ঝুম এসে বলল,‘আঙ্কেল একবার ব্যালকনিতে চল।’
বেশ কয়েক মাস বাদে দেখলাম ওকে। এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। লেখাপড়ায় এমনিতে ভালো। পরীক্ষার জন্য ও যে মনোযোগ দিয়ে তৈরি হচ্ছে সেটা ওর চেহারায় ফুটে উঠেছে। যারা পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে পরীক্ষার অনেক আগে থেকে তাদের চেহারায় সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবু ওর চোখে মুখে এই মুহূর্তে একটা চাপা অস্থিরতা আমার নজরে পড়ল। বসতে বললাম। অনেকদিন ওদের বাড়িতে যাই না। কোনো খবর নেওয়া হয় না। ভাবলাম যখন এসেই পড়েছে তখন পরীক্ষার জন্য কেমন তৈরি হচ্ছে সে বিষয় একটু খোঁজখবর নেয়া যাক।
ঝুম বসল না। বলল, ‘তুমি একটু ব্যালকনিতে এস।’ কথাটা বলেই ও ব্যালকনির দিকে এগোল।
অগত্যা আমাকেও যেতে হল। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
শীতের শেষ আর গরমের শুরুর সকালবেলা চারিদিকে হালকা রোদ। ভালো লাগছিল। দূরে নারকেল গাছের সারি। দিগন্ত রেখা বরাবর তাকিয়ে খুশি হলাম। এমন দৃশ্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাবার জন্য ঝুমকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে দেখি ওর মুখ কেমন থমথমে। একটা চাপা রাগ যেন ওর চিবুক ছুঁয়ে আছে।
এত রাগ! কেন জিজ্ঞেস করতে হল না। নিজেই টের পেলাম। আমাদের চারপাশের প্রতিবেশীরা যার যা কিছু আছে ঘরে সেই সব রেডিও,টিভি, টেপ রেকর্ডার অন্যকে শোনাবার জন্য উদার মনোভাব নিয়ে চালিয়ে রেখেছে। যার মিলিত শব্দ ঝংকার একজন সুস্থ স্বাভাবিক সচেতন মানুষের নিজস্ব চিন্তার জগতে ক্রমাগত হামলা করে। এরা ঝুমের প্রতিবেশী।
আমার মাথার উপরেও এক টাকমাথা সঙ্গীত বিশারদ আছেন। টাক অনেকেরই থাকে। ওই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়েছে অন্যরকম। চুল না থাকায় ঘিলু শুকিয়ে এমন হয়েছে যে অন্যের মাথার উপরে ধাইধপাধপ বাদ্য বাজালে নিচ তলার বাসিন্দাদের যে অসুবিধা হয়, এই বোধটাই খোয়া গেছে। মেয়ের অনলাইন পরীক্ষা। এই নিয়ে ঝগড়া করেতে যাব?
আমার ছোটোবেলার লেখাপড়ার দিনগুলির কথা মনে পড়ল। পাড়ায় সেবার আমরা যে ক’জন ছেলে মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেব তাদের জন্য প্রতিবেশীদের রক্ষণাবেক্ষণের যে সুন্দর ব্যবস্থা ছিল তা শুনে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা কষ্ট পাবে। অবাক হবে।
পাড়ায় যাঁদের ঠাকুরমা,দিদিমা, জেঠু,কাকু যাই বলতাম না কেন, তাঁরা সকলেই যেন আমাদের স্নেহ আর আশীর্বাদের বর্ম দিয়ে আগলে রাখতেন। কে কোন বাড়ির ছেলে মেয়ে তা নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। আমরা সকলেই ছিলাম তাঁদের খুব কাছের। যেন একই পরিবারের সদস্য।
পাড়ার ছোটো বড়ো সকলেরই বৃষ্টি পিসি। যিনি ঝগড়া ছাড়া থাকতে পারতেন না, তিনি আমাদের পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকে কেমন চুপ করে যেতেন। কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘যা নিজেদের লেখাপড়াটা মন দিয়ে কর। ভালো পরীক্ষা দেবার জন্য ফাজিল হওয়ার দরকার নেই।’
নিতাইদার জন্য আমাদের পরীক্ষার আগে কাকেরাও মিটিং করা বন্ধ করে দিত। লম্বা একটা লগি হাতে নিয়ে ছুটে বেড়াতেন তিনি। কাক নজরে পড়লেই আর রক্ষা নেই। একেবারে পাড়া ছাড়া। পরীক্ষা শেষ হলে তখন একদিকে কা কা চিৎকারের সঙ্গে কাকেদের মিটিং চলছে, অন্যদিকে নিতাইদা গুনগুন গান ঠোঁটে নিয়ে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
টিভি তো তখন আমাদের দেখা দেয়নি। রেডিও, টেপ রেকর্ডার, যার যা ছিল প্রায় বন্ধ থাকত। চললেও আমাদের কানে আসত না। নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদর ও শাসনের বলয় দিয়ে আমাদের এমন ভাবেই ঘিরে রাখতেন সকলে, মনে হত প্রতিনিয়তই যেন নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে বেঁচে আছি, বেড়ে উঠছি আমরা।
শীতের মাঝামাঝি এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে আরও ভিতরের দিকে ওর বাড়ি। সকালে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে বিকালে বাড়ি ফিরব, এমনটাই কথা ছিল। দুপুরের পর থেকে নিজেদের মধ্যে কথা বলার উপায়টুকু পর্যন্ত রইল না। এক সপ্তাহ বাদে ওই অঞ্চলের একটা মাঠে যাত্রা হবে। তারই বিজ্ঞাপন ক্যাসেটের মাধ্যমে চারিদিকে মাইক লটকে জানাচ্ছে। ওই শব্দ যেন তীক্ষ্ণ শলাকার মতো ঢুকে পড়ছে আমার মস্তিষ্কের কোষে। এই প্রচার শুরু হয়েছে মাসখানেক আগে। চলবে যাত্রা শুরু না হওয়া পর্যন্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধুটির বাড়ি থেকে অভদ্রের মতো পালিয়ে এসেছিলাম।
সেদিন ভেবেছিলাম আমি তো পালিয়ে এলাম, বন্ধুর ছেলের পরীক্ষা কেমন হবে? পাশ করতে পারবে তো?
এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার মানুষ তখনও যেমন ছিল না,এখন যেন আরও কমে এসেছে। এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করে অযথা ঝামেলা না বাড়িয়ে চুপচাপ থেকে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে।
প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে তা যে ছড়িয়ে পড়তে পারে নিজের ঘরেও, একথা ভাবছি না কেউ। উলটে ওই আগুনে রুটি সেঁকে নেবার আনন্দে মত্ত থাকে অনেকে।
একসময় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য হওয়ায় সুযোগ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, কলকাতা পুলিশ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় যোগ দেবার। সেখানে শুনেছিলাম নানা অঙ্গীকার।
শব্দ দূষণ নিয়ে চিন্তাভাবনার শুরু অনেকদিনের হলেও, প্রত্যক্ষ ফল হাতে হাতে পাওয়ার ব্যাপক শুভ সূচনা বোধহয় ১৯৯৬-এর পুজোতে। হাইকোর্টের নির্দেশ প্রশাসনকে সক্রিয় করেছে। নানা ধরনের কর্মসূচি এবং স্লোগান নিয়ে মানুষের চেতনার অন্ধকার কক্ষে যাওয়ার চেষ্টা করেছে মঙ্গলদীপ। তবুও যেন এক অদ্ভুত আঁধার! এখনও। সব বিষয়েই।
পরীক্ষার আগের দিনগুলোতে আমি ঝুমকে কি যে বলব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনেকদিন আগে এক আবাসনে আমার উপরের তলায় যে ভদ্রলোক একসময় থাকতেন তিনি সকাল, দুপুর, রাতে যখনই খেয়াল হয় অত্যধিক জোরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজান। থুতনির কাছে একটু দাড়ি ঝুলছে। সামান্য ট্যারা। নিজেকে কবি বলে দাবি করেন।
যে রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে জীবনের নানা নেতিবাচক ভাবনা থেকে নিরন্তর বাঁচাতে পারে বলে আমি মনে করি, ওই ভদ্রলোকের বহুদিনের চেষ্টায় সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে বেশ কিছুদিনের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করেছিল। এত তীব্র ছিল সেই গানের আওয়াজ। আমার মাথা নত হওয়ার বদলে, ঝিমঝিম করত। মনে হত আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব। মনটা অবসাদে পূর্ণ হয়ে উঠত। অপরাধ আমার নয়, অপরাধ রবীন্দ্রনাথেরও নয়।
তখন আমার মুখোমুখি বাস করত যে ভদ্রলোক তার বাড়িতে লেখাপড়ার কেউ নেই। অতএব। প্রায় সারাদিনই চলতে থাকা টিভির প্রতিটি অনুষ্ঠানের আওয়াজ আমার ঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যেত। যা আমি কখনো শুনতে চাই না। তবুও তা গজাল দিয়ে গোঁজানোর মতো আমার কান দিয়ে ঢুকে মস্তিষ্কে তীব্র আঘাত করে।
এভাবে আরও অনেকরকম শব্দ যা দূর থেকে ভেসে আসে তা হয়ত এড়াতে পারি না। তাতে হয়ত তেমন সমস্যা হয় না।
ঝুমকে বলার ইচ্ছে হচ্ছে, ‘আমিও ভালো নেই। যত বই আমার সংগ্রহে তার একটি বাক্য উপদ্রবহীন পড়া হয় না আমার। এই সমস্যা নিশ্চয়ই শুধু আমার নয়, বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী আরও অনেকের।
যারা এমন শব্দ করে ওই মানুষগুলো যদি একটু স্বার্থপর হত, যদি তাদের টিভি-রেডিও অন্যকে না শুনিয়ে শুধুমাত্র নিজেরাই নিজেদের মতো করে শুনত তাহলে আমি তাদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকতাম।
অশান্তির ভয়ে ওই লোকগুলোকে এই কথা বোঝাতে যাওয়া হয়নি আমার। অশান্তি করা ছাড়া আরও তো অনেক কাজ থাকে। ফলে প্রতিবাদ না করে এই উদ্ভট মানুষগুলিকে কিছু না বলে এতকাল আমি শুধু নিজেরই ক্ষতি করিনি, তা সর্বগ্রাসী হয়ে স্পর্শ করেছে ঝুমকে ও ঝুমের মতো আরও অনেককে।
ওকে ডেকে ঘরে নিয়ে এলাম। কথা দিলাম, কিছু একটা ব্যবস্থা করব।
আমি কি পারব কথা রাখতে?