সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে কুণাল রায় (পর্ব – ৪১)

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা :

অষ্টাদশ অধ্যায় : মোক্ষ যোগ : অন্তিম পর্ব :

ভগবান বললেন যে এই সম্পূর্ণ পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যিনি এই ত্রিগুণের প্রভাব থেকে মুক্ত।স্বভাব ও গুণ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের কর্ম ভাগ করা হয়েছে। শৌর্য, তেজ ও দক্ষতা সম্পন্ন গুণ ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম। কৃষি ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বভাব জাত কর্ম। পূজা পাঠ ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম। এবং এই উক্ত তিন কর্মের মানুষকে সেবা করা শূদ্রের কর্ম। আপন আপন কর্মকে উপলক্ষ করে মানুষ সিদ্ধিলাভ করে থাকেন। তিনি আরো বললেন যে পর ধর্মের অপেক্ষা নিজ ধর্ম শ্রেয়। মানুষ স্বভাব জাত কর্ম করলে পাপ প্রাপ্ত হন না।

  আপন কর্ম দোষযুক্ত হলেও, ত্যাগ করা উচিত নয়। সকল প্রকার কর্ম দোষ দ্বারা আবৃত থাকে।  যে ব্যক্তি এই পৃথিবীর মায়া পরিহার করে, সংযত চিত্ত সহ ও ভোগলালসা ত্যাগ করে কোন কর্ম করেন, তাঁর পরম সিদ্ধি লাভ হয়। এই সিদ্ধিলাভের মাধ্যমে জীব পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত করতে সক্ষম হয়।
 বিশুদ্ধ বুদ্ধিসহ, মনকে সংযত করে, সকল প্রকার মায়ামোহ , লোভ, ভোগ  লালসা ও পার্থিব নানা রিপুদের ত্যাগ করলেই সেই পরমাত্মাকে রন্ধ্রে রন্দ্রে অনুভব করা সম্ভব। ব্রহ্মভাব সম্পন্ন ব্যক্তি সদা প্রসন্ন। কোন প্রকার পার্থিব সুখ দুঃখ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি সমভাব সম্পন্ন। সকলের প্রতি তাঁর একই দৃষ্টি।
ভগবান অর্জুনকে বললেন যে এক অনাবিল ভক্তির দ্বারা তাঁকে প্রাপ্ত করা সম্ভব। ভক্ত তাঁর অতীব প্রিয়, তিনিও ভক্তের পরম প্রিয়। তাই এক অচল ভক্তিস্রোতকে অবলম্বন করে তাঁর পরমধামে প্রবেশ করা সম্ভব। তাই তিনি অর্জুনকে এক পরম ভক্ত হয়ে উঠতে পরামর্শ দিলেন এবং তাঁর সকল কর্ম তাঁর পায়ে সমর্পণ করতে বললেন মোক্ষ প্রাপ্তির শুভ উদ্দেশ্যে।অন্যথা অহংকারে বশীভূত হয়ে তাঁর কথা না শ্রবণ করলে বিনষ্ট হবে।
তিনি আরো বললেন যে অর্জুনের নিজ স্বভাবই তাঁকে যুদ্ধে প্রেরিত করবে। কোনো প্রকার মোহ সেই স্থানে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়রূপে প্রতিফলিত হবে। পরমেশ্বর সকল জীবে অবস্থান করে তাঁকে মোহপাশে বেঁধে রেখেছেন। তাই অর্জুনের উচিত তাঁর শরণাপন্ন হয়ে শান্তি ও নিত্যধাম প্রাপ্ত করা। পরিশেষে তিনি বললেন যে অর্জুনকে সকল প্রকার জ্ঞান তিনি প্রদান করেছেন, পশ্চাতে তাঁর যা ইচ্ছে তিনি তাই করতে পারেন।
অর্জুন ভগবানের অতিশয় প্রিয়। তাই তাঁর হিতের জন্যই সকল কথা বলেছেন। অর্জুনকে ভগবান তাঁর চিত্ত অর্পণ করতে বললেন, তাঁর পরম ভক্ত হতে উপদেশ দিলেন, তাঁকে পূজা ও নমস্কার করতে বললেন। তিনি আশ্বাস দিলেন যে তিনি অর্জুনকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করবেন। অতএব তিনি যেন শোক না করেন।
 যাঁরা সংযমহীন, অভক্ত ও পরিচর্যাহীন তাঁদের কখনো এই গোপনীয় জ্ঞান বলা উচিত নয়। কিন্তু এই পরমতত্ত্ব ভক্তদের মধ্যে যিনি বিলিয়ে দেন, অবশেষে তিনি তাঁর কাছে ফিরে আসেন।
 অর্জুন ব্যতীত অন্য কেউ তাঁর প্রিয় নন এবং হবেও না। যিনি এই পবিত্র কথোপকথন শ্রবণ পা পাঠ করেন, তিনি জ্ঞান যজ্ঞের দ্বারা তাঁকে পূজা করেন। এক পরম সত্য। যিনি শ্রদ্ধাসহ এই গীতা শ্রবণ করেন, তিনি সকল পাপ মুক্ত হয়ে, শুভ কাজে লিপ্ত হন।
ভগবান অর্জুনকে প্রশ্ন করলেন যে তিনি একাগ্রচিত্তে এই গীতা শ্রবণ করেছেন কি না। তাঁর সকল প্রকার মোহ, মায়া বিদূরিত হয়েছে কি না।
পার্থ বললেন যে তাঁর সকল প্রকার অজ্ঞান দূরীভূত হয়েছে। তিনি ভগবানের আদেশ মান্য করবেন।
হস্তিনাপুরে সঞ্জয় মহারাজকে বললেন যে তিনি উভয়ের কথোপকথনে সম্মৃদ্ধ হয়েছেন, রোমাঞ্চিত হয়েছেন। ব্যাসদেবের কৃপায় তাঁর এই পরম সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছে। তাই যতবার তাঁদের কথোপকথন তিনি স্মরণ করছেন, ততবার রোমাঞ্চিত হচ্ছেন। এক বিস্ময়, এক হর্ষ অনুভূত হচ্ছে।
 তাই যেখানে স্বয়ং যোগেশ্বর বর্তমান, যেখানে পরাক্রমী অর্জুন উপস্থিত, সেখানে নিশ্চিতরূপে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বিদ্যমান। এক চিরন্তন উপলব্ধি!!
সম্পূর্ণ সমাপ্ত
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।