রুম দুটো | একটা বন্ধ | দরজায় গোদরেজ কোম্পানির বড়ো চৌকো তালা | বন্ধ দরজার সামনেই একটা ফুট তিনেকের লোহার আলমারি | ঘন নেট দেওয়া পাল্লা | নেটের ওপরে ঊর্ণনাভের তাণ্ডব দেখে যে কেউ বলবে, এ ঘরে জিনিসের যত্ন নেই | নামেই রতন | মায়ের হাতে সাজানো তকতকে ঘর দেখে অভ্যস্থ চোখে এই ছন্নছাড়া রূপ অসহনীয় হয়ে উঠেছে এই দু’চার ঘন্টাতেই | গায়েব গৃহকর্তা | বিকেল ঢুলছে সন্ধের ঝুলে রাতের গায়ে | বেরিয়ে যে চায়ের দোকানে যাবো, তারও উপায় নেই | সুইচ বোর্ডের সুইচ টিপতে চতুর্থটায় জ্বলে উঠলো বাল্ব | ভোল্টেজ কম নাকি ওয়াট ! যেটাই হোক, এর থেকে লম্পো ভালো | সামনের দরজার তালা-চাবি দেখলাম না, হয়তো নেই ই | সবই সম্ভব এই নেই-রাজ্যে | চোখ পড়লো খাটের নিচে, ধক্ করে উঠলো বুক ! নেই ! গেল কোথায় ? এখানেই তো রেখেছিলাম ! নিশ্চয়ই ওর কাজ ! দুপুরের ঘুমের ফাঁকে হয়তো খুলেও দেখেছে ! অজানা মূল্যবান হয়তো কিছু দেখে, সরিয়ে দেওয়ার তাল করেছে ! অভ্যাস তো জানা নেই ! এবার আফশোস হওয়া শুরু হলো- কেন খুলে দেখলাম না ! এখন যদি বলে, ওতে কিছুই ছিল না, কিংবা হ্যানো-ত্যানো, মেনে নিতে হবে | নিতেই হবে, আমি তো জানিই না সত্যিই কী ছিল, কাজেই,না মেনে উপায় কী ? না, আরেকটা কাজ হতে পারে, ও তো আর জানে না যে, ওতে কী আছে সেটা আমার অজানা! তাহলে, তাহলে, না, ধরা দেওয়া যাবে না, এমন কিছু বলা যাবে না যাতে এটা প্রকাশ পায় যে, ভেতরের বস্তু সম্পর্কে আমি অনভিজ্ঞ | অ্যাটাচির কথা তুলতে সাবধান হতে হবে | মহার্ঘ বস্তু মানবকে যে কোন সময় পশুতে বদলে ফ্যালে, এ আমি খুব কাছ থেকে জানি, ওকেও বানিয়ে ফেলতে পারে তেমনটা হলে | সাবধানে থাকতে হবে,খুব সাবধানে |
পিঠে ছোঁয়া পেলাম | উবু হয়ে বসে ভেবে নিচ্ছিলাম পরপর অ্যাতো কিছু | পরশ পেয়ে ফিরলাম ত্বরিতে, কেঁপেও গেলাম কি ? বিপরিত প্রতিক্রিয়া স্পর্শানুভূতিতে ভালো বোঝা যায় | রতন’দা | মিঠে হাসছে |
‘অ্যাটাচি ? সরিয়ে রেখেছি | ওসব সামনে রাখে ? দাঁড়া, দরজাটা ভেজাই |’
দরজাটা ভেজিয়ে এসে বসলো খাটের ওপর | কাছেই মেঝের ওপর আমি, উবু ভেঙে বাবু হয়ে বসে পড়েছি | এখন কিছু বলার নেই,শুধু শোনা | ভাবনারা কাজ করছে তীব্রগতি’তে | পায়ের কাফ মাসল কাঁপছে তিরতির করে |
‘অ্যাতো টাকা,হিরে – কোথায় পেলি ? ডাকাতি করেছিস নাকি ? অ্যাটাচির ভেতরে দেখলাম এস.এস. স্টিকার ? কে এটা ?’
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম | সত্যের সামনে দাঁড়াতে পারে কেবল সত্য-ই | সবটা বললাম, নির্ঝর থেকে আজ দুপুরের ঘুম, সবটা | কথা শেষ হলো | শব্দের হত্যা করে একটানা ঝিঁঝি’র ডাক | দূরে সারমেয়র অস্তিত্ব | ঘরে শুধু ঢেউয়ে নিশ্বাস | ক’টা বাজে ? খিদে পাচ্ছে একটু একটু | রতন’দা উঠে বাইরে গেল | একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে শুনেছে ফরিরের রাজা হওয়া | জানি না, কী হতে চলেছে, তবু বিশ্বাস হলো, যা হবে, সেটা ভালো হবে | রতন সত্যিই রতন |
ফিরে এসে বললো, ‘চল, চা খেয়ে আসি | ওখান থেকে একটা হাজার টাকা খুচরো করে এনেছি | অনেকটা যেতে হলো, সেই মুখুজ্জের দোকানে | তাই দেরি হলো |’
চা খেতে খেতে ফিসফিসালাম, ‘মাছ নিলে হতো না একটু ?’ হাসলো কথাটা শুনে, ‘বড্ডো বাচ্চা তুই! ওঠ, মাঠে বসবো | চাঁদ উঠেছে,দেখেছিস ?’
নবারুণ সঙ্ঘের মাঠ | জায়গায় জায়গায় চার পাঁচের জটলা | ক্লাবঘরের পাশে, রাস্তার কোল ঘেঁসে একটা দু’শো ওয়াটের বাল্ব, যদিও এখন সেটা অদরকারী | মাথার ওপর রূপোলী আলোর সামিয়ানা, সাথে অ্যাতো সম্পদ, রতনের মতো একটা মানুষ- সব ভুলিয়ে দিয়েছে আমায় | না, ভোলায়নি, তবে, গুরুত্ত্বহীন করেছে, কই, অন্ধকার বলে তো সামনে কিছুই নজরে পড়ছে না! এটাই কি প্রয়োজন ছিল ? সম্পদ ? লহমায় বদলে যায় দৃশ্যপট যার কাঠির হেলনে ?
‘পুরুষস্য ভাগ্যম ! কী ভয়ঙ্কর বাস্তব কথাটা!’- বসতে বসতে বললাম | ‘একদম্ ঠিক! আমিও সেটাই ভাবছি বারবার | তুই ভাবতেও পারবি না ওখানে কতো টাকার সম্পত্তি আছে! যদি খুব ভুল না করি তাহলে সবকিছু মিলিয়ে অঙ্কটা কুড়ি লাখে দাঁড়াবে |’ ভীষণ নিচু স্বর দাদার |
‘বলো কী!’
‘আস্তে !’ দাঁতে চেপে বললো, – ‘একটা বোকামো একটানে আবার রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেবে সেটা বুঝতে পারছো না ? আমার নগদে ডিম কেনার ক্ষ্যামতা নেই, মাছ কিনে বাড়ি ফিরলে, চোখ ট্যাঁরাতে কতক্ষণ ? এটা তোমার গ্রাম নয় ! ধুরন্ধর, ছাঁটা মাল ছাড়া,এ শহরে ভাতের হদিস পাওয়াও এক নির্মম স্বপ্ন | পলকে ছিঁবড়ে করে গঙ্গায় ফেলে দেবে, সোজ্জা বঙ্গোপসাগরে ভুস্ করে ঠেলে উঠবে, বুঝেছো চাঁদু ?’
‘অতঃ কিম ?’
‘ভাবছি, ভেবে চলেছি দুপুর থেকে | যা বুঝলাম, তাতে এখুনি ঝিলিকদানাগুলোর কোনো উপায় করা যাবে না | রইল ক্যাশ, তার, একটা উপায় বের করেছি আমি | ইদানিং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি শুরু হয়েছে | ধর, তুই যদি লটারিতে দু’লাখ টাকা পেয়ে যাস,তবে তো কারো কিছু বলার থাকবে না | তারপর হয়তো তুই বাড়ি যেতে পারবি, ততদিনে ওখানটাও একটু থিতিয়ে যাবে! এটাও করতে হবে মাস খানেক পর, এখন তুই চাকরি করতে যাবি | প্রতিদিন সকালে ফুলবাবুটি সেজে অফিস বেরোবি | আসবি সময় মিলিয়ে |’
‘কিন্তু, কোথায় যাবো আমি ? এ শহরে তো কিছুই চিনি না! শুধু সুবলের সাথে একবেলা এসেছিলাম তোমার এখানে, তাও রামের দোকানটা মনে ছিল বলে পৌঁছে গেছি, আমার তো তোমার বাড়িও মনে ছিল না |’
‘কাল সকালে আমি নিয়ে বেরোব তোকে | অতো ভাবতে হবে না | যা বলার আমিই বলবো, তুই মুখটা শুধু এখন বন্ধ রাখবি,বাকিটা ছাড় আমার ওপর |’
ফেরার পথে রাম’দার ওখানে ইচ্ছাকৃত বসা হলো | আরও দু’কাপ চা চাইলো রতন’দা | জানিয়ে দিলো, ওর এখানে থেকেই সদ্য পাওয়া চাকরিটা আমি করবো | চাকরি শুনে চায়ে দুধটা একটু বেশিই পড়ে গেল |
‘একটা সত্যি কথা বলবি ?’ আবছা অন্ধকারে রতন’দার গুঞ্জন |
‘ কী ?’
‘তুই আমায় চোর ভাবছিলি, তাই না ?’
‘স্বাভাবিক নয় কি ? আমার জায়গায় তুমি হলে ভাবতে না ?’
‘ যে কেউই ভাববে | তবে, বর্তমানের আমিটা হয়তো ভাবতো না | ওটা অনেকটাই জয় করে ফেলেছি আমি |’
****