গল্পের বইটা বুকে জড়িয়ে ধরেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে! ঘুম ভাঙলো বিকট এক ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে। ভালো করে সোজা হয়ে বসলাম। একটু আগেই হাওড়া স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে দুপুর ১২:৪৫ এর হাওড়া-ডানকুনি লোকালে উঠেছিলাম। আচমকা ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি এ কোথায় এলাম! ভাবলাম ঘুমের চোখে ভুল দেখছি হয়তো! নাহ্ পরিস্কার দেখলাম দূর দূরান্ত পর্যন্ত ট্রেনের কামরা বিলকুল ফাঁকা আর এদিকে মাথার ওপর হাতে ধরার ঝুলন্ত হ্যান্ড্যাল গুলো শুধু ক্যাঁচর ক্যাঁচ শব্দ করে প্রবল বেগে দুলছে। অথচ কি আশ্চর্য ট্রেন কিন্তু দাঁড়িয়ে।
“এই যে মশাই একটু ঠিক করে চেপে বসুন না, আরেকজন তো বসতে পারে তবে।” উপরের দিকে না তাকিয়েই বিরক্তি সহকারে কোনোরকমে সরে বসলাম। প্রচন্ড ভীড় তার মধ্যে ভীষণরকম ভ্যাপ্সা গরম। রক্ষে যে জানলা দিয়ে তবু হাওয়া আসছে। মাঝে মাঝেই আমার ঝিমুনি আসছিলো। দুপুরে ভাতঘুমের অভ্যেস আছে তো তাই। ঝিমোতে ঝিমোতে এক একবার চেয়ে দেখছিলাম কি স্টেশন পার হলাম। কিছুক্ষণ আগে গল্পের বইয়ে পড়া বিচ্ছিরি ধরনের ভুতুড়ে গল্পটা কেমন মাথার মধ্যে খালি ঘুরপাক খাচ্ছে। একটু আগেই তো মনে হয় ঘুমিয়ে কি অদ্ভুত এক স্বপ্নও দেখলাম যে ট্রেনটা পুরো ফাঁকা। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা কথা মনে হলো যে আশ্চর্যজনকভাবে এই ট্রেনটা কিন্তু কোথাও থামছে না! আর সত্যিই তো অনেক্ষণ ধরে লক্ষ্যই হয় নি যে ট্রেনে কেউ উঠছে না কেউ নামছেও না। কথাটা ভাবতেই গা মোচর দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে একটু সোজা হয়ে বসলাম। দেখলাম সামনের সব মানুষগুলো কেমন মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সেই একই ভাবে সবাই বসে। আরে! আশেপাশের সবাই এরকম মাথা নিচু কেনো….আর কারো মুখও দেখা যাচ্ছে না ভালো করে! অথচ বাইরে দুপুরের খট্ খটে রোদ। উল্টোদিকের জানলা দিয়ে হু-হু করে আসা গরম বাতাসের হল্কা চোখে মুখে ঝাপটা মারতে লাগলো। এমনসময় চোখ ঝলসানো রোদের আলোয় দেখলাম কামরার মানুষগুলো কেমন যেনো মোমের মতো গলতে শুরু করেছে। আর তারই মধ্যে কতোগুলো বিকৃতদেহের মানুষ প্রাণপণে আমাকে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে। এদিকে মাথার ওপর প্রচন্ড শব্দে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দুলছে ট্রেনের হ্যান্ডেলগুলো….. অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে শুনলাম চারপাশ থেকে কারা যেনো তারস্বরে বলছে– “আমাদের বাঁচাও… এই আগুন থেকে আমাদের বাঁ-চা-ও।” জ্ঞান হারাতে হারাতে দেখলাম ততক্ষণের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা হু-হু করে গ্রাস করছে ট্রেনের কামরা।
ঘড়িতে তখন প্রায় দুপুর দেড়টা। ট্রেনের জানলার পাশে নিশ্চিন্তে বসে বেশ ভালোই ঝিমুনি এসে গিয়েছিলো আমার। বুকে তখনো জড়িয়ে ধরা ‘সব ভুতুড়ে’ নামের সেই গল্পের বইটা। আচমকা ঘুম ভেঙে শুনলাম মাইকে সজোরে এনাউন্স হচ্ছে—“তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের গাড়ি কার্শেড যাবে। যাত্রীরা দয়া করে এই গাড়িতে কেউ উঠবেন না।” মনে মনে ভাবলাম ‘আরে! এটাই তো মনে হয় তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের দাঁড়িয়ে থাকা সেই ট্রেন। আমি ভুল করে না জেনেই উঠে পরেছিলাম ফাঁকা দেখে। একবার অবশ্য মনে সন্দেহ হয়েছিলো যে ট্রেনটা অদ্ভুতভাবে এতো ফাঁকা কেনো! তবুও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেনো গাড়িটাতে উঠে বসেছিলাম। তারপর জানলার পাশে বসে একসময় কখন জানি ঘুমিয়েও পরেছি। ভাগ্যিস মাইকের এনাউন্সমেন্ট শুনে ঘুম ভেঙে গেলো তাই রক্ষে!’ তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। ওহ্ যাক এতোক্ষন তবে ওটা স্বপ্ন দেখছিলাম। বাপরে স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন! তাজ্জব ব্যাপার যা হোক। আর কি বিচ্ছিরি একটা দুঃস্বপ্ন! উফ্ ভাবা যায়না! সেইদিন দুপুরে নির্জন প্ল্যাটফর্মে একা দাঁড়িয়ে সবেমাত্র দেখা স্বপ্নটার কথা ভাবতে ভাবতে আমি একেবারে ঘেমেনেয়ে উঠেছিলাম। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা ধীর গতিতে কার্শেডের দিকে রওনা দিলো। ট্রেনটা ধীরে চলে যাওয়ার সময় আচমকাই চোখে পরলো যে ট্রেনের একেবারে পিছনে লেখা রয়েছে… হাওড়া-ডানকুনি লোকাল,নম্বর ৩৬০৩৫। আর ঠিক তখনই কেনো জানিনা একটু আগের দেখা সেই বিভৎস দুঃস্বপ্নটার কথা ভেবে নিজের অজান্তেই কেমন গা শিউরে উঠলো।
পরে আবশ্য কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম যে, কাকতালীয় ভাবে সেদিন দুপুরে ওই ফাঁকা ট্রেনটাতে বসে আমার দেখা অদ্ভুতুড়ে দুঃস্বপ্নটা আসলে নাকি একটা নির্মম সত্যি ঘটনার এক ঝলক দৃশ্য ছিলো। সেটা ছিলো আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগের এক মর্মান্তিক ট্রেন দূর্ঘটনা। ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসের এরকমই এক শনিবারের দুপুর ছিলো সেদিন। তারিখটা ছিলো ১৯৯৯ এর ২৩ শে মার্চ শনিবার। সেদিন দুপুর ১২:৪৫ মিনিটের ৩৬০৩৫ নম্বর হাওড়া-ডানকুনি লোকালে চলন্ত অবস্থায় কিভাবে যেনো অকস্মাৎ আগুন লাগে। সেই আগুনে ট্রেনের পুরো দুটো বগি সমেত কিছু অসহায় প্যসেঞ্জার জ্যান্ত পুড়ে মারা যায়।