সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ২২

গল্প নেই – ২২

আমি একটি কেন্দ্রীয় সরকারি আবাসনে বহুদিন বসবাস করেছিলাম। তার আগে কয়েকটি ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। প্রায় সবকটিই ছিল ঘিঞ্জি অঞ্চলে। বাড়িওয়ালা ভাড়াটে সম্পর্ক সবসময় ভালো হয় না। সেটা সবাই বলে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ধরেই নিয়েছিলাম যে আমিই খারাপ লোক। সময় মতো ভাড়ার টাকাটা দিয়ে দিই। যথাসম্ভব ভদ্র ব্যবহার করি। এটা অবশ্যই একজন বাড়িওয়ালার পক্ষে ক্ষতির কারণ। কেননা আমি ভালো ব্যবহার করলে তিনি হয়ত এগারোমাস পরে আমাকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে বলতে পারবেন না। ফলে অন্য কাউকে বেশি টাকায় বাড়ি ভাড়া দিতে পারবেন না।
কোয়াটারের জন্য দরখাস্ত করে রেখেছিলাম অনেকদিন আগে। যেদিন সেটা পাওয়ার চিঠি হাতে পেলাম সঙ্গে সঙ্গে পিঠে যেন দুটি ডানা। দেখতে গেলাম সল্টলেকের কোথায় সেটির অবস্থান।
সেখান থেকে অফিসে যাতায়াত খুব আরাম ও সুবিধের ছিল না। তবুও জায়গাটি খুব পছন্দ হয়ে গেল। এর আগে অন্য প্রদেশে অনেক সাজানো আবাসনে বন্ধু, আত্মীয় ও আমার ভাইদের বাড়িতে গিয়েছি। দেখে ভালো লাগত।
সল্টলেকের তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে অন্য প্রদেশের সাজানো আবাসনগুলির কথা মনে পড়ত। চারদিক কেমন ফাঁকা। হাওয়া এসে খেলত ব্যালকনিতে।
মনে হত এই বাসস্থান অনেকদিনের জন্য আমার। এখানে কেউ আমাকে এগারোমাস পরে উঠে যেতে বলবে না। নগদ টাকা গুনে দিতে হবে না কারও হাতে।
একদিন ভোরে শাঁখ বাজানো শব্দে ঘুম ভাঙল। সরস্বতী পুজোর সকাল। সে দিনটিতে অন্যত্র যাওয়ার ছিল। ফিরে এসে যারা পুজো করছিল তাদের সঙ্গে দেখা করে খুশি হয়ে চাঁদা দিলাম। আলাপ হল অনেকের সঙ্গে।
সেখানে বসবাস করতে করতে কিছুদিন বাদে নানান সমস্যার মুখোমুখি হলাম। আবাসনে একের পর এক লোক আসছে। কি এক আইনি জটিলতায় ওই আবাসন তৈরি হয়ে পড়েছিল বহুদিন। দেওয়া হচ্ছিল না সরকারি কর্মচারীদের। দেওয়াতে কত মানুষের যে উপকার হল।
এমন কিছু সরকারি কর্মী তাদের নিজস্ব বাড়ি থাকতেও তারা কোয়াটারের জন্য আবেদন করেছিল। তারা কোয়াটার পেয়ে সেখানে বসবাস করল না। ছাড়লও না। স্থানীয় দালালচক্রের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বেশি টাকায় সেগুলি ভাড়া দেওয়ার বন্দোবস্ত করল।
তারা কিছু বাড়তি টাকা প্রতিমাসে রোজগার করতে পারল, কিন্তু যারা সেখানে বসবাস করত তাদের কাছে সমস্যা দেখা গেল নানারকম। যারা এই আবাসনে কোয়াটার ভাড়া নিয়ে থাকত তারা সরকারি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের মতো নয়। তাদের আদব কায়দাই আলাদা। ওদের প্রচুর পয়সা। গাড়ি। সেই বাড়ির মহিলার শাড়ি, গয়না দেখলে অবাক হয়ে যেত আবাসনের অন্যান্য মহিলারা। যারা স্বামীর সামান্য আয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাত। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাত।
এই মহিলাদের নিজেদের স্বামীর প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে লাগল। সবার ধারণা এই আবাসনে যখন থাকে তখন নিশ্চয়ই সবাই একই রকম মাইনে পায়। ওরা যদি গাড়ি কিনতে পারে, নিজেদের ঘর সাজাতে পারে, বউকে অঢেল গয়না কিনে দিতে পারে তাহলে তাদেরর স্বামীদের পয়সা যায় কোথায়!
এই প্রশ্ন একটু একটু করে শুনতে শুনতে যখন বিষয়টি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল তখন একটু খোঁজ খবর নিতেই হল। জানা গেল যারা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে তারা যেমন সরকারি কর্মচারী নয় তেমন তাদের সঙ্গে যে মহিলাটি থাকে সে বৈধ স্ত্রী নয়।
সল্টলেকের এই নির্জন আবাসনে নিজের স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সকলের কাছ থেকে গোপন করে এক অবৈধ সম্পর্ক কায়েম করে ভাড়া নিয়ে আছে লোকটি।
আবাসনের বেশিরভাগ মানুষ গৃহস্থ। তাদের জীবনযাপনের ছকটা কেমন টাল খেয়ে গেল। এসবের জন্য তো বিশেষ পাড়া থাকে সেখানে গিয়ে থাকলেই তো হত। তা না করে মধ্যবিত্তের কোনোরকমে চালিয়ে নেওয়ার সুস্থ জীবনের নাকে ঝামা ঘসে দেবার জন্য আরও নানা ধরণের অনৈতিক ভাড়াটের দল আসতেই থাকল দালালচক্রের পয়সা রোজগারের প্রয়োজনে। দু’একটি মধুচক্রের কারবারের খবরও পাওয়া গিয়েছিল তখন।
ওখানে অনেক খালি ঘর ছিল। ভোটের আগে সেইসব খালি ঘরগুলোতে লোক ভর্তি হয়ে যেত। ভোটের দিন দেখতাম কার্ড হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত তারা। একটা রাজনৈতিক দলের ভোটে জেতার জন্য তাদের ক্যাডারদের অতি সক্রিয়তায় এলাকাটা অনেক অপরিচিত লোকজনে সেই সময়টায় ভর্তি হয়ে যেত।
ওই অঞ্চলে শুধু বালি। গরমের দিনে হত অসম্ভব গরম। আবার ঠান্ডার দিনে অতিরিক্ত ঠান্ডা। আর চারিদিকে তখন ছিল অজস্র বিষাক্ত পার্থেনিয়াম গাছ। আরও নানারকম আগাছা।
আরেকটি বিপদ শুরু হল। যেসব বাসিন্দারা সেখানে তখন সবে এসেছে তারা তাদের জানালা বা ব্যালকনি দিয়ে ঘরের বর্জ্য ফেলত যেখানে সেখানে। রাস্তার কুকুর সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলত রাস্তায়। কেউ চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে মুখের গয়ের ভাসিয়ে দিত হাওয়ায়। কেউ বা তিনতলা থেকে শাড়ি মেলত এমন করে যেটা দু’তলার ব্যালকনি ঢেকে ফেলত অনেকটা। জল পড়ত। এমন ছোটোখাটো অনেককিছু যা নিয়ে বচসা হত। হত অশান্তি। এইসব লোকগুলিকে দেখলে মনে হত যেন তাদের সমাজে ঠিকমত বসবাস করার কোন দায় নেই। শেখেওনি কখনও।
ফলে দায় নিতে হল বেশ কিছু মানুষকে। ঠিক করা হল অনেক নিয়মের কথা বলতে হবে মানুষকে। সব মিলিয়ে ওই আবাসনে প্রায় নশোর উপরে ফ্ল্যাট। কাজটা তেমন সহজ ছিল না।
সবাই মিলে বসে ঠিক করল ভাড়াটে রাখা যাবে না। সরকারি কর্মী যদি নিজে না থাকে তবে কোয়াটার ছেড়ে দিতে হবে।
দালালচক্রকে মদত দেওয়া যাবে না।
যাবতীয় বর্জ্য নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। পরিবেশবন্ধুরা সেখান থেকে নিয়ে বাইরের ভ্যাটে ফেলে আসবে।
আবাসনে গাছ লাগাতে হবে।
পুজো থেকে শুরু করে নানান গঠনমূলক অনুষ্ঠান করতে হবে।
গেটে সিকিউরিটি রাখতে হবে যাতে যে কেউ যখন তখন মালপত্র নিয়ে বসবাসের জন্য দালালের হাত ধরে আবাসনে ঢুকে পড়তে না পারে। এমন আরও অনেককিছু।
বেশ কয়েকজন মানুষ মিলে যখন আমরা কাজ শুরু করলাম। তখন দেখলাম প্রচুর মানুষ আমাদের সমর্থন করলেন। সঙ্গে এলেন। থাকলেন। এই কাজে অফিসে কে কোন উচ্চপদে কাজ করেন তার কোন খোঁজ কেউ নিত না। কেউ মুই কি হনু বলে নিজের পরিচয়ও দিত না। আমারা অনেক মানুষ মিলে একটা স্বপ্নের বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলাম। এখানে আমরা সবাই বাসিন্দা। সবাই এক।
একদিন শুনলাম দালালচক্র ও ভাড়াটেরা বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে আমাদের একজনকে ঘিরে ধরেছিল মারবার জন্য। প্রায় শ’দুয়েক লোক।
পরদিন একটা সভা করার কথা বললাম। সকাল থেকে মাইক নিয়ে প্রচার করে আবাসনের সবাইকে বিকেলে সভায় আসতে বলা হল। মাইকের দখল একসময় চলে গেল ভাড়াটেদের হাতে। তাদের এখানে থাকতে দিতে হবে। এই হল তাদের বায়না। এই অধিকার কায়েম করবার জন্য সবাই মিলে চিৎকার করতে শুরু করল।
আমাকে একজন কিছু বলতে বলল। ওটাই বোধহয় ভুল করে ফেলেছিল।
তখন আমার মাথায় যেন আগুন জ্বলছে। যাকে মারবার জন্য সবাই এসেছিল তাকে পাশে ডেকে নিলাম। আমার পাশে এসে দাঁড়াল আরও অনেকে।
যখন বলতে শুরু করলাম তখন সময়ের কোনো হিসেব ছিল না। দেড়ঘন্টার মতো বলে শেষে বললাম, ‘যারা আমার এই আবাসনের একজন বাসিন্দাকে মারবার জন্য এসেছিল ও যারা মদত দিয়েছিল তাদের এরপরে কিছু বলার আছে?’
কেউ আর কিছু বলার জন্য এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি সেদিন।
প্রচুর মানুষ আমাদের সঙ্গে নানা কাজে শামিল হয়েছিল। কাজের আনন্দে মেতে ছিলাম আমরা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।