গিয়ে দেখে অনি দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে। বড় কষ্ট হলো অনিতার। তার পাশে গিয়ে হাত ধরে নিয়ে এলো ঘরে, নিজ হাতে চোখের জল মুছিয়ে আদর করে বলল, আর কখনো ব্যথা দিব না তোমায়, খুব কষ্ট পেলাম। এবার তো খেয়ে নাও। না খেলে তোমার তো ঘুম আসবে না। অনিতার কথা শুনে জাপটে ধরে অনি অনিতাকে। দুজনেই হাপুস নয়নে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর বর্ষার বাদল মেঘের মতো দুঃখের ভার যেন গলে জল হয়ে ঝরছে শ্রাবন ধারায়। তারপর অত রাতে অনিকে খেতে দিয়ে পাশে বসে রইল অনিতা। আর মনে মনে ভাবতে লাগল, হয়তো এটাই তাদের আত্মিক বন্ধন। এই বন্ধনেই হয়তো শত কষ্টেও কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারে না আর তাদের এই আত্মিক বন্ধনের ফল তাদের একমাত্র মেয়ে শিউলি, ভোরের শিশির সিক্ত শিউলি ফুলের মত নরম। অনির খাওয়া হলে অনিতা তাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে যায়, বলে আজ আর ও-ঘরে শুতে হবে না তোমায়। এই ঘরে একসঙ্গে আমরা থাকবো আজ। ততক্ষনে প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে,জেগেছে দুই একজন মানুষ। স্নিগ্ধ রবির আলো ছড়িয়ে পড়ছে সারা জগতে।শান্তিময় শান্ত ভোরে জানালায় মুখ রেখে তাকিয়ে থাকে অনিতা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।