ছোটগল্পে কল্যাণ কুণ্ডু

অস্বস্তি 

জানলাটা খুললেই মাঝে মাঝে একটা বোটকা গন্ধ নাকে লাগে। যদিও এটা সপ্তম তল। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম খোলা। ফ্ল্যাটটা বুক করার সময় রথীশ বাবু এ বিষয়টা একদমই মাথায় চিন্তা করেন নি। কন্সট্রাকশনের ঝা চকচকে মডেলটা দেখেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল ফ্ল্যাট টা। দারুণ কারিগরী নির্মাণের সাথে বিউটিফুল ল্যান্ডস্কেপ। স্বপ্নের আইভরী টাওয়ার। অনেক গুলো টাকা ইনভেস্ট করে ফেলেছেন। মনের মতো করে সাজানো ইন্টেরিয়র। সবচেয়ে মাথা খাটিয়েছেন তার ড্রয়িং কাম লাইব্রেরী রুমটাকে নিয়ে। আলো বাতাস আর সবুজায়ন, সব বিদ্যমান। যে কেউ ঘরে ঢুকলে ইম্প্রেসড হবেনই বিদগ্ধতা ও সৌন্দর্যশীলতার কাছে।
কিন্তু মাটি করলো দক্ষিণের এই আট বাই চারের বিশাল জানালাটি। দক্ষিণ খোলা ওয়াইড ওপেন জানালা। যদিও ঠিক জানালাটা নয়, জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেই বার্ডস আই ভিউর মতো চোখে পড়ে বাউন্ডারির ওপারে দারিদ্র্য। ফ্ল্যাট বিল্ডিংয়ের থেকে মাত্র একশ ফুট দূরে, বাউন্ডারির পাশ থেকে গজিয়ে ওঠা বস্তির দাঁত বের করা জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা। ভাঙা টালি আর কালো প্লাস্টিকের ত্রিপালে বেআব্রু ভাঙাচোরা সারি সারি ঘর। ঘিঞ্জি। নোংরা নর্দমা আর ঐ নোংরা কালো কালো কঙ্কালসার লোকগুলো। যেমন মলিন চেহারা তেমন পোশাক আশাক। মাঝে মাঝে একটা আঁশটে গন্ধ বাতাসের দমকা হাওয়ায় ঘরময় ভর্তি হয়ে যায়। মুখ বুজে সহ্য করতে হয় রথীশ বাবুকে।
সাহিত্যিক রথীশ সামন্ত। আজ খ্যাতির মধ্য গগনে। গল্প, উপন্যাসের সংখ্যা একটা আস্ত লাইব্রেরীকে সমৃদ্ধ করবে। আজ এখানে তো কাল সেখানে নানান সাহিত্য পাঠের আসর থেকে ডাক আসে। সরকারী অনুষ্ঠানেও ডাক আসে রীতিমতো। বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তেমনই নামডাক ৷ সন্মাননার উপহার ও স্মারক সাজাতে সাজাতে কোন দেওয়াল আর খালি নেই। প্রাপ্তির ভাড়ারে একবিন্দু চোনার মতো জেগে থাকে দক্ষিণের এই নোংরা বস্তির কুলি কামিনদের নৈকট্য। নিত্যদিনের হৈ হট্টগোল। মাঝে শোনা যাচ্ছিল বস্তি সরিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হবে। দারুণ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছিলেন রথীশ বাবু। পৃথিবীর বুকে কদর্যতার অপসারণ দরকার।
কিন্তু বিধি বাম। কতকগুলো ছোকরা ছুকরির দল, কোন ইউনিভার্সিটির হবে, বস্তির শ্রমিক মেহনতীদের সাথে রক্ত পতাকা উড়িয়ে বস্তি বাঁচাও আন্দোলন শুরু করে। বস্তি উচ্ছেদের আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। মনে মনে কম খঁচেননি রথীশ সামন্ত। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেছিলেন। পৃথিবীকে সুন্দর করার প্রয়াসকে রুদ্ধ করার বিরুদ্ধে।
এই বিষয়টি বাদ দিলে বাকী সব ঠিক ঠাক। পূর্বের বিশাল ব্যালকনিতে বসে সকালের সূর্যোদয় অথবা পশ্চিমের বারান্দায় সূর্যাস্ত, মনটাকে উদাসী বাউল করে দেয়। অষ্টাদশ তলার ওপর ছাদ থেকে বহুদূর দেখা যায় শহরটাকে। নিজস্ব ছন্দে চলমান। যত উপরে ওঠা যায় মলিনতার থেকে দূরে থাকা যায়। কুৎসিত ঘিঞ্জি আবহ তেমন রেখাপাত করেনা।
যাই হোক, আজকের লক ডাউনের বাজারে আগামী পুজাসংখ্যার লেখা গুলো একে একে সেরে ফেলেছেন রথীশ বাবু। পাবলিশারদের চাহিদা মতো উপন্যাস, ছোটগল্প, বড় গল্প নিয়ে খান কুড়ি লেখা।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সবে রাইটিং ডেস্কে এসে বসেছেন, হঠাৎ বেজে ওঠে রথীশ বাবুর মোবাইল।
— ” কি দাদা ব্যস্ত আছেন?”
–” আরে স্বদেশ বাবু যে, হঠাৎ কি মনে করে?”
স্বদেশ বাবু খানিকটা সংকোচবোধ করেন। –” হঠাৎ কেন দাদা, আপনি তো সব সময়ই আমাদের মনিকোঠায় আছেন”।
তৃপ্তির একটা ঢেকুর তোলেন লেখক। রথীশ বাবু ভালোই জানেন এই সকল পত্রিকা সম্পাদকেরা সময় অসময়ে তার স্মরণাপন্ন হয় পত্রিকার বাজারজাত চাহিদা বৃদ্ধির জন্য।
–” তা, এখন কিসের জন্য আমাকে মনে পড়লো?”
–” আর বলবেন না দাদা, মে মাসের মাসিক পত্রিকায় বিষয় ঠিক হয়েছে পরিযায়ী… ”
–” আচ্ছা, তা আমি কি করতে পারি?” রথীশ বাবু বেশ আগ্রহের সাথেই বললেন।
–” লিখুন না, টাটকা ঘটনার ওপর একটা জম্পেশ করে গল্প।”
–” কোন স্পেসিফিক ইন্সিডেন্ট সাজেস্ট করছেন?”
–” আরে দাদা, লিখুন না, ঐ ঘুমন্ত অবস্থায় রেলের চাকায় কাটা পড়া শ্রমিকদের নিয়ে, অনেকেই ওটা নিয়ে গল্প ফেঁদেছেন। আপনার কলমে আমাদের পত্রিকায় যদি একটা কিছু না লেখা থাকে তাহলে পিছিয়ে পড়বো যে।”
রথীশ বাবু কিছুক্ষণ গম্ভীরমুখে ভাবলেন। সবকিছু মেনে নেওয়া যায়, পিছিয়েপড়া- টা মানতে পারা যায় না। মোবাইল টা ঠিক করে ধরে বললেন,
— ” আমি থাকতে আপনার পত্রিকা পিছিয়ে পড়বে? ভাবলেন কি করে?”
–” বাঁচালেন দাদা, আজ কালের মধ্যে যদি লেখাটা রেডি করেন… ”
–” কোন চিন্তা নেই, কালকেই মেইল করে দেব।”
–” অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা, আপনার পারিশ্রমিক যথা সময়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে যাবে।” পত্রিকা সম্পাদকের বিগলিত কণ্ঠস্বরে খোসামুদির হাসি রথীশ বাবুর দুকান ছাপিয়ে হৃদয় ভরিয়ে দিল কাণায় কাণায় ।
মে মাসের মাসিক পত্রিকার বেশ কয়েকটা পাতা জুড়ে রথীশ বাবুর গল্প– ” চলমান শব”। সাথে উপযুক্ত গ্রাফিক্স। বাড়ির পথে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক।রেল লাইনের নিশানা ধরে হাঁটছে তো হাঁটছেই। মলিন বসন, অপরিচ্ছন দেহ, জঠরে তীব্র খিদে, কপর্দক শুন্য পকেট। লাইন দিয়ে তারা ফিরছে তাদের নিজ নিজ রাজ্যের নিজ নিজ টোলায়, বস্তিতে বস্তিতে।
পত্রিকা সম্পাদক কথা মতো গল্পের পারিশ্রমিক ব্যাঙ্ক একাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তৃপ্ত রথীশ সামন্ত। জনমানসে গল্পটার ইম্প্যাক্ট রিভিউ আকারে দৈনিক পেপারে বের হয়েছে। দারুণ প্রশংশিত। প্রকৃত শ্রমিকদরদী মানুষের হৃদয় নিংড়ে লেখা যন্ত্রণার চিত্রনাট্য।
কেবলমাত্র, পৃথিবীর সামান্যতম একটি ভূখন্ডে গল্পের উপজীব্য মানুষগুলো দক্ষিণের জানালায় দৈনন্দিন যাপনে অস্বস্তি বাড়িয়ে যায়।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।