সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে হেমন্ত সরখেল (পর্ব – ১০)

তাপ-উত্তাপ

পর্ব – ১০

বেমালুম সটকে গেলেন গোলাম আলি | মিনিট পয়তাল্লিশ পর একাত্তরের যুদ্ধফেরত তফাদার যখন ও.টি.-র দরজা টেনে দিয়ে বাইরে এসে চেঁচালেন-
‘ ও নেগেটিভ, হাজির হো!’
হসপিটাল গেটের বাঁ হাতে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আমাদের সমষ্টি তখন মুহূর্ত গুনছে | ডাক্তারের শব্দগুলোয় একটা নিশ্বাস খুব আস্তে গড়িয়ে পড়লো খালেকের বুকে চাপা পাথর হয়ে | অনুতোষকে বললো, ‘যা ভাই, জানিসই তো…’
‘ চারজনের কমে হবে না, পেশেন্ট বেড-এ নিতে হবে |’- একক ছায়াকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ভেসে এল ডাক্তারি ফরমান | আমরাও উঠলাম |
‘ তোর চাচা?’
‘ সে ফুটে গেছে তখনই | নজর রেখেছিলাম তার ওপর | বেরিয়ে যেতেও দেখেছি, তখনই অনু’র সাথে আমার চোখাচোখি হলো, আমরা দু জনেই জানতাম এটা হবে। আগেও আব্বুর ব্লাড লেগেছে, তখনও এই একই খেলা হয়েছ, তাই আমি আর অনু দুজনেই এটা নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম, জানতাম কী হতে চলেছে |’
খেজুর পাতার চাটাই-এ বসে চাল বাছছে চাচী | পা দুটো লম্বা করে সামনের দিকে একটার ওপর একটা তুলে কোলে কুলোয় রাখা চাল খুঁটে কাঁক, কালো মাছি, খুঁদ নিচে রাখছেন | সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম | যতক্ষণে চোখ তুলে চশমার ওপর থেকে আমায় দেখবেন, সে লপ্তে আমার প্রণাম করা সারা | পা গুটিয়ে নিতে নিতে কপট রাগে বহু ব্যবহৃত প্রাচীন ডায়লগ-
‘ কতদিন বলিচি, পাপ চড়াস নে, তা বামুন ব্যাটা দোজখে না পাঠিয়ে আমায় বিরাম নেইবে? কোতায় পেইলেছিলেন তা? ইদিকি ত ঢ্যারা দিই ফেলিচে পার্টি!’
‘ কইলকাতা, একখান চাকরি জুটাইছি |’
‘ অ, তালি এলি ক্যানো মরতি আবার? খালেক’ডারেও তো টান দিলি পাত্তিস! জান ছুটি যেত তোগো, আমিও দুটো শান্তির নেবালা পেইতাম |’
দুটো ঘরে দুটো মা | দুজনেই একই জ্বালা সইছে | যার কেউ নেই সে অবলার মুখ’কে জাগাতে হয়, আমার মায়ের বলার একটা হলেও জায়গা আছে | চাচীর নেই | ডাঁই করে রাখা ধানের আঁটি বাঁচাতে ঝলসে চলে গেছেন নৌসাদ আলি | বার্ণ কেস, লবন ঢাকা জনাব নৌসাদ যখন বারাসাত হাসপাতালের গেটে, তখনই আল্লার দরবারে নাম লেখা হয়ে গেছিল | স্তব্ধতার মূর্তির গায়ে জমাট প্রলেপ সরছিল না কিছুতেই | কী মনে হতে, একদিন মাকে নিয়ে এলাম | সেদিন ভাঙলেন জাহিদা বিবি | উন্মাদ চিৎকারে জড়ো হয়ে এল মুসলমান পাড়া | শওহরের শোক স্তিমিত হয়েছিল আমার মায়ের বুকে মুখ গুঁজে | তারপর দুই সখি’তে কী হয়েছিল আমরা জানিনি, তবে একই সুর দুটো সারেঙ্গীতে বাজতে দেখছি |
‘ গ্যাছে কই?’
‘ কাশেমের শ্বশুর এইয়েচে, মেইয়ে ‘নে, সি আবাগীর বিডি তো ভাইগে গিচিলো, তারিই ‘নে এয়েচে | ইদিকি, কাশেমও গোঁ ধইরেচে, কিচুতিই ঘরে তোলপে না | পঞ্চায়িতি চইলতিচে হে’গো দব্বারে, ক্যারাইচে পঙ্খী জড়ো হইয়েচে য্যাতো |’
‘ তা, গোলাম চাচা তো দেখি জমিতে কামিন সামলাইতাছে, মুরুব্বিডা কেডা তাইলে?’
‘ রাকি দে তোর গোলাম চাচা! যায় নাকি কোতাও নিজির মইতলব না থাকলি? হ্যায় বনবো মুরুব্বি? ঘাটা স’তি হলি? যা, দেকি আয়, ত্যাকোন ভাত লামাইনি, খাইয়ে বেইর হবি ‘নে |’
‘ হ, খামুয়ানে, আইতাছি |’
ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে পূবমুখো | পাশেই মসজিদ | ওয়ক্ত মিলিয়ে নামাজ পড়েন গফুর চাচা | নজর পড়তেই এক গাল হাসলেন | মজাদার লোক | ঘরে চাল না থাকলে কিশোর ছেলেটাকে নিয়ে এসে বসেন মোজো’র দোকানে | শুরু হয় লোক হাসানো | তেমনটা দেখলেই লোকে বোঝে, আজ রান্না করবার মতো চাল নেই গফুর আলির ঘরে | সেদিন ছেলেটাকে কেউ সাথে নিয়ে যায় নিজের বাড়ি আর মিঁঞা ওয়ক্ত মিলিয়ে মসজিদে ঢোকেন নমাজ অদা করতে |
ছেলেটা বোবা, সাথে হাবা | মরা মায়ের পেট ফেঁড়ে বের হয়েছে | বের করেছিল ওর আব্বা ই | তারপর আর নিকাহ করার প্রবৃত্তি হয়নি গফুর আলি’র | প্রসব বেদনা সইতে শুরু করেছিল ষোলো বছরের মেয়েটা সন্ধে থেকেই | মুষলাধার বরিষে মিঁঞা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা কচি বৌটাকে দেখা ছাড়া কিছু করে ওঠার অবস্থায় ছিলেন না। দু’ একবার চেঁচিয়ে ওনার ভাবী’কে ডেকেছেন, টিনের চালে বৃষ্টির কলিশনে উত্থিত দামামায় সে আওয়াজ গন্তব্যে পৌঁছায়নি | হঠাৎ চোখ উল্টে হাত-পা ছেড়ে দিলে থতমত খায় গফুর | নাকের কাছে শ্বাস, কানের পিঠের নাড়ি না পেয়ে, কোমরে কাঁচি গুঁজে সোজা ঠেলে ওঠেন ভাইদের দোরে | সেই প্রলয়ের রাতেই গোর দিতে বেরিয়ে পড়েন পাড়ার ডাকাবুকোদের নিয়ে | শোনা যায় মাত্র দুজনে মিলেই কবর খুঁড়ে গোর দিয়েছিল সেদিন কবরখোলায় | গফুর আর নৌসাদ | পরদিন সকালে গফুর জাহিদা বিবি’র কোলে নামিয়ে দেয় ছেলেকে | কর্তার ইশারায় চুপচাপ শিশুর লালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মা | কোলে যার, সে ই তো মা! সত্যিটা সন্তানের বাল্যকালের রঙ্গ-রসে ধীরে ধীরে ধূমিল হয়ে যায় |
‘ চইললে কোন্ পানে ?’
‘ কাশেমের বাড়ি, খালেক’রে খুঁজি |’
‘ নেপোয় দই মেইরেচে | তা, নিজির চিনির বস্তা আইগলে না রাখলি, ঝে সুযুগ পাবে সে ই তো থাবা মাইরবে, এডা বোঝে না কোন্ আবাগীর ব্যাডা?’- মুখ টিপে হাসেন | আমি সহমতির ইঙ্গিতে মাথা নাড়লাম |
কাশেমের বাড়ির আগেই পথে খালেক | তিনজন, দুজন অপরিচিত | আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো |
‘ ইনি অর্কজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় | এল.সি.-র সেক্রেটারি | অর্ক, এনারা হলেন কাশেমের দুই মামা শ্বশুর | ভাগ্নিকে নিয়ে এসেছেন | ভালোই হলো, তুই এসেছিস, নয়তো এনাদের নিয়ে তোর কাছে যেতে হতো আমায় | আমার আবার মুনিষ খাটছে আজ মাঠে |’
এল.সি.সেক্রেটারি! আমি! এটা কী বলল ও! যদিও, এমন মিথ্যে বলার ছেলে তো খালেক নয়!
নমস্কারের প্রতি নমস্কার সেরে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এনাদের ভাগ্নি এখন কোথায়?’
‘ কাশেমের বড়ো ভাবীর ঘরে | চল, আমাদের বাড়িতে বসি, ওখানেই কথা হবে |’
আর কথা! এ ছোঁড়া তো মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে | এত বড়ো সিদ্ধান্ত পার্টি নিল, আমি জানতে পারলাম না, অথচ, খালেক জানে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।