সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ১১)

বেনু মশলাঘর

ক‍্যাশের গদিতে বসে অন‍্যমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী একটা ভাবছিল বেনু। হাজী বক্কর আলী জরুরি কাজে শহরের দিকে গেছে সেই ভোরে, এখনো ফেরার নাম নাই তার। অগত‍্যা নিজের জায়গায় ছোকরা কর্মচারীটাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে ক‍্যাশ সামলাতে বসেছে সে। আদতে ক‍্যাশ আর নিজের কাজ দুই ই দেখতে হচ্ছে তাকে। কর্মচারি ছেলেটা একেবারেই নতুন, কাজ বোঝে না মোটেই। ফলে ক‍্যাশে বসেও তাকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে মেশিন ঠিকমতো চলছে কি-না সেদিকটাতে। গদিতে বসে হঠাৎই খানিকটা অন‍্যমনস্ক হয়ে উঠেছিল বেনু। শীতের বেলা, চড়ে উঠেছে ভীষণ। সামনের রাস্তার পাশের খোলা জায়গাটাতে জারুল গাছের ছায়া পড়েছে ঘন হয়ে, সেখানে মুকুল মাসী বসে চিতই আর ভাপা বানাচ্ছে সকাল থেকে, বিক্রিও হচ্ছে দেদারসে, প্রতিদিনই হয়। বকুল মাসীর পিঠার বেশ চাহিদা এখানে। লোভ হল বেনুর। ইচ্ছে হল একটা ভাপা অথবা চিতই কিনে খায় আয়েশ করে। ভাবনাটার সাথে আরো একটা ভাবনা এসে আছড়ে পড়ল মনে। চালের পিঠা খাওয়া নিষেধ তার। ডাক্তারের বারণ। খেলেই এসিডিটি বাড়ে, পেট ফুলে ঢোল হয়ে ওঠে। শরীর যে কী করে এত অবাধ‍্য হয়ে উঠল তার, কবে থেকে হয়ে উঠল এমন বেয়াড়া! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বেনু হতাশায়। কিন্তু ইচ্ছেটাও অনবরত খোঁচাতে থাকল বেহায়া সূঁচের মতো। খানিক ভাবল বেনু। হাজী সাহেব আপাতত নাই এখানে, কণাও হোস্টেলে গেছে অনেকদিন। মেহেরবানু নামক আপদটাও ভেগেছে নিজের থেকে। একটা ধোঁয়া ওঠা গরম চিতই ধানি কাঁচামরিচ দিয়ে করা শুঁটকি বা ধুনেপাতা ভর্তা দিয়ে খাওয়াই যায় এই ফাঁকে। কেউ দেখার নেই। ভাবতেই জল এসে গেল জিভে। অগত‍্যা চোরা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিল সে। নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ তাকে খেয়াল করছে কি-না। অতঃপর নিজের অবশপ্রায় ডানপাশ নিয়ে ক‍্যাশবাক্সের সামনে থেকে উঠল সে। ডানহাতে লাঠি নিয়ে ধীরগতিতে পা টেনে টেনে এগোল মুকুল মাসীর পসরা লক্ষ্য করে। গরম চিতই পিঠা আর ঝাল শুঁটকির ভর্তা। আহা। অমৃত। পরপর তিনটা চিতই খেল বেনু। ভাপাও খেল একটা। কী আছে জীবনে, সেই তো মরতেই হবে, এইভাবে ল‍্যাংচাতে ল‍্যাংচাতে বাঁচার মানেও হয় না কোনো। তারচে যদ্দিন বাঁচি ইচ্ছেগুলো পূরণ করে বাঁচি, অতৃপ্তি নিয়ে মরাটা কোনো কাজের কথা না, আনমনে ভাবল সে। মুকুল মাসীর ঘড়া থেকে জল ঢেলে খেল ঢকঢক। তৃপ্তির ঢেকুর তুলল সশব্দে। টাকা গুণে দিয়ে ফেরার জন‍্য পা বাড়াতেই নজর গেল ওদিকটায়। টোটন। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে সিগারেট টানছে। ধোঁয়া ছাড়ছে এদিকেই। দুম করে মাথায় রক্ত চড়ে গেল বেনুর, মেজাজ গেল বিগড়ে। টোটন শহরে এসেছে। অথচ তাকে জানায়নি পর্যন্ত!
দ্রুত হাঁটতে পারে না সে আজকাল। শুয়োরের বাচ্চা শরীর বিশ্বাসঘাতকতা করে। অবশপ্রায় ডানপাশ তাকে এগোতে দেয় না সামনের দিকে। স্রেফ মনের জোরে আর বামপাশের সহযোগিতায় চলে। আপ্রাণ চেষ্টা করল বেনু টোটন তার কাছাকাছি পৌঁছনোর আগেই নিজের জায়গায় ফিরতে। পারল না কিছুতেই। টোটন কাছাকাছি পৌঁছে গেল তার। একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল বেনুর দিকে। রাগে গা জ্বলে গেল বেনুর। লাল হয়ে উঠল চোখ-মুখ। আগুনগলায় বলল, মজা নেও আমার সাথে? মস্করা করো?
যা বাবা! আমি আবার কী করলাম? -টোটনের বেকুব বনে যাওয়া কণ্ঠে নিখাদ বিস্ময়।
আমার মুখের উপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ো ক‍্যা? আমারে কি মানুষ মনে করো না না-কি? চোখে ধরে না?
কী কও না কও! তোমার সাথে দেখা করতেই তো আসলাম এদিকে। তোমার মুখে ধোঁয়া ছাড়ব না তো কার মুখে ছাড়ব আর?
-টোটনের সহজ জবাব। মুখে দুষ্টুমির হাসি। বেনুর মেজাজ খারাপ হল আরো। মুখ বিকৃত করে বলল, আলগা পিরিত দেখানোর আর জায়গা পাও না, না? আমি তো পঙ্গু এখন। প‍্যারালাইজড। আমার সঙ্গে দেখা করার কী আছে আবার? রাস্তায় দেখা হয়ে গেল তাই। নইলে তো জানতামও না যে শহরে আসছ। আসবে যে সেটাও জানাওনি পর্যন্ত।
টোটন ধমক দিল মৃদু। নিচু গলায় বলল, পাগলামি করো ক‍্যান এত? এদিকটায় আসার তুমি ছাড়া অন্য কারণ নাই সেইটা তো নিজেও জানো। আর আসার কথাটা ইচ্ছে করেই জানাইনি। হুট করে চলে আসছি।
কথা বলতে বলতে মশলাঘরের সামনে চলে এসেছে তারা ততক্ষণে। টোটনের জবাবে কিছুটা শান্ত হল বেনু। ভেতরে তাকিয়ে দেখল এক নজর। হাজী বক্কর আলী তখনও ফেরেনি। টোটনের দিকে ফিরে বলল, আসছ কবে?
রাতে আসছি।
এবার এখনো সাইক্লিং এ যাও নাই যে?
যাব সামনের সপ্তায়। মার জন‍্য আসলাম। মা কিছুতেই দেখা না করে ছাড়বে না।
ও। -বেনুর শীতল জবাব। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার অস্বস্তিতে ঘেমে উঠেছে সে। টোটন বুঝল। বেনুর দিকে চোখ রেখে বলল, তোমার শরীরের কী অবস্থা? বের হতে পারবে ঘণ্টাখানেকের জন্য?
পারব। -বেনুর জবাবটা মরিয়া শোনাল খুব।
আমি তাহলে মোড়ের ওদিকে গিয়ে দাঁড়াই, তুমি রেডি হয়ে আসো। -বলল টোটন।
ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল বেনু। শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এগোল বাড়ির দিকে। সেদিকে তাকিয়ে মনটা মুচড়ে গেল টোটনের। বেনু! সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা! কেমন এলোমেলো হয়ে গেল জীবনটা তার। বেনুর বাবার বোকামি আর টোটনের মায়ের জিদের বলি হয়ে কেমন নষ্ট হয়ে গেল দু দুটো জীবন তাদের। কিন্তু তার নিজেরও কি দায় ছিল না তাতে? সে নিজেও কি সিরিয়াস ছিল সে সময় বেনুকে নিয়ে? পক্ষাঘাতে পর্যুদস্ত বেনুর অপসৃয়মান ছায়ার দিকে তাকিয়ে তীব্র অপরাধবোধে ভরে উঠল টোটনের মন। তার বোহেমিয়ান স্বভাবও কম দায়ী নয় আজকের এই অবস্থার জন‍্য, ভাবে টোটন। মাত্র চল্লিশের কোটায় দাঁড়িয়ে বেনুর এই অসুস্থতা টোটনকে পীড়া দেয় অনবরত। অশান্ত হয়ে ওঠে মন।
Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!