মার্গে অনন্য সম্মান খুশী সরকার (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার
সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ১১৬
বিষয় – স্বপ্ন
স্বপ্নের উড়ান
“স্বপ্ন সবারই থাকে তাই বলে স্বপ্নে বিভোর হয়ে উড়ে বেড়াতে হবে? আমি বাপের জন্মেও শুনিনি বাবা,স্বপ্নের কাছে মাতৃত্বও ফিকে হয়ে যায়! এ কোন্ দিনকাল পড়লো?” আপন মনে গজগজ করছে শ্যামলী। এমন সময় অমলকে দেখে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে,”এত তাড়াতাড়ি বাজার হয়ে গেল?”
“হ্যাঁ।” কি ব্যাপার এত গজ করছ যে? সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েই জানতে চায় অমল।
“গজ গজ করি কি আর সাধে? আচ্ছা তুমি একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, “কোনো মেয়ের বিয়ের পক্ষে কুড়ি বছর বয়স কি সত্যিই কম?”
“এর উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়, বুঝলে?”
“যাব্বাবা, একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছ না?”
“না, পারছি না কারণ বিয়ের মেন্টালিটি একই বয়সে সবার সমান আসে না। কেউ এর কম বয়সেও মেন্টাল প্রিপ্যায়ার্ড হতে পারে, আবার কেউ এর থেকে বেশি বয়সেও মেন্টাল প্রিপারেশন নিতে পারে না।
“তোমার মেয়ে কি তাহলে সেই বয়সে বিয়েতে মেন্টাল প্রিপারেশন নিতে পারেনি।
“হয়তো তাই।”
“কিন্তু মাতৃত্বেও কি তাই ?”
“হয়তো না.” কিন্তু তার স্বপ্নের কাছে হার মেনেছে।
“এই আমি বলে রাখলাম, এর জন্য ওকে একদিন অনুতপ্ত হতে হবে।”ক্রুদ্ধস্বরে শ্যামলী অলমকে জানায়।
“সে ও সময়ে ঠিক সামলে নেবে।”
“দেখাই যাবে।”
“আরে ছাড়ো ওসব কথা।” আজকালকার মেয়ে ও, ঠিক সামলে নেবে সব।এবার ধরো বাজারের ব্যাগটা। তাড়াতাড়ি। রান্না করো। আমি অফিস যাব।” রাগান্বিত স্বরে বলে অমল।
হঠাৎ বেজে ওঠে মোবাইল। রান্না করতে করতেই শ্যামলী ফোন ধরে বলে, “হ্যালো” ওপার থেকে ভেসে আসে, “তাড়াতাড়ি এসো মা, আমার ডিউটি আছে। বাচ্চাটাকে ধরার লোক নেই।”
শ্যামলী তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাটাকে একবার খাইয়ে দিয়ে গেলেই তো শাশুড়ির কাজ অনেকটা হাল্কা হয় কিন্তু উঠবে ঠিক যাবার মুহূর্তে, আর হুড়মুড় করে বেরিয়ে যাবে বাচ্চাটাকে ওভাবে রেখেই। এভাবে কি বাচ্চা মানুষ করা যায়! শুধু কি তাই,বাসি ঘর, বিছানা রেখেই বেরিয়ে যায় নাকি রোজ। একই কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেল আমার।” শ্যামলীর মনে পড়ে তারও তো একটা স্বপ্ন ছিল। হয়তো তার মত এত উচ্চ আকাশে ওড়ার স্বপ্ন নয়। বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই স্বামী সন্তান নিয়ে শান্তিপূর্ণ একটা জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল। শ্যামলীর চোখে ভেসে ওঠে সেই দিন— মেয়েটা স্কুলে যাবে। শীতের সকাল। কিছুতেই ঘুম ভাঙছে না তার। জোর করে আদর দিয়ে তুলে বাইরে এনে ঘুরে ঘুরে তার ঘুম ভাঙায়। দাঁতে ব্রাশ করিয়ে একটুখানি খাওয়ানোর চেষ্টা করে। টিফিন তৈরি করতে করতেই চলে আসে স্কুল ভ্যান। অতি দ্রুত সাজিয়ে গুছিয়ে বই পত্রের ব্যাগে টিফিন দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয় স্কুলে। এই ছিল তার রোজকার রুটিন। তার জন্য যত ক্লান্তিই থাক আর শরীর অসুস্থই থাক তাকে উঠতে হতো সাত তাড়াতাড়ি কারণ তার জানা ছিল, উঠতে একটু দেরি হলেই মেয়েকে পাঠাতে পারবে না স্কুলে আর নিজেও ধরতে পারবে না ঠিক সময়ে লাইন বাস। তার কর্তব্যে সে ছিল অত্যন্ত সজাগ অথচ মেয়েটা উল্টো। দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞান এতটুকু নেই। পরমুখাপেক্ষী জীবন নিয়ে স্বচ্ছন্দে ভাসছে উড়ন্ত ডানা মেলে। অথচ সেও চাকরি করেই সাধ্যমত স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছে অথচ তার মেয়ে! ভাবনায় ডুব দেয় শ্যামলী।
“আরে এত কি ভাবছো? যাও তাড়াতাড়ি, রেগে যাবে তো—” অমলের কথায় বর্তমানে ফিরে আসে শ্যামলী। কোনোমতে শাড়ি জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। নাতিকে দেখে বড় মায়া হয় তার। এমন ফুটফুটে সন্তান মানুষ হচ্ছে অনাথের মত। যদিও ঠাকুর্দা ঠাম্মা, দিদা দাদুর নয়নের মণি। তবুও বাবা-মা’র ভালবাসার কি বিকল্প আছে? দু’জনেই ব্যস্ত আপনাপন স্বপ্নের জগতে। ছোট্ট শিবু ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করে সারাদিন। নাতিকে কোলে নিয়ে শ্যামলী মুখ রাখে জানলায়। ভাবে,”সত্যি কি স্বপ্নের কাছে হার মেনেছে অপত্যস্নেহ!” “হয়তো তাই!”দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেনে নেয় নিজেই।নাতির করুন মুখটার দিকে তাকিয়ে শ্যামলী আবার ডুব দেয় ভাবনায়। অনেকটা দেরী হয়ে গেছে আজ। তাড়াতাড়ি খেতে বসেছে। মেয়ের স্কুল বন্ধ থাকায় সেদিন খেলছিল তার সামনেই। হঠাৎ নাকে আসে দুর্গন্ধ। সবে দেড় বছর বয়স।অমনি প্যান্ট খুলতেই দেখে পাছা ভর্তি পটি। মেখে গেছে দুই পায়ে। আর কি করা— অগত্যা খাওয়া ছেড়ে আগে পরিস্কার করে মেয়েকে । তারপর বাকি খাওয়া খেয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায় স্কুলের উদ্দেশ্যে। মনে মনে ভাবে সন্তানকে বুঝি আপন হাতে লালন করেছে বলেই মেয়ের প্রতি তার এত ভালোবাসা। আর হয়তো এই কারণেই তার জেদ তিরস্কার বা অপমান সব মেনে নিতে পারে খুব সহজে। অথচ তার মেয়ে! হ্যাঁ মাতৃত্বের স্নেহ থাকলেও তা মেঘলা রোদের মতো ম্যারমেরে।
কলিংবেলের আওয়াজে সম্বিত ফিরে শ্যামলীর । মেয়ে এসেছে দেখে শ্যামলী ফিরে আসে নিজের ঘরে, কিন্তু ভাবনা মগজে অনর্গল ভিড় করে। অব্যক্ত যন্ত্রনায় ছটফট করে ভেতরে ভেতরে।
মাঝে মাঝে তার মনে হয়, এত সব গভীর ভাবনা হয়তো ভাবেও না কেউ। আধুনিক মানসিকতার মুখোশে কোনো আঁচড় কাটতে পারে না এই নিম্নমধ্যবত্তীয় আবেগ। বিশ্বায়নের যুগে তাই মাতৃত্বের চেয়ে আত্মস্বার্থী প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ঈগলের ডানায় ভর করার স্বাধীনতায় মশগুল থাকাটাই যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। তাই বুঝি মাতৃত্বের মাধুর্য এত ফিকে।
ইতিমধ্যে পার হয়েছে পনের বছর। শ্যামলী এখন চোখে ঝাপসা দেখে। মেয়ের কাছে আর তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না তবু মাঝে মাঝে কথা হয় ফোনে। নাতি থাকে এখন বিদেশে। ডাক্তারি পড়ছে সে। মেয়ে জামাই প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। দু’জনেই তার ডাক্তারি পড়ার বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ।টাকা পাঠাতে গড়িমসি করে না এতটুকু।কিন্তু মেয়ে একদিন আফসোস করে বলে, “মা জানো, ছেলে ডাক্তার হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে যেন কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গেছে। টাকার প্রয়োজনে ফোন করে। এমনিতে খুব একটা করে না আর করলেও যেন কথার মধ্যে আত্মিক বন্ধনের ছোঁয়া থাকে না। কেমন একটা দায়সারা ভাব কথায় ফুটে ওঠে। একটা লুকানো বেদনা টের পায় শ্যামলী। ভাবে, “এই তো হওয়ারই ছিল। সন্তানের জন্ম দেওয়া যত সহজ, মা হয়ে ওঠা তত সহজ নয়। শ্যামলীর মনে ভেসে ওঠে সেই ছবি। দু-আড়াই বছরের ছোট্ট শিবুর সেদিন জ্বর। মায়ের কোল থেকে কিছুতেই চাইছিল না নামতে।জোর করেই নামিয়ে মা চলে গেল কাজে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কি কান্না ছেলের! রাতে ফিরে কোলে নিতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে ছিল অভিমানে।এমনি রোজই কাছে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তো। মা যখন অনেক রাতে পাশে শুতো সে তখন ঘুমে কাতর কিন্তু সকালে চোখ খোলার পরে আবার দেখতো মা রেডি হচ্ছে কাজে যাওয়ার জন্য। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এমনই স্বপ্নে বিভোর ছিল, সন্তানের চাওয়া পাওয়ার দিকে নজর দেবার সময়ই ছিল না তার। ছোট্টবেলা থেকে মাতৃস্নেহের সোনার মত খাঁটি যে বন্ধন, প্রয়োজন তাগিদের সে বন্ধন ফসকা গেরোর মত আলগা। শ্যামলী মনে মনে বলে,”ছোট্টবেলা তুমি তাকে আদর দিতে কৃপণতা করেছো, ভেবেছিলে নিজের প্রতিষ্ঠাতেই একটা পূর্ণাঙ্গ সংসারের তৃপ্তি লাভ করবে। তাই যদি হতো তবে আজকে তোমার কন্ঠে এই বেদনা ঝরে পড়ছে কেন?”