গল্পেরা জোনাকি -তে কাকলী মুখার্জী

সূর্যাস্ত

আদিত্য আর নন্দিনী,ছোট্টবেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছিলো বন্ধুর মতো।এক পাড়ায় বাড়ি,একই স্কুল কলেজ,অগাধ বন্ধুত্ব।এর মাঝে কখন যে প্রেম ভালোবাসা এসে গিয়েছিলো মনে,তারা নিজেরাও বোধহয় বুঝতে পারেনি আগে।বুঝলো অনেক দেরিতে আর একে অপরকে আরও নিবিড় বন্ধনে বেঁধে ফেললো মনে মনে।কিন্তু বিধির লিখন,নন্দিনীর বাড়ির আপত্তিতে বিয়েটা হলোনা তাদের।অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলো নন্দিনীর,বিদেশে চলে গেল সে।আদিত্য রাও ওই পাড়া থেকে বাস তুলে চলে গেল অন্য জায়গায়।হারিয়ে গেলো নন্দিনী……তার বন্ধুদের কাছ থেকে এমন কি আদিত্যর কাছ থেকেও।আদিত্যও আর খোঁজার চেষ্টা করলো না তাকে,পাছে নন্দিনীর নতুন সংসারে কোনো অশান্তির সৃষ্টি হয় এই ভয়ে।
কেটে গেলো অনেক অনেক গুলো বছর…..দেশে ফিরলো নন্দিনী,পাকাপাকি ভাবে।কিছুদিন বাদে এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা আর তারই আমন্ত্রণে পরের রবিবার হাজির হলো তার ফ্ল্যাটে। গিয়ে হতবাক……সেখানে উপস্থিত আদিত্যও।বহুবছর পরে দেখা,তাই দুজনেই চেয়ে রইলো দুজনের দিকে,অপলকে…..অনেক অনেকক্ষন ….যেন অনন্তকাল ধরে।ঘোর কাটতে,হাসি গান,কথায় কেটে গেল সারাদিন,সবাই মিলে।সেই বন্ধুটির অনুরোধেই বিকালে ফ্ল্যাটের ছাদে একান্তে দেখা করতে রাজি হলো নন্দিনী।
…..ছাদে তখন শুধু তারা দুজন,আদিত্য আর নন্দিনী।অতি সাধারণ নন্দিনী ‘প্রায় পরিপূর্ণ’ এক নারী,স্বামী ,পুত্র ,কন্যা নিয়ে তার ‘আপাত’ সুখী জীবন।আর সেদিনের সরল,উদার,হাসিখুশী আদিত্য আজ চরম হতাশায় জীবনযুদ্ধে প্রতি পদে পদে বিপর্যস্ত ,ক্লান্ত,বিধ্বস্ত এক পুরুষ।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবো হবো,পশ্চিম আকাশে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে প্রায় ,পুব আকাশে আবছা চাঁদ,মোহময় গোধূলির আলোয় চারিদিক মায়াময়।নন্দিনীর মুখেও এসে পড়েছে সেই আলোর লালিমা,কথা চলছে টুকটাক দুজনের।হঠাৎ ভেঙ্গে পড়লো আদিত্য, নিজের সব ব্যথা, বেদনা,না-পাওয়া উজাড় করে দিলো নন্দিনীর কাছে।নন্দিনীর মুখটা নিজের দুহাতের মধ্যে তুলে ধরে তার বলিষ্ঠ ওষ্ঠ ছোঁয়াল নন্দিনীর অধরে।…….জীবনে প্রথমবার!!হয়তো বা শেষ বার ও।মাত্র কয়েকটি ‘মূহুর্ত’ কিন্তু মনে হলো যেন অনন্তকাল।কান্নায় ভেঙে পড়লো দুজনে,সব কষ্ট হতাশা অভিমান অনুযোগ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো অবিরাম।এই নিষ্পাপ প্রকৃত ভালোবাসার স্পর্শটুকুর যে বড়ো দরকার ছিলো তাদের জীবনে।হঠাৎ করে বদলে গেল সবকিছু……আকাশ আনন্দে লাল,বাতাসে হাজারো বাঁশির সুর,পাখিরা আরো জোরে কলরব করতে লাগলো,চাঁদ মুখ লুকলো লজ্জায়।পশ্চিম আকাশের সূর্যটা দিগন্তে ঢলে পড়ার আগে লাফিয়ে উঠলো আর একবার।আদিত্যর জীবনে যে নতুন করে সূর্যোদয় হলো,হয়তো…হয়তো বা নন্দিনীরও,কারণ আজ সে যে সত্যিই ‘পরিপূর্ণ’ হলো,’নন্দিনী’ থেকে হয়ে উঠলো পরিপূর্ণ ‘রমণী’।আর আদিত্য….সে পেল জীবনের পথে নতুন করে চলার উদ্যম,বেঁচে থাকার রসদ,যার নাম কি জানো!!! যার নাম হলো “ভালোবাসা”।সময়ের কাছে হার না মানা দুটি মন হারিয়ে দিলো আজ জীবনকেও।পরম বন্ধু হয়ে বাকি জীবনটা পাশে থেকে একসাথে চলার অঙ্গীকার করলো তারা।স্বয়ং ‘ঈশ্বর’ আর ‘প্রকৃতি’ হার মানলো ‘ভালোবাসা’র কাছে(হয়তো বা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই)।’সূর্যাস্ত’ কে তাই ওরা আজ বদলে দিলো “সূর্যোদয়” এ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।