সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – আটচল্লিশ

টুকরো হাসি-আটচল্লিশ
প্রতিমাসেই মনে পড়বে
সমর বলল, ‘তুই এত ভেঙ্গে পরিস না পবন। কুসুমকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর।’
‘আমি ওকে ভুলতে পারবো না কিছুতেই।’ কান্নাভেজা গলায় বলল পবন।
‘কেন পারবি না? তোর এই অল্প বয়স। পাঁচ বছর হল চাকরি পেয়েছিস। এ আর এমন কি দেরি হয়েছে বল? জীবনে কত সময় পড়ে আছে। এখনই যদি বলিস, তোর জীবন রেখে লাভ নেই শুনে তোর বাবা, মা কষ্ট পাবেন। ভেবে দেখ কত কষ্ট করে আশায় বুক বেঁধে ওনারা তোকে বড়ো করছেন। চারিদিকে দেখছিস তো হতাশায়, দুঃখে সব সাট-পাট করে ঝুলে পড়ছে। তাই বলে তুইও ওদের মতো একটা মেয়ের জন্য জীবনটা নষ্ট করবি?’
পবন চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইল। সে সমরকে তার পরিস্থিতিটা যে, কী করে বোঝাবে তা নিজেই বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ বাদে বলল, ‘সমর তুই জানিস না যে, কুসুম আমার কি অবস্থা করেছে তুই বুঝতেও পারবি না।’
‘বুঝব না কেন? এতো সিম্পল। কুসুম তোর হৃদয় নিয়ে হাডুডু খেলছে। তোর মহান প্রেমে পেরেক ঠুকে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে। তোর কলিজা আগুনে পুড়িয়ে কাবাব বানিয়েছে, তারপর কচ্ কচ্ করে চিবিয়ে খেয়েছে। তো তাতে এমন কি হয়েছে? বললাম তো, তোর সামনে আরও সুন্দর দিন পড়ে আছে। এখনই সব শেষ হয়ে যায়নি।’
‘তোকে আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না সমর।’ পবন প্রায় কেঁদে উঠল।
‘আর কি বোঝার বাকি আছে বল? আজকাল কত জঘন্য পাশবিক ঘটনাকে ছোটো ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়ে নানা খেলায় মাতিয়ে সবুদ লুকোবার চেষ্টা চলছে। তোর ঘটনা এমন আর কি? তেমন কিছু হলে তুই না থাকলে সেটা ছোটো ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া হবে। তুই তখন খেলা, মেলার এই আনন্দ জগত থেকে ফুস্ হয়ে যাবি। কেউ তোকে মনে রাখবে না। কুসুম তোর কি এমন করেছে?’
‘ও অন্য একজনকে বিয়ে করছে। শুনলাম বিদেশে চলে যাবে।’
‘তবে তো সত্যিই অতি ছোটো ঘটনা। এমন তো হয়েই থাকে। তুই এই নিয়ে দরবার করতে যা, দেখবি তোকে সবাই সেই কথাই বলবে। এটা এখনকার দিনে কোনো নতুন কথা নয়।’
‘কুসুম এমনটা করবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।’
‘স্বপ্নে কেউ নিজের কাছের কাউকে, মানে ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে এটা ভাবতে পারে না। তুইও সেটা ভাবিস নি। এটা আমাকে বোঝানোর দরকার নেই। শোন কুসুম যখন তোকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পেরেছে তুইও ওকে ভুলে যা। মনে শান্তি পাবি।’ একটু থেমে বলল, ‘দেখ আমি তোকে এত কথা বোঝাতে যেতাম না। তুই আমার কাছের বন্ধু। কথাটা জানতে পেরে তারপর তোর মনের এরকম অবস্থা দেখে আমি তো হুট বলতে চলে যেতে পারছি না। অন্য কেউ হলে এত কথাই হত না। চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। কাল থেকে নতুন জীবন শুরু করবি। কোনো জায়গা ফাঁকা থাকে না। কেউ না কেউ একদিন ঠিক তোর পাশে এসে দাঁড়াবে।’
পবন বলল, ‘আমি চাই না কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়াক। সেও যে কুসুমের মতো হবে না তা কেউ বলতে পারবে? আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না।’
সমর বলল, ‘ঠিক আছে তোর পাশে কাউকে দাঁড়াতে দিস না। যদিও প্রেমিকার উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ তবু বলি, তুই আর পাত্তা দিস না কাউকে। পারলে সবাইকে গোত্তা মেরে উড়িয়ে দিস। আপাতত কুসুমকে ভুলে যাওয়া তোর দরকার। একদম ফ্রেশ একটা লাইফ তৈরি করে আনন্দে থাক।’
‘আমি আর আনন্দে থাকতে পারবো না। সে উপায় নেই।’
‘কেন উপায় নেই? কুসুমের বিয়ে হবে। সানাই বাজবে। ওই রদ্দি মার্কা একঘেয়ে কাঁই-না-না সুরের কথা ভেবে তোর মন কান্নায় ভরে উঠছে?’
‘না সেজন্য নয়। তুই তো জানিস না আমি ওর জন্য কি করেছি।’
‘সে তো অনেকেই করে। করতেই হয়। এটাই চালু। আলু কাবলি, ফুচকা দিয়ে শুরু করে তারপর শহরে যত ভালো রেস্টুরেন্টের খাবার খাইয়েছিস। এই তো? এইসব খাবার কোনোদিন তোর বাবা,মা,ভাই,বোনদের খাওয়াসনি। আমাকে তো হাতে ধরে দু’টো কাচা বাদামও দিসনি। তা নিয়ে আমি কিছু মনে করিনি। তুইও ভাবিস না। কুসুমদের জন্যই পকেটের পয়সা খসাতে হয়। তবে একটা কথা ভাবলে শান্তি পাবি। সব খাবার তো তখন কুসুম একা খায়নি। তুইও খেয়েছিস। ফিফ্টি-ফিফ্টি। এটা ভেবে একটু আনন্দ কর কুসুম সঙ্গে না থাকলে তুই তো জীবনে মুড়ি,ছোলা,লেড়ো বিস্কুট আর তিনবার ফোটানো গজ- চা ছাড়া কিছু খেতি না। কুসুম ছিল বলেই তো কত ভালো খাবার তোরও খাওয়া হল।’
সমরের কোনো কথা যেন তার কানে ঢুকছে না। পবন বলল, ‘জানিস সমর আমি রাতে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখি।’
‘কি খারাপ স্বপ্ন?’
‘আমাকে কয়েকজন মোটা গাট্টাগুট্টা বাউন্সার তাড়া করে ধরেছে। আমি নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি। পারছি না। আমার শুধু মনে হয় ওরা এসে আমার ঘাড় মটকে উপরে তুলে ধরবে আর আছাড় মারবে। আতঙ্কে আমার ঘুম ভেঙে যায় বলেই আমি বেঁচে যাই। তা না হলে ওদের হাতে মারা পড়তাম।’
‘বুঝতে পারছি এইসব হচ্ছে কুসুমের জন্য। তুই ওকে ভুলে যা। দেখবি ওই বাউন্সাররা তাহলে তোর স্বপ্নে আর আসবে না।’
‘ভুলতে পারছি না। কি যে কেলো হয়েছে, তুই তো এখনও আসল ঘটনা জানিসই না।’
‘খুলে বল। তাড়াতাড়ি বল। তুই না বললে আমি জানব কি করে? আমি তো হাত গুনতে জানি না।’
‘আমি গত সপ্তাহে কুসুমকে প্রায় দু’লাখ টাকার গয়না কিনে দিয়ে দিয়েছি।’
‘এত টাকার? কেন?’
‘ও যে বলল, আমাকে খুব ভালোবাসে।’
‘ও। শুনেই গলে গেলি? তুই কোথায় পেলি এত টাকা?’
‘বেশি টাকা মাইনের নকল পে-স্লিপ বানিয়ে সই নকল-ফকল করে একজন ব্যাংক থেকে লোন পাইয়ে দিয়েছে।’
‘সই নকল করল! আর তুই সেটা মেনে নিলি?’
পবন বলল, ‘ ভাবলাম করোনার ভ্যাকসিন যদি নকল হতে পারে তবে সই কেন হবে না!’
‘তুই জানিস না যে এটা অন্যায়?’ সমর উত্তেজিত হয়ে বলল।
পবন মিনিমিন করে বলল, ‘ শুনেছিলাম প্রেমে আর যুদ্ধে কিছুই নাকি অন্যায় না।’
‘সর্বনাশ। এখন উপায়?’ সমর দিশাহারা হয়ে বলল।
পবন বলল, ‘আর কোনো উপায় নেই। আমি বহুদিন কুসুমকে ভুলতে পারব না।’
‘চুপ কর। যে কুসুমকে তুই এতগুলি টাকার গয়না দিয়েছিস সেই কুসুম এখন অন্য একজনকে বিয়ে করছে, বিদেশ যাচ্ছে।আর তুই কেমন ছেলে রে। এখনও বলছিস ভুলতে পারবি না?’
‘কি করে ভুলব? আমাকে লোনের সব টাকা শোধ করতে হবে। না হলে ব্যাঙ্কের তরফ থেকে আমাকে নানা রকম ভাবে হেনস্তা করা হবে। টাকাগুলি শোধ করবার সময়, কুসুমকে আমার প্রতি মাসেই মনে পড়বে।’