সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – তেরো

টুকরো হাসি – তেরো

খাইলে এমন, না খাইলে অমন

গুলেদা বলল, ‘আমাগো কোনো আশাও নাই,আর কারও উপর ভরসাও নাই।’
আমাদের আড্ডায় সবারই মুখে মাস্ক। সবাই মেনে নিয়েছি যতক্ষণ ওষুধ নেই ততক্ষণ কোনো ঢিলেমিও নেই।
গুলেদার কথা শুনে বললাম, ‘কিসের আশা ভরসার কথা বলছ?’
‘ভাবছিলাম ভ্যাকসিন আইলে মাইনষেরা করোনার হাত থিকা রেহাই পাইবো। হেইয়া হওনের উপায় নাই।’
বিতান বলল, ‘কেন ভ্যাকসিন তো দেওয়া শুরু হয়েছে।এবার ধাপে ধাপে সবাই পাবে।’
বললাম, ‘ভ্যাকসিন কম দিয়েছে শুনলাম।’
গুলেদা বলল, ‘কম তো মনে হইবোই। যাগো এহন দেওনের কথা না হেই লোকগুলানও তো গিয়া ভ্যাকসিন নিতে বইয়া পড়ল। এহন চিল্লাইলে হইব যে কম দিছে।’
বললাম, ‘ওদেরও তো দরকার।’
‘চুপ কর। তরা ধাপে ধাপে নেওয়ার লাইগ্যা অপেক্ষা করতে পারো,অরা পারে না? ভ্যাকসিন কি চাল,তেরপল না বাড়ি বানানোর টাকা যে হুড়ুম- দুড়ুম কইরা নিজের নামে নেতেই হইবো।একটু অপেক্ষা করলে হইত না?’
বিতান বলল, ‘আসলে নিতে নিতে অভ্যাস হয়ে গেছে তো।তাই লোভ সামলাতে পারেনি।’
‘অতি লোভে হেগো কি হইতে পারে জানো?’ গুলেদা বলল,‘আমার খুব ভয় হয়, যদি কোনো সময় মাজরা পোকা মারণের জন্য বিষ সাপ্লাই দেয় তাইলে এই মহাজনেরা হেইয়াও খাইয়া ফেলাইবো। তহন হেইয়া যে কী ভয়ংকর হইবো!’
বিতান হেসে ফেলল।
গুলেদা বলল, ‘হাসিস না। মনে হয় হেই দিনই খুব তাড়াতাড়ি আইতাছে।বান্দরের পিডা ভাগের গল্প শোনছো? তোগো অবস্থা এমন হইবো যে হাতে লবডঙ্কা ছাড়া আর কিছুই জোডবো না।’
গুলেদার কথার মধ্যে তোচন এসে দাঁড়াল।
‘ক। কিছু কবি?’
তোচন কথা না বলে হাত জোড় করে রইল।
‘তগো এই ভঙ্গি দ্যাখলে আমার গা জ্বইল্যা যায়।হাত জোড় কইরা থাহনের কি আছে?’
তোচনের আস্থানা সুন্দরবনের এক গ্রামে। সেখানে আগে যে কাজ দিয়েছিল তাকে মজুরির টাকার ভাগ দিতে হত। হাতে যা থাকত তাতে সংসার চলত না। বেশি মজুরি পাওয়ার জন্য রাজমিস্ত্রির কাজে বিহারে গিয়েছিল। লকডাউনের সময় কাজও নেই, থাকার জায়গাও নেই। নানান ভোগান্তি সহ্য করে ফিরেছে। কিছুদিন একটা স্কুলে থেকে তারপর বাড়িতে গিয়ে দেখে সেটা আমপানের ঝড়ে খুব খারাপ অবস্থা। বাবা, মা, বউ, ছেলে, মেয়ে খুব কষ্টে আছে। যা টাকা ছিল প্রায় সবটাই বাড়ি আসতে খরচ হয়ে গেছে।
ভেবেছিল কিছু কাজ হয়ত পাবে।একদিনের কাজও জোটেনি।বাড়িটার একটা হিল্লে হবে ভেবে এর ওর পিছনে ঘুরেও লাভ হল না। বাধ্য হয়ে কাজের জন্য ঘুরতে ঘুরতে একদিন গুলেদার বাড়িতে। গুলেদা পরিচিত বয়স্ক লোকজনের বাড়িতে কাজের জন্য বলে দিয়েছে।তাতে আর কতটুকুই বা হয়।
তোচন কাজ না করে কোনো সাহায্য নেবে না।তাই আমরাও আমাদের বাড়ির নানা কাজে ডাকি।এই সুযোগে কিছু সাহায্য করা হয়।
গুলেদার বকুনিতে তোচন সোজা হয়ে দাঁড়াল।
‘কিছু কওনের আছে?’
‘বাবু বলতেছিলাম কি ওই সত্য মিষ্টান্নের দোকানের মালিক বলতেছিল ওনার দোকানের তৈয়ারি ঘি যদি বেইচে দিতে পারি তবে ভালো পয়সা দিত। ভাবতেছিলাম হাতে পয়সা পেইলে বাড়িতে গিয়ে ঘরগুলির এট্টু মেরামত করাতাম।’
গুলেদা বলল, ‘যদি বাড়তি রোজগার হয় তো কর। তা আমারে জিগাও ক্যান?’
‘বলতেছিলাম এট্টা উপায় যদি বইলে দ্যান কী কইরে ঘি বেইচতে হবে।’
গুলেদা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘মিত্তির বাড়ির পাশে ওই ঘোতনারে চেনো? যেডা গোডা করোনার সময় দোতলার বারান্দায় বইয়া থাইক্যা আরও মোডা হইইয়া গেল।পিপাডার মতো। রাস্তার লোকরে ডাইকা কইত আমি সাতেও নাই পাঁচেও নাই, বারান্দায় বইয়া তাই। এইহানেই বইয়া থাহি করোনার ভয়ে ভাই। হেইডারে আমার লগে দ্যাহা করতে ক। আর সুন্দরবনে যা। গিয়া দ্যাখ যে লোকের বাড়ি আমপানে মাটির লগে মিশা গ্যাছে অথচ একটা টাহাও সাহায্য পায় নাই এমন লোকের যদি কোনো কাজও না পাইয়া মরার অবস্থা হয়, চেহারা চিমসা মাইরা গিয়া থাহে তাইলে হ্যারে লইয়া আয়।’
আমাদের সঙ্গে সঙ্গে তোচনেরও চোখ গোল গোল হয়ে গেল। বলল, ‘বাবু কী যে বলতিছেন, আমি বুঝতে পারতেছি না।’
গুলেদা বলল, ‘তর বেশি বোঝনের দরকার নাই।যা কইলাম আগে হেইয়া কর। হ্যাসে দুইডারে খালি গায়ে শুধু কুস্তির পোশাক পরাইয়া বড়ো রাস্তার মোড়ে নিয়া গিয়া দুইপাশে দাঁড় করা।আর ঘিয়ের টিনডা রাখবি মাঝখানে। দেখবি তর ঘি কেমন বিক্রি হয়।’
‘এমনি করলেই বিক্রি হইয়ে যাবে বাবু?’
‘এমনে কি সব হয়? তরে সামান্য পরিশ্রম করতে হইবো। মাইনষেরে প্রথমে ঘি দেহাইয়া একবার ঘোতনারে দেহাবি আর একবার চিমসাডারে, আর চিৎকার কইরা কবি খাইলে এমন,না খাইলে অমন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।