• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – তেইশ 

টুকরো হাসি – তেইশ

তোমাদের কি করে চলবে

এতদিন হয়ে গেল একটা চাকরিও জোটাতে পারলে না? ছি! ছি! এ জীবনে করলেটা কি? মোনালিসা বলল।
কি করলাম তোমাকে বোঝাতে পারব না। তুমি বুঝবেও না। হতাশ হয়ে বলল উল্লাস।
কবে থেকেই তো বলছ এবার চাকরিটা হয়ে যাবে। চাকরি হয়ে গেলেই বিয়ে করবে। খালি নক্কা ছক্কা। হচ্ছে আর কোথায়? এখন আবার নতুন গান শুরু করেছ যে, প্যানেলটা নাকি বাতিল হয়ে গেছে। খালি চালাকি হচ্ছে। আমার সঙ্গে চালাকি করতে তোমার খারাপ লাগে না?
উল্লাসের সমস্ত আনন্দ বেশ কয়েক বছর ধরে নিভে গেছে। খুব আশা করেছিল তার যা যোগ্যতা তাতে একটা ভদ্রগোছের চাকরি পাবে। তাতে বাবা, মা, বোনকে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। বোনের বিয়ে দিয়ে সে নিজেও বিয়ে করবে। তার সমস্ত স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেছে। চাকরি কোথাও নেই আছে তিন চার হাজার টাকার মোসাহেবি। লেখাপড়া শিখে ওসব করবে কেন!
মোনালিসা বলল, কত ছেলেরা কত কিছু করছে। তুমি কিছুই করতে পারছ না। 
কে কি করছে? কেউ কিছু করতে পারছে না। গিয়ে দেখ ঘরে ঘরে সবারই আমার মতো অবস্থা।
তুমি শুধু তোমার মতো লোকজনদেরই দেখ। তুমি অনেক খবর  শুনতে পাও না। তুমি জান এমন কেউ আছে যে মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রাসাদের মতো একটা বাড়ি বানিয়েছে, তার কয়েক হাজার কোটি কোটি টাকা। আমার সেই বাড়িটা দেখতে ইচ্ছে করে। দেখার তো উপায় নেই। শুনেছি সেই বাড়ির সামনে নাকি যাওয়াই যায় না। চারিদিকে পাহারা। আচ্ছা তুমি একটা ওই রকম বাড়ি বানাতে পার না?
আমাদের মাত্র তিনকাঠা জমি আছে। ঠাকুরদার কেনা। একটা সময় ছিল খালি জমি দেখলেই ঝান্ডা নিয়ে তা দখল হয়ে ক্লাব করা হত। তাই ঠাকুরদা তাড়াতাড়ি কোনোরকমে একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল। ওই সামান্য জমিতে আর কিছু হওয়ার নয়। শুকনো হাসি হাসল উল্লাস।
তবে আশেপাশে যত জমি বাড়ি আছে সব দখল কর না। দখল করেও তো কত লোকে নাম করেছে। লোকে জানে, আলোচনা করে। গালাগাল দেয়। তবে কিছু করতে পারে না। তুমি যদি দুকান কাটা হতে তবে আর আমাদের দুঃখ থাকত না। ত্রিশ পঁয়ত্রিশটা বা তার চেয়ে বেশি ফ্ল্যাট আমাদের হত।
কথা বলতে বলতে মোনালিসার চোখ কেমন ঝিকমিক করতে লাগল। উল্লাস দেখল ওর দুচোখে কত স্বপ্ন। বলল,জান উল্লাস, আমার ইচ্ছে করে আমি সিঁড়ির উপরে দাঁড়ালেই সিঁড়ি যেন আমাকে নিয়ে দোতলা, তিনতলা যেখানে যেতে চাইব সেখানে নিয়ে যায়। মেট্রো স্টেশনে গেলে যেমন হয়। আমি চাই আমার বাড়িতেও যেন তেমন হয়।
বাড়িটা তো স্টেশন বা মল নয় যে, ওই রকম সিঁড়ি থাকবে।
ও মা! তুমি দেখছি কোনো খবরই রাখ না। আমি সেদিন খবরের কাগজে পড়েছি একজনের বাড়িতে ওইরকম আছে। শোন না তুমি একটু খোঁজ খবর নাও না কীভাবে ওইসব করা যায়। শুনেছি গরু,কয়লা,বালি,মাটি এইসব নিয়ে ইধার উধার করতে পারলেই প্রচুর টাকা। কোটি কোটি। ওফ্‌ কল্পনা করতে পারবে না। তুমি যদি তা করতে পার আমি কথা দিচ্ছি আমিও তোমার মুখ উজ্জ্বল করবার জন্য সোনা পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাব। দেখবে আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না।
উল্লাস মোনালিসার দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ের নামে মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেল! কত কিছু পেতে চাইছে। ভেবেছে কি? চোরা কারবারে যেন সবার সমান অধিকার থাকে এই আন্দোলনে নাম লেখাবে নাকি! ও জানে না যে এখনও কত মানুষ ঠিক মতো খেতে পায় না। তাদের খাবার লুঠ হয়ে যায়। বাড়ি অর্ধেক হয়ে পড়ে থাকে। বাকি টাকা লুঠ। চাকরি নেই। চিকিৎসা নেই। সে বলল, মোনালিসা তোমার ভাবনাগুলি বদলাও।
মোনালিসা বলল, আমি যা ভাবছি, ঠিকই ভাবছি। তোমাকে যা বললাম তুমি তাই নিয়ে ভাব। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। যোগাযোগ কর। তোমাকে অনেক বড়ো কাজ করতে হবে। তোমার যা মতিগতি দেখছি তুমি হয়ত চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে অন্যের গাড়িতে বা মিছিলে আধলা মারবার কাজ নেবে। বোমা মারবে। দেশপ্রেমের জন্য কারও উসকানিতে এইসব কাজ আমি তোমাকে করতে দেব না। এসব করতে গিয়ে তোমার কিছু হলে তোমার বাবা মা কাঁদবে। বোন কাঁদবে।
উল্লাস বলল, তুমি কাঁদবে না?
না আমি কাঁদব না। তোমার ওই ফালতু কাজে আমার একটুও কান্না পাবে না। একটা জীবন তো জীবনের মতোই হয়। তোমার ঐ ফালতু কাজ করতে লজ্জা করবে না? তুমি একবারও ভেবে দেখবে না যে তুমি এইসব করার জন্য জন্মাওনি। আমার কাছে তো মাঝে মাঝে কত অফার আসে। টিভি খুললেই শুনতে পাই আমাকে নাকি হাতা খুন্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। কেন আমি কি ফেকলু নাকি? এটা কোনো ইজ্জতের কাজ হল? টিভিতে তো আর বলা যায় না। বলা গেলে বলতাম আপনার বাড়ির লোককে বলুন হাতা খুন্তি নিয়ে বেরুতে। তা বলবে না।  তার চেয়ে অনেক ইজ্জত যদি আমাদের পিছনে ইডি সিবিআই ঘোরে। ভাব তো ওরা শুধু বছরের পর ঘুরবেই। আর মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ওটাই ওদের খই ভাজা কাজ। ওরা  জীবনে কিছু করতে পারবে না। আমরা আরামে বসে ঘরের খাব আর ওরা বনের মোষ তাড়াবে।
উল্লাসের মাথা ঝিম ঝিম করছে। বলল, থাম তো।
মোনালিসা বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ? অত টাকা তোমার কাছে রাখতে না চাইলে আমার বাবা, মা, ভাই, বোন আছে ওদের নামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে পার। আমার দিদির বর তার বাবা মা ওদের নামেও তো রাখা যায়। ওদের বাড়িতেও না হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যাবে। তো যাক না। এতে তো ওদের সম্মান বাড়বে। বড়ো মুখ করে বলতে পারবে যে ওদের বাড়িতে সিবিআইয়ের, ইডির লোকজন এসেছিল। সবরকম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাহায্য করেছে। এই তো চলবে বছরের পর বছর। আমাদের দেশে তো এসবের জন্য কারও শাস্তি হয়েছে বলে শুনিনি। শাস্তি থাকলে কেউ এত সাহস পায়?
উল্লাস বলল, আমি ওসব কাজ করতে যাব কেন? আমি তো ভদ্রলোকের সন্তান। ছেলে মেয়েদের পড়াই। তাতে যা পাই তাই দিয়ে চালিয়ে নিতে হয়। দেখা যাক না। এইরকম দিন থাকবে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই হবে।
তুমি ওই আশাতেই থাক। আমি তো তোমাকে কারও কথায় বখাটে ছেলে হতে দেব না, আর আমিও ঝগড়ুটে মেয়ে হব না। আমাদের আর ভরকি দিয়ে নিজের মতো করে কেউ চালাতে পারবে না। আমরাও ওদের মতো ইধারকা মাল উধার করব। বিদেশের সঙ্গে সম্প্রীতি গড়ে তুলব। ওখানে টাকা রাখব। মাঝে মাঝে এখান থেকে হাওয়া হয়ে ওখানে গিয়ে নবাবের মতো থাকব। দেশের এইসব যত হাভাতেগুলো টেরও পাবে না। 
একটু  থেমে দম নিয়ে মোনালিসা বলল, সবাই আমাদের চিনবে। আমাদের নাম শুনলে সবার গা ঘিন্‌ ঘিন্‌ করবে। আমাদের নিয়ে কথা বলবে। তাতে আমাদের নাম ফাটবে। ওফ্‌ আমার তো ভাবতেই কেমন লাগছে। আমার খুব শখ জান। আমাদের প্রচুর টাকা থাকবে আর লজ্জা থাকবে না। যে যা বলুক কিচ্ছু কানে তুলব না। আর নিজেদের শোধরাবার চেষ্টাও করব না।
উল্লাস বলল, আমি তোমার মতো করে ভাবতে পারছি না। আমি ছোটোবেলা থেকে যা শুনেছি তা বিশ্বাস করি। সদা সত্য কথা বলিবে। ভুলিও না সবাই তোমার ভাই। আমি মানুষ ঠকাবার কোনো প্রকল্প করতে পারব না। তা মন্ত্রী বা পাচারকারী কিছু হওয়ার জন্যও নয়। এতে তোমার যদি ভালো না লাগে তবে আমার কিছু করার নেই।
তুমি সারাদিন ছেলেমেয়েদের পিছনে বকবক করে কত পাও?
কুড়ি হাজারের মতো। অনেককে তো বিনে পয়সায়ও পড়াই।
মাত্র! আরও বেশি পেতে পার না?
পারতাম। যদি কোনো স্কুলে বা কলেজে পড়াতাম। তবে সবাই আমার কাছে পড়ত। নানান সুবিধা পেত। আমারও প্রচুর কালোটাকা আয় হত। কেউ ধরতেই পারতই না। আমার তাও হবার নয়।
মাত্র কুড়ি হাজারের মতো? ওই টাকায় তোমার চলে?
অনেক কষ্ট করে চালাতে হয়। তার উপর আছে বোনের বিয়ের চিন্তা। বাবার একার পক্ষে তো সম্ভব না।
যা বাব্‌বা। তবে তো তোমাকে বিয়ের কথা বলাই যাবে না। মোনালিসা হতাশ হয়ে বলল।
উল্লাস বলল,  কেন এই কুড়ি হাজার টাকায় তুমি চালিয়ে নিতে পারবে না?
মোনালিসা একটু ভাবল। বলল, সে না হয় আমি কুড়ি হাজার টাকায় আমার হাত খরচটা কষ্ট করে চালিয়ে নেব। আরপর? তুমি তোমার বাবা, মা, বোন তোমরা  কি করবে? তোমাদের কি করে চলবে?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।