মার্গে অনন্য সম্মান খুশী সরকার (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার     

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৫৬
বিষয় – প্রাক শারদীয়া / ভালোবাসার বিভীষিকা / ভালো থাকার গল্প

ভালো আছি

নিয়তির শরীরটা যেন আরো বেশি একটু খারাপ আজ। জানালার ফাঁক গলে রোদ এসে পড়েছে তার বিছানায়। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে পাখির ডাক। লোকজনের যাতায়াতের আওয়াজ‌ও আসছে পাশের গলি থেকে। নিয়তি মুখ ঘুরিয়ে দেখে খাটের ওপাশে নির্মল‌ও শুয়ে আছে। শুয়ে শুয়েই নিয়তি ভাবছে, ওর শরীরটার সঙ্গে মনটাও যেন দিন দিন ভেঙে যাচ্ছে নদীর পাড়ের মতো। বাড়িময় নিস্তব্ধতায় যেন দুটি প্রাণী নেহাতই দূর আকাশের তারার মত মিটমিট করে জ্বলছে। এত বড় আকাশটা থেকে কখন কোন্ তারা খসে পড়ে কে জানে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিয়তি কোনোমতে টেনে তুলে দেহটাকে বিছানা থেকে। উঠে বসে থাকে গুম্ হয়ে।মনে মনে ভাবে, কি হবে তাড়াতাড়ি উঠে ? কার জন্য উঠবে সে আর ? এতদিন যার জন্য জীবনটা ছিল খুশিতে ভরা, সেই তো আজ——-হু হু করে কেঁদে ওঠে নিয়তি। ওপাশ থেকে নির্মলবাবু নিয়তিকে বলে, আর কত কাঁদবে বলো তো ? তুমি এভাবে কাঁদলে আমার কি ভালো লাগে ? আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় নিয়তি জানাই, কি করবো বলো? কান্নাই তো এখন আমার ভাগ্য।
‘তবুও একটু সামলাও নিজেকে’ ভেজা গলায় সান্তনা দেয় নির্মলবাবু।
‘আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না গো। আমাকে নিয়ে ছেলেটাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতেন ঈশ্বর ! কিন্তু হায় পোড়া কপাল এমন নিষ্ঠুর ভগবান, আমাকে রেখে ছেলেটাকেই নিয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিয়তি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে উদাসীন ভাবে। তখন ধীরে ধীরে নির্মলবাবু বিছানা থেকে নিয়তিকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। ‘একটু চা বানাও’, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি,বলেই চলে গেলেন নির্মলবাবু। ধীরে ধীরে নিয়তি রান্নাঘরে গেল চা বানাতে। দুইকাপ চা হাতে নিয়ে এসে রাখলো টেবিলে। নির্মলবাবুও এসে বসলো চেয়ারে। দু’জনে চা খেতে খেতে নির্মলবাবুর দিকে তাকিয়ে নিয়তি বলে, এভাবে কি আর বাঁচা যায় বলো?এ যে বড়ই দুর্বিষহ। কত আশা কত ভরসা করেছিলাম ছেলেটার উপর।নির্মলবাবুও বলে, ভাবলাম এই অবসরকালীন জীবনে ঘরে বৌমা থাকবে, নাতি নাতনি থাকবে, বড় সুখের হবে শেষ জীবনটা। চাকুরী জীবন তো নানা চিন্তা ভাবনাতেই কেটে গেল কিন্তু বুঝলে নিয়তি, মানুষ চায় এক,হয় আর। হয়তো বিধাতা আমাদের কপালে সুখই লেখেনি
সেজন্যই তো আমাদের এই সদ্য চাকরি পাওয়া ছেলেটাকে অকালেই চলে যেতে হলো। বিষন্ন মনে কথাগুলো বলতে বলতে নির্মলবাবু থেমে গেল হঠাৎ। নিয়তি তখন উদাসভাবে বলতে থাকে, কত সুন্দর আমার ছেলে! কী মেধা ! তার ব্যবহার সম্পর্কে কেউ কোনোদিন কোনো খারাপ মন্তব্য করেনি। সামান্য একটু জ্বর হলো ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে এসে। আজকাল কতজন শিক্ষক এভাবে স্কুল বন্ধ থাকলেও পড়ুয়াদের পড়ানোর দায়িত্ব কাঁধে নেয়? নির্মলবাবু নিয়তির দিকে চেয়ে বলে,আসলে বুঝলে না, ও ছিল ছাত্র দরদী শিক্ষক। ভীষণ ভালোবাসতো ছেলেমেয়েদের। ওটাই ছিল ওর আনন্দের জীবন। তা না হলে এই করোনাকালে ও নিজের জীবন উপেক্ষা করে কেউ যায় পড়াতে ওই প্রত্যন্ত গ্রামে?আর এমনি ভাগ্যের পরিহাস বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্মলবাবু বলে, সেই পড়াতে গিয়েই ছেলে আমার করোনায় আক্রান্ত হলো।
‘মাত্র চার দিনের ব্যবধান! তারপর সবশেষ’– বলতে বলতে আবার নিয়তির চোখে জল। পরক্ষণেই নির্মলবাবু বলে উঠলেন, আমি তো চেষ্টা করেছি, বলো? যখন দেখলাম, ছেলের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হল। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু হাসপাতালেও উত্তরোত্তর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তারবাবুরা আই সি ইউতে নিয়ে গেছেন। ‘ছেলে আমার লড়াই করছে গো, খুব লড়াই করেছে’ ——বলেই কেঁদে ফেললেন নিয়তি।
‘সব শেষ হয়ে গেল’ অস্ফুটে বলেই মর্মাহত নির্মলবাবু কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নিজের চোখের জল সম্বরণ করে বলে, যতদিন বাঁচবো ততদিন বেঁচে থাকবে ও এভাবেই আমাদের সঙ্গে।
কিছুক্ষণ দু’জনেই।নীরব। তারপর নীরবতা ভেঙে নিয়তি ধরা গলায় বলে কিন্তু এভাবে যে আমি আর পারছি না।চলো কোথাও কয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসি।তারপর তো সেই একই অবস্থা। বরং একটা কাজ করলে হয় না,আমরা কোনো সেবামূলক কাজে যোগ দিই। নিয়তির মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে নির্মলবাবু থামলেন।
তা বেশ তো, কিছু একটা করো—-নিয়তি বলে। কিছু একটা করো,এভাবে আর বাঁচা যায় না। নিয়তির সিদ্ধান্ত শুনে নির্মলবাবু যেন একটু প্রসন্ন হয়ে নিয়তির দিকে তাকালেন।
‘হ্যাঁগো সে চেষ্টাই করতে হবে, তাহলে সেই সেবামূলক কাজের মধ্যেই আমরা দু’জনে এক সাথেই থাকবো এবং ছেলের দুঃখ কিছুটা হলেও একটু ভুলে থাকতে পারবো। নিয়তির কথায় একটু আশ্বাস খুঁজে পেয়ে নির্মল বাবু বলে, ঠিকই বলেছো, দেখি চেষ্টা করে। সত্যিই আমার বাড়িতে মন টিকছে না। অনুক্ষণ শুধু ছেলের কথাই মনে পড়ে। ঠিক আছে তুমি সেই চেষ্টাই করো– মাথা নেড়ে সমর্থন জানায় নিয়তি। আচ্ছা শোনো এখন তো মানুষের বিপর্যস্ত অবস্থা। আমাদের মতো দেখো অনেক মা-বাবাই সন্তান হারিয়েছে, কেউ বাবা-মাকে হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে বসে আছে, আমরা যদি তাদের পাশে দাঁড়াই তাহলে কেমন হবে, বলো? ঠিক বলেছো। দেখি আমাদের পাশের পাড়াতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে, সেখানে কথা বলে, দেখি কি করা যায়, বলেই নির্মল বাবু বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। নিয়তি মনে মনে ভাবে,আজ এমন পরিস্থিতি সমব্যথী মানুষের বড় প্রয়োজন। আমরা যদি একে অপরের পাশে নিজেদের বেদনা ভাগ করে নিতে পারি তাহলেই হয়তো এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাবো। এরমধ্যে নিয়তি যেন একটা আলোর ইশারা খুঁজে পায়, তার দেহ মন একটু চনমনে হয়, সতেজ হয়। নিয়তি তখন উঠে যায় সামান্য রান্নার আয়োজন করতে। প্রায় মাসখানেক ধরে একই রকম কোনোমতে সিদ্ধ পোড়া খেয়ে বেঁচে আছে ওরা। ফাঁকা নির্জন বাড়িটা যেন তাদেরকে গিলে খেতে চায়। চারিদিকে ছেলের স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিন্তু পেট তো মানে না কোনো আলো-অন্ধকার। মানে না বুড়ো কিশোর। সামান্য হলেও তার খাদ্য চায়। কাজের লোক ছাড়িয়ে নিয়তি নিজেই যৎসামান্য কিছু একটা রাঁধে। আজও ব্যাতিক্রম নয়। তবে ক্ষণিকের জন্য হলেও আজ তার একটু হালকা লাগছে। নির্মল বাবু বাইরে থেকে বেরিয়ে এসে সামান্য আহার গ্রহণ করে। ‘তুমি আর মন খারাপ করবে না’ নির্মল বাবু নিয়তির দিকে তাকিয়ে বলেন। আমি পাড়ার সেবা সংস্থাটির সঙ্গে কথা বলে এসেছি। আজ বিকেলে তারা আমার সঙ্গে কথা বলবে বলেছে।
যথারীতি বিকেলে নির্মল বাবু রাস্তায় বেরুতেই দেখলেন যে সেই সেবাসংস্থার কয়েকজন ছেলে তাদের খাতা-কলম নিয়ে একটি চালা ঘরের সামনে বেঞ্চের উপর বসে যেন কিসের হিসেব কষছে। তাদের মধ্যে থেকেই যে ছেলেটি ওই দলের প্রধান সেই ছেলেটি নির্মলবাবুকে দেখেই হাসিমুখে বলল, আসুন কাকা। আপনার ছেলের কথা জেনে ভীষণ কষ্ট পেলাম। সত্যিই বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান যদি অকালে চলে যায়, সেই বাবা-মা’র যে কি কষ্ট হয়, সেটা আমি বুঝি কাকা। আমরা সবাই খুব মর্মাহত। তবে হ্যাঁ আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা আছি তো আপনার পাশে। আপনি অনায়াসে আমাদের দলে যোগ দিতে পারেন। কোনো অসুবিধা হবে না আপনাদের। আমাদের অভিভাবক হয়ে আপনারা আমাদের দলে থাকবেন।

তা তোমাদের এই যে মহৎ উদ্দেশ্য, এই যে সেবামূলক কাজ, মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সত্যিই এতে আমি ভীষন খুশি হয়েছি— কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে নির্মলবাবু ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললে একটি ছেলে তৎক্ষণাৎ প্রতিত্তুরে জানাই, আসলে কি কাকু এখন তো আমাদের কারো তেমন কাজ নেই। সবই বন্ধ বুঝতেই পারছেন তাই সবাই মিলে ভাবলাম, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে কাজে লাগিয়ে যদি একটু মানুষের সেবা দিতে পারি এতে নিজেদের আনন্দ এবং অন্যের আনন্দ পাওয়ার সুযোগ হবে, এই আর কি! আপনার ছেলের ব্যাপারটাও আমরা শুনেছি। খুব দুঃখজনক। আমরা ভাবছিলাম একদিন আপনাদের খোঁজ নিতে যাবো আসলে আপনার পাশের পাড়াটায় বেশ কয়েকজন আপনজনকে হারিয়েছেন তাই তাদের পাশে থাকতে এবং তাদের খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে আমরা এই কয়দিন ধরে খুব ব্যস্ত আছি। এই জন্য আর হয়ে ওঠেনি তবে ভালোই হল। আপনি এসেছেন আমরা ভীষণ আনন্দিত, ছেলেটি হাসিমুখে সব বলে গেল।
‘আচ্ছা, আচ্ছা বাবা, তোমরা যে ভেবেছো, এটাই পরম পাওয়া। আর যা তোমরা করছো, তা কতজনই বা করতে পারে? ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন, বলেই সস্নেহ দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কিছু আরো বলবার চেষ্টা করছিলেন এমন সময় অন্য একটি ছেলে বলে উঠে, কাকা আপনি কি একাই আসবেন ?
‘না, না আমরা দু’জনেই ভাবছি তোমাদের দলে কাজ করবো। আসলে মনের দিক থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই একেবারে ভেঙে পড়েছি। আমরা যদি তোমাদের সঙ্গে কাজ করি এবং কিছু অর্থ সাহায্য করি তাহলে নেবে তো? সেকেন্ড বিলম্ব না করে ছেলেটি বলে, অবশ্যই কাকা।অন্যান্য ছেলেদের দিকে মুখ করে খুশিতে চিৎকার করে বলে, এই শোন তোরা কাকা-কাকিমা আমাদের সঙ্গে দু’জনই এই কাজে যুক্ত হতে চাইছেন, কি বলিস তোরা? সমস্বরে সবাই বলে উঠল, দারুন হবে। এক এক করে নির্মল বাবু কে ঘিরে সবাই দাঁড়ালো। তাদের মাঝখান থেকে বিজয় ছেলেটি বলে উঠল, কাকু খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনারা আসুন, সব দুঃখ ভুলে যাবেন। অভুক্ত, বিপন্ন মানুষকে সামান্য কিছু খাবার দিতে পারলে যে কি আনন্দ তা বলে বোঝানো যাবে না। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, কত মানুষ যে আজ স্বজনহারা—– কারো বাবা, কারো মা,কারো সন্তান, কেউ বা একাকী শয্যাশায়ী। এদের দুঃখের সামান্য অংশ যদি আমরা লাঘব করতে পারি তাতেও পরম তৃপ্তি। আপনারা আসুন, আপনারা আমাদের পরিচালনা করবেন। এই দেখুন না আমরা সবাই ছোটখাটো কাজ করে খেতাম। এই পরিস্থিতিতে সব‌ই বন্ধ হয়ে আছে তবুও আমাদের সামান্য যা ছিল তাই দিয়ে প্রথমে শুরু করি। তারপর ঈশ্বরের দয়ায় কেউ না কেউ কিছু দান করেন আর তা দিয়েই মোটামুটি পঁচিশ/ ত্রিশটা পরিবারকে আমরা ডাল ভাত সবজি দিতে পারছি। আর আপনি যদি কিছু দান করেন তাহলে আরো ভাল হবে। আপনারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলে আমরাও ভীষণ খুশি হবো—- উচ্ছ্বসিত হয়ে ছেলেটি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল। বিজয়ের এই কথাগুলো শুনে নির্মল বাবুর চোখ যেন খুশিতে চকচক করে উঠলো। চোখের দৃষ্টি যেন তাদের প্রাণের গন্তব্যে পৌঁছে দিলো। তারপর ধীরে এবং প্রসন্নচিত্তে নির্মল বাবু বললেন, ঠিক আছে বাবা, আমরা কাল‌ই তোমাদের দলে যুক্ত হবো। ‘কোথায় আসবো’— একটু বলে দেবে? নির্মল বাবুর প্রশ্নে সান্ত নামে আরেকটি ছেলে বলে উঠলো, এখানে আসবেন। তারপর সব বুঝিয়ে দেবো আপনাকে। কোনো চিন্তা করবেন না, দেখবেন, কি অপার আনন্দ এই স্বেচ্ছা সেবায় !
‘ঠিক আছে বাবা,’ আজ তাহলে উঠি, ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে নির্মলবাবু। বাড়ি গিয়ে তোমাদের কাকিমাকে বিষয়টা জানাই আর আমরা কাল অবশ্যই চা খাওয়ার পর দশটার দিকে এসে যাবো। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নির্মল বাবু বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বাড়িতে এসে দেখেন নিয়তি একাকী নীরব উদাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বসে আছে। নির্মল বাবু পাশে গিয়ে হাসিমুখে বললেন, আর মন খারাপ কোরো না। কাল থেকে আমরা আমাদের মত লোকের সেবায় যুক্ত হবো। এই সেবাই আমাদের অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাবে। এটাই আমাদের বাঁচার একমাত্র পথ আর ঈশ্বর বোধহয় এটাই চান, নিয়তি। ‘একেই বলে নিয়তি’ ! ‘তিনি যা চান তা মঙ্গলের জন্য’— কথাটি মিথ্যে নয়, আজ সেটা বুঝতে পারছি। পরম করুণাময়ের অপার করুণা মানুষের উপর দিনরাত বর্ষিত হচ্ছে। তার দয়াতেই হয়তো আজ এই সুখের আনন্দের সন্ধান পেলাম। হয়তো সব বেদনার মুক্তি আমাদের এখানে খুঁজে পাবো। ভালো থাকার একটা সুন্দর ঠিকানা পেলাম আমরা। ‘তবে তা-ই হোক’—- সজল চোখে নিয়তি অস্ফুটে বলে ওঠে।
পরেরদিন তারা যথারীতি সেই ছেলেদের আস্তানায় গিয়ে হাজির হয় এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেই দলে যোগদান করে। তারাও পরম আদরে নির্মলবাবুদের তাদের কাজে যুক্ত করে নেয়। তাদের ব্যবহারে আর ব্যথীত মানুষের সেবায় সুযোগ পেয়ে নিজেদের দুখের কথা অনেকটাই পুরান হয়ে গেছে। শোকার্ত মানুষের সান্নিধ্যে এসে নির্মলবাবু আর নিয়তি বুঝতে পেরেছেন, এ পৃথিবীতে শুধু তাদের শোক নয়, বহু মানুষ আর্ত,পীড়িত— প্রত্যেকের আজ সমব্যথী মানুষের বড় প্রয়োজন। তাই একজন বিপন্ন মানুষ আরেকজন বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ালে ঈশ্বর বোধহয় খুশি হবেন এবং সেখানে সেবাদান হয়তো সার্থক হবে—- এই কথাগুলো বলে নির্মল বাবু যেন মনে মনে একটু হালকা হলেন। তাঁদের ব্যথিত হৃদয় যেন খুশির জোয়ারে ভাসতে লাগলো। মনে হলো এই সুখ-দুঃখময় পৃথিবীতে শুধু তারা নয়, অনেকে আছে। আর এই দুঃখকেই যদি সুখের মত বরণ করে নেওয়া যায় তাহলে সেখানেও অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে। এই অনাস্বাদিত অনুভবে নির্মলবাবু নিয়তিকে হাতে ধরে সেই বেঞ্চে বসালেন এবং সেদিন থেকে দলে কাজ করতে শুরু করলেন।

দুদিন কাজের পর তাদের মন অনেকটা হালকা হয়ে গেলো। হঠাৎ তৃতীয় দিনে যখন কাজের জন্য বের হবেন এমন সময় এক বন্ধুর ফোন এলো—– ইচ্ছাকৃতভাবে নির্মল বাবু তার ফোনের স্পিকার অন করলেন—ওপার থেকে ভেসে এলো, হ্যালো এ নির্মল তো? হ্যাঁ নির্মল বলছি, আপনি কে বলছেন ? আবার ভেসে এলো সেই কণ্ঠস্বর, আরে আমি তোর বন্ধু শুখদেব বলছি। নির্মলবাবু বললেন, ও–ও, তা বন্ধু এতদিন পরে? আরে শুনলাম তোর ছেলেটা নাকি করোনায় মারা গেছে? কিভাবে শুনলি?এই লোক মুখে শুনলাম। তা কেমন আছিস? সত্যিই খুব বাজে খবর। ভালো আছিস তো?নির্মলবাবু বললেন, হ্যাঁ ভাই যা শুনেছিস, সব সত্যি। তবে হ্যাঁ এখন আমরা ভালো আছি, বলেই ফোন কেটে দেয় নির্মলবাবু। ফোন থেকে মুখ তুলে চার দিকে তাকিয়ে দেখে নির্মলবাবু,সত্যিই পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য যেন ঝরে পড়ছে। গাছপালা রৌদ্রে চকচক করছে, পাখির কূজন, মানুষের মুখরতা,নদীর কলতান যেন পৃথিবীর বুক ভরে দিচ্ছে প্রাণের আনন্দে আর সেই আনন্দ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে নির্মল-নিয়তির হৃদয়কে। আজ তারা সত্যিই আনন্দে আছে। সত্যিই আজ তারা ভালো আছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।