সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ২২)

কলকাতার ছড়া

সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এলেন মিস মেরি কার্পেন্টার। কে তিনি? আমাদের শহর কলকাতার সাথে কী তাঁর যোগ? এ এক আশ্চর্য গল্প। গল্প হলেও একেবারে জীবন্ত ইতিহাস। কলকাতা তথা এ দেশের বিদ্ব্যৎসমাজের কাছে আজও তিনি প্রণম্য। একসময় তাঁর অদম্য কর্মকাণ্ডের ধারে ও ভারে মাথা ঝুঁকিয়েছে শহর কলকাতা। বাঙালী মুখে মুখে ছড়া করে বলেছে –

“অতি লক্ষ্মী বুদ্ধিমতী এক কবি এসেছে
ষাট বৎসর বয়স তার বিবাহ না করেছে।
করে তুলেছে তোলাপাড়ী এবার নাই কো ছাড়াছাড়ি
মিস কার্পেন্টার সকল স্কুল বেড়িয়ে এসেছে।
কি মাদ্রাজ কি বোম্বাই সবই দেখেছে
এখন এসে কলকাতাতে বাঙালীদের নে পড়েছে।”

ইংল্যান্ডে থাকাকালীনই তাঁর কর্মকাণ্ডের শুরু। বাবা ল্যান্ট কার্পেন্টার একেশ্বরবাদী ধর্মযাজক। ইংল্যান্ডে নিজের বাড়িতেই একসময় তিনি পেয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায় ও মহাত্মা ডক্টর টকারম্যানকে। রাজা রামমোহন ভারত থেকে বিলেতে গেলে ব্রিস্টলে ল্যান্ট কার্পেন্টারের মত উদারমনা ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তাঁর বাড়িতেই কিছুদিন আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন বাংলার নবজাগরণের আধুনিক পুরুষ। বাবার বন্ধু রাজা রামমোহনের থেকেই কিশোরী কার্পেন্টারের প্রথম ভারতদর্শন ও ভারতপ্রেম। কিন্তু তিনি ভুলটা করে ফেলেছিলেন একটি জায়গায়। রামমোহন রায়কে দেখে তিনি ধারণা করেছিলেন আপামর ভারতবর্ষের মানুষের জীবন ও জীবনযাত্রাকে। কোনো এক অমোঘ টান থেকে জীবনের এক পরিণত পর্যায়ে একসময় উঠে পড়েন ভারত গামী জাহাজে। প্রথমবার বোম্বেতে নেমেই স্ত্রীশিক্ষা ও কারাসংস্কার নিয়ে তাঁর মনোজ্ঞ মতামত চায় ইন্ডিয়া গর্ভমেন্ট। বিলেতে তাঁর কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাড়া ফেলেছিল। এরপর বোম্বে, মাদ্রাজ, আহমেদাবাদের মত ভারতের বিভিন্ন শহর ঘুরে ও স্কুল পরিদর্শন করে ১৮৬৬ সালের শেষ দিকে তিনি এলেন বাঙালীর শহর কলকাতায়। ঘটনাচক্রে তখন সারা বাংলা জুড়ে মেয়েদের স্কুল খোলবার উদ্দেশ্য নিয়ে একরকম দৌড়ে বেড়াচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজে সরাসরি অধ্যাপনায় ইস্তফা দিলেও তিনি সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় তখন চালাচ্ছেন গার্লস স্কুল। সরকারী সাহায্য না পেয়েও টাকা ধার করে হলেও তুলে দিচ্ছেন স্কুল কতৃপক্ষের হাতে হাতে। আর ঠিক তখনই বেথুন কলেজ পরিদর্শনে এসে তাঁর দেখা হয় সদ্য কলকাতায় আসা মেরী কার্পেন্টারের সাথে। মিলে গেল বিশ্বের দুই পারের দুই কর্মপথিকের কর্মকাণ্ড। এরপর একসাথে তাঁরা ঘুরে পরিদর্শন করতে থাকেন বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে। মিস মেরী কার্পেন্টারের মত একজন বাগ্মী, শিক্ষাব্রতী বিদেশিনীর সরাসরি সাহায্য অনেকটা এগিয়ে দেয় যুগপুরুষ বিদ্যাসাগরকে। মেরী কার্পেন্টার, স্কুল ইন্সপেক্টর উড্রো সাহেবদের সাথে উত্তরপাড়ায় একটি স্কুল পরিদর্শন করে ফেরবার পথেই বালী স্টেশনের কাছে এক গুরুতর দুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে লিভারে চোট পান বিদ্যাসাগর মশাই। ঘোড়ার গাড়ি থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে থাকা সংজ্ঞাহীন ঈশ্বরের মাথা মাটিতে বসেই নিজের কোলে তুলে নেন মানবদরদী কার্পেন্টার। ছেলেবেলায় রামমোহন রায়ের চোখে দেখা ভারতবর্ষকে যে তিনি শুধু বুকে লালন করেছিলেন যত্ন করে তাই নয়, ভারতে নারীর দুঃখ চোখের সামনে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জীবন বাজি রেখে। ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা Six months in India বইটি। ভারতবর্ষে শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ ও কিশোর অপরাধীদের কারা আইন সংশোধনে তাঁর ভূমিকা মনে রাখবার মত। তিনি লক্ষ্য করেন মেয়েদের স্কুলে শিক্ষিকার অভাব। তখন প্রায় সব স্কুলেই পড়াতেন পুরুষ শিক্ষকরা। দিকে দিকে ফিমেল নর্মাল স্কুল খুলে তিনি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন শিক্ষিত মহিলাদের। তাঁর হাতেই তৈরি হয় বেঙ্গল সোসাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন। এরপর ব্রাহ্মনেতা কেশব চন্দ্র সেনের অনুরোধে দেশে ফিরে গিয়ে ব্রিস্টলে তৈরি করেন ন্যাশনাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। তৎকালীন ভারত ব্রিটেন সম্পর্কে এই সভা এক দৃঢ় পদক্ষেপ। ভারত পুনর্নির্মাণে মেরী কার্পেন্টারের অবদান আজ বিস্মৃতপ্রায়। ১৮৬৬ সাল থেকে ১৮৭৫ এর মধ্যে চারবার ভারতে আসেন তিনি। আজও বাংলার প্রতিটা নারী শিক্ষামন্দির সকলের অলক্ষ্যে কৃতজ্ঞতা জানায় এই সর্বজনপ্রিয় মহাত্মা বিদেশিনীকে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।