সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৩৪)

কেল্লা নিজামতের পথে

এভাবেই শুরু সিরাজের খামখেয়ালিপনা। আজ তার মাথায় নতুন কিছু চাপে তো কাল আবার অন্য কিছু। এভাবেই দিনের পর দিন দাদু তথা বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁয়ের প্রশ্রয়ে ধীরে ধীরে বাঙালী ছাপোষা সুশীল সমাজের কাছে মূর্তিমান বিপদ হয়ে ওঠে সিরাজউদ্দৌলা। তার খেয়ালের শেষ নেই। যেমন মাসি ঘষেটি বেগমের বিশাল মতিঝিল প্রাসাদ দেখে তার ঈর্ষার শুরু। তখন থেকেই আবদার, তারও চাই এমন একটি প্রাসাদ। কথায় বলে, বড় লোকের ব্যাটার খেয়ালের শেষ নেই। সিরাজও যেন ঠিক তেমন। হঠাৎ দাদুর কাছে আবদার করে বসলো, তারও চাই পেল্লায় এক প্রাসাদ। যে প্রাসাদ তার ধারে ও ভারে কোন অংশেই কম হবে না মতিঝিল প্রাসাদের থেকে। মতিঝিল এক মস্ত প্রাসাদ। ঘষেটি বেগম ও তাঁর স্বামী নওয়াজেশ মহম্মদের প্রাণের ও শখের বাড়ি। সেখানেই দত্তক পুত্র এক্রামউদ্দৌলাকে নিয়ে তাঁদের ছিল সুখের সংসার। কিন্তু বাদ সেধেছে এক্রামের আয়ু। এরপর বেশিদিন বাঁচেনি নওয়াজেশও। কিন্তু রয়ে গেছে ঘষেটির মতিঝিল। আর সেই মতিঝিল দেখেই সিরাজের ইচ্ছে তার নিজস্ব প্রাসাদের। মুর্শিদাবাদের নবাব ইতিহাসে সব নবাবেরই নিজস্ব প্রাসাদ বানাবার রীতির কথা আগেই বলেছিলাম। রাজ্যপাট বুঝে নিয়ে প্রথমেই একটি থাকবার প্রাসাদ ও একটি মসজিদ বানানোই ছিল নবাবদের প্রধান ও প্রথম কাজ। ঠিক যেমন মুর্শিদকুলীর কাটরা মসজিদ থাকতেও আবার নতুন নতুন করে মসজিদ বানিয়েছেন প্রায় প্রত্যেক নবাবই। এই ধারা অব্যাহত রেখে সিরাজও অল্প বয়সেই প্রাসাদ চেয়ে বসলেন দাদুর কাছে। এবং তা নিজে নবাব হওয়ার আগেই। আর প্রাণপ্রিয় নাতিকে মুখের ওপর না করবেন এমন চিন্তা কস্মিনকালেও করেননি নবাব আলীবর্দী খান। দিনের পর দিন তারই ফল ভুগতে হয়েছে স্বয়ং তাঁকেও। ফলে প্রাসাদের আবদারও ফেলে দিতে পারেননি তিনি। শুধুমাত্র সিরাজের জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন এক মস্ত প্রাসাদ। প্রথমে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে তার জন্য জমি পছন্দ করা হয়েছিল। এবং গৌড় থেকে মহামূল্যবান পাথর এনে তৈরি হল সেই প্রাসাদ। পাশেই তৈরি হল ঝিল। নাম হীরাঝিল। আর তার পাশেই তৈরি সেই মনোরম প্রাসাদ তাই হীরাঝিল প্রাসাদ। প্রাসাদ তো হলো। কিন্তু সেই প্রাসাদের জন্য দরকার প্রচুর কর্মচারী ও দাস দাসী। এবং সচ্ছলভাবে সবকিছু চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নবাব আলীবর্দীও৷ এক খাতের আয় অন্য খাতে গিয়ে খরচা করবেন এমন অগোছালো খামখেয়ালী শাসক তিনি নন। তাই সিরাজের প্রাসাদে বিস্তর খরচের জন্য চাই পৃথক আয়ের উৎস। সেই লক্ষ্যে প্রাসাদের পাশেই তিনি তৈরি করে দিলেন বাজার বা গঞ্জ। সিরাজের প্রাপ্ত উপাধীর নামানুসারেই জায়গাটির নাম হল মনসুরগঞ্জ। আর প্রাসাদের আর এক নাম হলো মনসুরগদী। আর চালু করা হল নতুন এক কর বা আবওয়াব ‘নজরানা মনসুরগঞ্জ’। এবার দাদুর চোখের আড়ালে চারদিক থেকে একরকম গুছিয়ে বসলেন সিরাজ। প্রাসাদের মধ্যে অগুণতি বিলাসবহুল ঘর। ইচ্ছেমতো রোজ রোজ থাকবার ঘর বেছে নেন যুবরাজ সিরাজ। তার খামখেয়ালি খেয়ালের কথা মাথায় রেখেই ভাগীরথীর তীরে প্রস্তুত সেই প্রাসাদ। প্রাসাদের মধ্যে ফোয়ারা, প্রচুর দাস দাসী আর বিলাস-ব্যসনের ব্যবস্থা।
প্রাসাদ তৈরি হবার পর সিরাজও হয়ে পড়ে উশৃঙ্খল। দামাল ও দুর্বৃত্ত বন্ধুদের আনাগোনা বেড়ে গেল প্রতিদিন। নিজের প্রাসাদ পেয়ে দাস দাসী পরিবৃত সিরাজ প্রমোদের আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতে বেশি দেরি করেনি৷ তাঁর স্বভাবের সাথে এটাই যে স্বাভাবিক তা বুঝতে খুব বেশি দেরি হয় কী? প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই সে মনেপ্রাণে যেন নবাব। তার নবাবীয়ানার শেষ নেই৷ আর তারই উৎকৃষ্ট জায়গা হয়ে উঠলো হীরাঝিলের অন্দরমহল। প্রাসাদ তৈরি হওয়ার পরে দাদু আলীবর্দীকেও হেনস্তা করতে ছাড়েনি সে। প্রাসাদ দেখতে আসা নবাবকে সে ছল করে ভেতরের ঘরে গোলকধাঁধায় বন্দী করে ফেলে। তারপর অনেক অনুরোধের পর মুক্তি হয় স্বয়ং নবাবের। এমনই ছিল সিরাজের খামখেয়ালিপনা।
তবে এসবকিছুর পরেও মনে আশা ছিল বৃদ্ধ নবাবের। নাতি সিরাজকে ভালো রাখতে কোন কিছু খামতি করেননি তিনি। কিন্তু বিগড়ে গেছে সিরাজ। তারপরেও নবাব ভাবেন মাথার ওপর রাজ্য ও রাজপাট পড়লে হয়ত সবদিক থেকেই বদলে যাবে আদরের নাতি। সেই রকম চিন্তা ভাবনা করে কিছুদিন পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় দেখভালের জন্য ও পরিদর্শন হেতু নাতিকে পাঠাতে শুরু করেন নবাব আলীবর্দী। ঠিক যেমন ১৭৫২ সালে সৈন্য সামন্ত লস্কর দিয়ে যুবরাজ সিরাজ পরিদর্শন করতে আসেন হুগলিতে। এ যেন আজকের যুগে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ইন্সপেক্টরের মত। হুগলির আশপাশে তখন বিভিন্ন ইউরোপিয়ান বণিকদের বাস। ভাগীরথীকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যের একটা প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই হুগলি অঞ্চল। যেহেতু ধীরে ধীরে একেবারে মজে গেছে সরস্বতী নদী ও সপ্তগ্রাম বন্দর, তাই বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ধীরে ধীরে উঠে এসেছে হুগলি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। আর এই হুগলি অঞ্চলে বাণিজ্য চালাতে ইচ্ছুক সমস্ত ইউরোপীয় বণিকগণ বাসস্থান তৈরি করেছে একে একে। তখন মুঘল নিয়োজিত ফৌজদার থাকতেন হুগলিতে। যেখানে কিছুকাল বাস করেছিলেন মহরাজা নন্দকুমারও। আর সেই হুগলিতেই নবাবের হয়ে প্রথম এলাকা পরিদর্শনে এলেন সিরাজ। এখান থেকেই তার প্রথম শাসক হওয়ার প্রস্তুতি। কিভাবে বিদেশি বণিকদের সাথে কথোপকথন করতে হয় এবং কোন উপায়ে সকলের মন রেখে এক সুচারু শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে হয় সেই শিক্ষা দেওয়ার জন্যই সিরাজকে মনোনীত করেন আলীবর্দী। তিনি বরাবরই চেয়েছিলেন তাঁর জীবদ্দশাতেই একজন প্রকৃত শাসক হয়ে উঠুক সিরাজউদ্দৌলা। তবে যাই হোক হুগলিতে সে এসে উপস্থিত হলে ওলন্দাজ ও ফরাসি কোম্পানি প্রচুর উপহার নিয়ে দেখা করতে আসে তার সাথে। মূল উদ্দেশ্য ছিল সিরাজকে খুশি করে নবাবের কাছে সেই সংবাদ পাঠিয়ে দেওয়া। পিছিয়ে ছিল না ইংরেজও৷ সেদিন এই উপলক্ষে ইংরেজ কোম্পানির ১৫৫৬০ টাকা খরচ হলো। সেদিনের হিসেবে এই অংক নেহাত কম নয়। এমন প্রচুর উপহারে সন্তুষ্ট হলেন মুর্শিদাবাদের যুবরাজও৷ নবাব তুষ্ট হয়েছেন এই মর্মে ইংরেজদের তরফে চিঠি পাঠানো হলো বিলেতে। আর এদিকে সেই বছর ৮ই অক্টোবর নবাব আলীবর্দী খাঁও কলকাতার ইংরেজ গভর্নর কে চিঠি লিখলেন। সেখানে বললেন সিরাজের অভ্যর্থনায় তিনি যথেষ্ট সন্তুষ্ট, এবং তাদের ব্যবসায় সুবিধার দিকে তিনি সবসময়ই সুনজর রেখে চলবেন। ইংরেজদের মূল অভিসন্ধি ছিল যেভাবেই হোক নবাবকে তুষ্ট রেখে তাঁর চোখের আড়ালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ ধীরে ধীরে সুদৃঢ় করা। এই বিষয়ে কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে একের পরের চিঠি এসে পৌঁছত বিলেত থেকে। নিজেদের বাংলার বুকে আরো শক্ত করে প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্যে ইংরেজদের প্রধান পদক্ষেপ ছিল এই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ। আর নবাব কোনদিনই এই বিষয়টিকে ভালো চোখে নেননি। তাই নবাব চটে গেলে ফোর্ট উইলিয়ামের কি হাল হতে পারে, সে বিষয়ে সাহেবদের যথেষ্ট চিন্তা ছিল বরাবরই। এর মধ্যে যতবারই ফোর্ট উইলিয়াম বেড়ে ওঠার খবর নবাবের কানে গেছে, তিনিও চিঠি পাঠিয়েছেন কলকাতায়। আর ইংরেজও নিজেদের মতো করে চেষ্টা করে গেছে নবাবকে তুষ্ট রাখতে। এই ছিল প্রথম দিকে মুর্শিদাবাদ বনাম কলকাতার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হালহকিকত। আর এর মধ্যেই ধীরে ধীরে নিজেকে গুছাতে চেয়েছেন সিরাজ। ভবিষ্যৎ নবাব হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার দিনগুলো ঠিক এভাবেই কেটেছে খামখেয়ালী যুবরাজ সিরাজের।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।