সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – বেয়াল্লিশ

টুকরো হাসি – বেয়াল্লিশ

রাম হবে, খেলা হবে

সুদামবাবুর মনে হল ভোরবেলার দিকে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। না ঘুমালে জেগে উঠবেন কি করে?
আজকাল কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। বিছানায় শুলেই নানান হাবিজাবি চিন্তা এসে হাজির হয়। কত উপদেশ শুনেছেন, কিভাবে ভালো ঘুম হবে এই নিয়ে। কিছুতেই কিছু হয়নি। একসময় ওষুধ খাওয়া শুরু করেছিলেন। তাতে পরদিন কেমন এক ঝিমুনি অবস্থা। দেখে অমলা একদিন বলল, ‘তোমার তো কোনোকালে এই বদ অভ্যাসটি ছিল না। নতুন করে শুরু করলে নাকি?’
‘কি?’
‘আহা। কিছুই যেন বুঝতে পারছে না।’
অকারণ এই গঞ্জনা! ঘুমের ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
টিভি খুলতে ইচ্ছে করে না। কোনো ভালো সংবাদ নেই। একদল বলছে আমরা কাউকে মারিনি। অন্যান্য দল বলছে মেরেছে। এই নিয়ে তর্কযুদ্ধ চলছে। তিন চারজন মিলে একসঙ্গে এমনভাবে কথা বলে যে, কে কী বলছে তা বোঝা যায় না। একটা চ্যানেলে যখন দেখা যাচ্ছে লোকজন মার খাচ্ছে, তখন অন্য চ্যানেলে নানান আমোদ আনন্দের কথা। নানা কিসিমের সেই কথা যেন আর ফুরোয় না। সুদামবাবুর অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
অমলা বলে, ‘কারা চাকরির পাওয়ার জন্য রাস্তায় শুয়ে আছে তা নিয়ে তুমি ভাববে কেন? এসব নিয়ে যাদের ভাববার কথা তারাই যখন ভাবছে না তখন তোমারও ভাবার দরকার নেই। তোমার যত নেই কাজ তো, খৈ ভাজ। তোমাকে নিয়ে আমার হয়েছে জ্বালা।’
সুদামবাবুর অহেতুক চিন্তা দেখে অমলা মাঝে মাঝেই এইরকম অনেক কথা বলে।
অমলা একদিন তার পছন্দের চ্যানেল দেখতে বসে বলল, ‘দেখ এখনও বাচ্চাটির বাবা কে কেউ বলতে পারছে না।’
সুদামবাবুর মাথাটা গরম হয়ে গেল। বললেন, ‘এইসব ছাইভস্ম খবর আমাকে শোনাবে না। তোমার যা মতিগতি তাতে হয়ত কোনো সময় বলবে এ বিষয়ে আমিই দায়ী।’
‘আহা কথার ছিরি দেখ। বুড়ো বয়সে শখ কত।’
সুদামবাবুর ছেলেমেয়েরা অন্য প্রদেশে চাকরি করছে। কলকাতায় আসতে চায় না। ওরা বলে,তোমরা লোটা কম্বল গুটিয়ে চলে এসো। বললেই কি হয়? হুট করে একেবারে চলে যাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে ছেলে মেয়ের কাছে ঘুরে আসেন স্বামী স্ত্রী মিলে।
ভাবনা হয় পাশের বাড়ির ছেলেটির জন্য। লেখাপড়ায় ভালো। এম এ পাস করে বসে আছে। বাবা মাকে ছেড়ে অন্য রাজ্যে যাওয়ার কথা না ভেবে এখন পস্তাচ্ছে।
একদিন কথা বলতে এসেছিল। বলল, ‘জেঠু আমি যে সুইপারের কাজের জন্য দরখাস্ত করেছি তাতে বাবা মা খুব কান্নাকাটি করছে। আপনি যদি একটু বুঝিয়ে বলেন তবে ভালো হয়। বাবা,মা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না।’
সেই থেকে সুদামবাবুর মাথা খারাপ অবস্থা। কি ভাবে কথাটা বোঝাবেন অলকের বাবা মাকে!
একদিন শুনতে পেলেন অলকের বাবা বলছে, ‘তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না। ভালো কাজ যদি পাও তবে করবে, নতুবা করবে না।’
অলকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন সুদামবাবু। বলছে, ‘বাবা তুমি শোনোনি এখন কোন কাজের বাছাবাছি করা যাবে না। সরকারি কাজ যে পাওয়া যাবে তার কোনো মানে নেই। যে কাজ পাওয়া যাবে সেই কাজই করতে বলেছে। আর আমি যেটা পাচ্ছি সেটা তো সরকারি কাজ। আমাদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে গেল এটা মাথায় রাখতে হবে।’
‘তোমাকে লেখাপড়া শেখালাম কি করতে? এই কাজ করতে হবে জানলে অত কষ্ট করে শেখাতাম না। তুমিও ধীরে ধীরে কাটমানি আর তোলাবাজির পাঠ নিতে। বাছাই করা প্রতিভাবানদের ঘরে ঘরে টাকা পৌঁছে দিতে। তাতে সমাজে তোমার কদর বাড়ত। আমরাও ছেলের গর্বে গর্বিত হয়ে দু’গরাস ভাত বেশি গিলতাম।’
অলক বলল, ‘সুইপারের কাজকে অনেক আধুনিক করতে হবে। তাই শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের দরকার। তখন দেখবে ডেঙ্গু আর ম্যালেরিয়ার মশা ঘর থেকে বাইরে বেরুতে ভয় পাবে। ওরা যা করার ঘরে বসেই করবে।’
অলকের মা কেঁদে উঠলেন। ‘হায় হায় কে যে এমন করে আমাদের ছেলের মাথাটা চিবিয়ে খেল! এবার আমরা কোথায় যাব।’
এসব শুনে মন খারাপ হয়ে ছিল সুদামবাবুর। অলকের বাবা মাকে কি বোঝাতে যাবেন তিনি! একটা ভালো ছেলে বাবা মায়ের দায়িত্ব নেবার জন্য উপার্জন করতে চায়। এই মানসিকতাও তো সবার হয় না। সব ভেবে নিজেকে খুব অসহায় মনে হল সুদামবাবুর।
শুনতে পেলেন কে যেন চিৎকার করে বলছে, রাম হবে, খেলা হবে। একবার, দু’বার, তিন বার শুনে তিনি পুলকিত হলেন। মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল। আহা যদি রামও হয় আর খেলাও হয় তবে তো সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এবার থেকে আর কোনো ঝামেলা থাকবে না।
কোথাও মারপিট হবে না। ঘর, বাড়ি, দোকান ভেঙে বা জ্বালিয়ে দেওয়া হবে না। মেয়েদের অপমান করা হবে না। কেউ মারা যাওয়ার পরে হেঁটে গিয়ে নিজের গলায় দড়ি বেঁধে গাছের ডালে সজনের মতো ঝুলে থাকবে না।
সুদামবাবু আবার শুনলেন, রাম হবে, খেলা হবে। মনের মধ্যে ময়না পাখি যেন ডেকে উঠল। বাহবা বেশ হবে, বেশ হবে। এই তো চাই।
সকালবেলা পাড়ার গলিতে ঢুকে কানের দুয়ারে এসে গেছে ঘোষণা। চেনা কন্ঠস্বর মনে হল। কান পেতে ভালো করে শুনলেন। এ তো ভজার গলা মনে হচ্ছে। ভজা রোজ সকালে সবার দুয়ারে সবজি নিয়ে আসে। বাজার থেকে একটু দাম বেশি নিলেও জিনিসপত্র খারাপ দেয় না। সেই ভজা বলছে! রাম হবে, খেলা হবে! প্রশাসন তাহলে ভজাকে প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছে? সবজি ফল বিক্রি করার পাশাপাশি ও তাহলে প্রচারের কাজও পেয়েছে নিশ্চয়ই। তাহলে ভজারও ডবল ডবল কাজ হয়েছে।
আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে নিলেন সুদামবাবু। বাজারের দিকে আজ আর যাবেন না। ভজার কাছ থেকে সবজি নিয়ে ভালো করে জানতে হবে সব। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই প্রচুর লোকজন বেরিয়ে পড়েছে, এমন সুন্দর দিন উপভোগ করবার জন্য। ভজা ওর যোগ্যতা মতো ডবল কাজ পেয়েছে।
তাহলে অলকও ওর যোগ্যতা মতো ডবল চাকরি পাবে। ছেলে মেয়েদের আজই ফোন করবেন। বলবেন, অন্য প্রদেশে একটা চাকরির জন্য না থেকে বাড়ি চলে আসতে। যদি রামও হয় আর খেলাও হয় তবে তো এখানে ডবল চাকরি।
অমলার জন্য কষ্ট হয়। ছেলেমেয়ের কথা ভেবে গোপনে চোখের জল ফেলে। তাঁকে বুঝতে দেয় না। সুদামবাবু নিজেও কি কম কষ্ট পান। সে কথা আবার অমলাকে বলতে পারেন না। এখন সব সমস্যার সমাধান।
ভজা ওর ভ্যান চালিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। দ্রুত হেঁটে ভজার পিঠ চাপড়ে বাহবা দিতে ইচ্ছে করল। এই সকালে বড়ো সুন্দর কথা শুনিয়েছে ভজা।
ভজার সামনে হাজির হলেন সুদামবাবু। ভজা চিৎকার করে বলছে, আম হবে কলা হবে। ওর ভ্যানের উপরে আজ সবজি নেই থরে থরে সাজানো আম আর কলা।
সেদিকে তাকিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়লেন সুদামবাবু। নানা জটিলতায় শরীরের অন্য কল কব্জার মতো তাঁর কানের অবস্থাও ভালো না। তা না হলে ভজা যখন বলছে আম হবে, কলা হবে তিনি মনের আশা ও বিশ্বাস নিয়ে এতটাই ভুল করলেন! তিনি শুনলেন যে, রাম হবে, খেলা হবে!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।