সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ১২)

শ্রীরামপুরের কথা

১৮১৮ সালের ১৫ই জুলাই মিশনারীদের পক্ষ থেকে একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হল। উদ্দেশ্য শ্রীরামপুরে গঙ্গাতীরে একখানি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। কলেজ তৈরির জন্য একেবারে উঠে পড়ে লাগলেন কেরী, মার্শম্যান আর ওয়ার্ড সাহেব। তখন শ্রীরামপুরের প্রশাসক কর্ণেল ক্রিফটিং সাহেব। বড়সাহেবের হাত দিয়ে কলেজভবন তৈরির আর্জিপত্র পৌঁছে গেল কোপেনহেগেনে ডেনমার্করাজের হাতে। ড্যানিশ শাসিত ভারতীয় এলাকায় ইংরেজ মিশনারীদের হাত ধরে গড়ে উঠতে চলেছে বাংলার দ্বিতীয় ইংরাজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। হ্যাঁ দ্বিতীয়ই। কারণ তার প্রায় এক বছর আগেই কলকাতায় রাজাবাহাদুর রাধাকান্ত দেব, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হাইড ইষ্ট সাহেব, মানবদরদী হেয়ার সাহেবদের উদ্যোগে গরানহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে রমরম করে শুরু হয়ে গেছে হিন্দু কলেজের ক্লাস। অভিজাত বাঙালী পরিবারের ছেলেরা ভর্তিও হচ্ছে নতুন উৎসাহে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বন্ধ হয়ে গেলেও হিন্দু কলেজে ডিরোজিও, টাইটলার আর রিচার্ডসন সাহেবরা বাঙালীর আধুনিক শিক্ষার শুরু করেন এক নতুন অধ্যায়। আর ঠিক মাইলখানেক দূরে বসেই কেরীসাহেবদের চিন্তাভাবনাতেও ঢেউ তোলে সেই স্রোত। সবকিছুই আছে শ্রীরামপুরে। নেই শুধু আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হবার প্রতিষ্ঠান, যেখানে মিশনারীদের উদ্যোগে বাইবেল পড়তে পারে বাঙালী।
মিশনারীদের ইচ্ছেকে মর্যাদাও দিলেন ডেনমার্ক অধিপতি। অনুমোদন করলেন ঠিক গঙ্গার তীরবর্তী আট বিঘা জমি। কলেজভবন নির্মাণ করবার জন্য। চিঠি এসে পৌঁছলো শ্রীরামপুরে। কলেজ প্রতিষ্ঠার স্মারক হিসাবে ডেনমার্ক থেকে জাহাজে কলেজ ভবনের মুখ্যদরজা (আজও গঙ্গার তীরে শোভা দেয় এই রাজকীয় দরজাটি) আর সিঁড়ি (স্টেপস) বানানোর পাথর পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই মিশনারীর সভা ডাকলেন কেরী সাহেব। কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বক্তৃতা করলেন কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড সাহেব। এরপরই কেরীসাহেব স্বয়ং কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন নিজের হাতে।
শুরু হল বাংলার নবজাগরণে এক নতুন উদ্যোগ। কিন্তু জমির অংশ বুঝে নিতে গেলে সম্মুখীন হল এক নতুন সমস্যা। আট বিঘা জমির মধ্যে ছোট একটি অংশের মালিক আকনা গ্রাম নিবাসী শ্রী কাশীনাথ দে। তিনি বিনা করে কিভাবে আপন সম্পত্তির ভাগ তুলে দেন মিশনারীদের হাতে। তাই ১০ টাকা করের বিনিময়ে জমি তুলে দিলেন কেরী সাহেবের হাতে। এরপর আর পিছন ফিরতে হয় নি শ্রীরামপুর ত্রয়ীকে। ১৮২১ সালের মাঝামাঝি কলেজ ভবনের কাজ সম্পূর্ণ হলে ডেনমার্ক অধিপতি কোপেনহেগেন থেকে শ্রীরামপুর কলেজের দ্বার খুলে দেবার নির্দেশ জানালেন। ১৯ জন খ্রীষ্টান আর ১৮ জন হিন্দু ছাত্র নিয়ে শুরু হল শ্রীরামপুর কলেজ। দ্বারোদঘাটন উপলক্ষে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করলেন ড্যানিশ গভর্মেন্টের গভর্নর কর্ণেল ক্রিফটিং সাহেব। রাজার ইচ্ছানুসারে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে ডিগ্রী দান করবার ক্ষমতা দেয়া হয় শ্রীরামপুর কলেজকে। এশিয়ার প্রথম কলেজ হিসাবে ডিগ্রীদানের ক্ষমতা পায় শ্রীরামপুর কলেজ।
রেভারেন্ড ডঃ উইলিয়াম কেরীর উদ্ভিদ প্রেমের কথা আগেই বলেছি। শুধুমাত্র উদ্ভিদ প্রেমের কারণে হাওড়ার বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রচুর দেশবিদেশের গাছ এখানে নিয়ে আসেন। তাই শ্রীরামপুরে কলেজ ভবনের পাশেও তিনি খুব যত্ন করে তৈরি করেন তাঁর সাধের একটা বাগান। নাম ডঃ কেরী’স গার্ডেন। দেশবিদেশ থেকে উদ্ভিদ প্রেমীরা রোজ জড়ো হতেন তাঁর বাগানে। সেখানে তিনি বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪২৭ রকম গাছ এনে ও গবেষণা করে গড়ে তোলেন ছোট আর একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। (আজ আর সেই বাগানের অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে সেই জায়গাতেই ইন্ডিয়া জুটমিল অবস্থিত)। ছেলেবেলা থেকেই গাছের ও কীটপতঙ্গের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা তিনি নিজেই লিখে গেছেন। নিজের দেশে বোন পলিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন জঙ্গলে জঙ্গলে। কীটপতঙ্গ ধরে এনে রেখে দিতেন খাটের তলায়। আর এদেশে এসে তাঁর সেই শখের পরিপূর্ণতা পায়। কলেজের পাশে প্রায় পাঁচ একর জায়গায় বিশাল উদ্ভিদ বাগান তাঁর প্রাণ হয়ে ওঠে। দেশবিদেশের বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতীর গাছ এনে বসান সেখানে। তখন বিদেশ থেকে গাছ আনবার একমাত্র মাধ্যম সমুদ্রপথ। তাই জাহাজে বাক্সবন্দী করে বিলেত থেকে গাছ আসতে থাকে শ্রীরামপুরে কেরী সাহেবের জন্য। কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের রক্সবরো সাহেব কেরী সাহেবের বন্ধু। সেই সূত্রে কলকাতার বাগানে একটি শাল গাছকে রক্সবরো সাহেব নাম দিলেন ‘কেরিয়া শাউলিয়া’। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কেরী সাহেব শ্রীরামপুর তথা বাংলার রত্ন। তাঁর প্রতিভায় শ্রীরামপুর আলোকিত হয়েছে বারবার।
এরপরে শ্রীরামপুর কলেজই হয়ে ওঠে মিশনারীদের কাজের কেন্দ্রস্থল। সবকিছু চলছিল মসৃণ ভাবেই। কিন্তু ১৮২৩ সালের শেষের দিকে শ্রীরামপুরে আবার হাজির হল ভয়াবহ বিপর্যয়। দামোদরের বন্যা প্রতি বর্ষাতেই বাংলার কাছে এক অভিশাপ। সেই বছর বর্ষায় দামোদরের ভয়ানক বন্যায় ভেসে গেল শ্রীরামপুর শহর। চারিদিকে জল। গঙ্গার জল উঠে এলো কলেজ ভবন পর্যন্ত। শ্রীরামপুরের ঘরহারা প্রচুর মানুষ আশ্রয় নিল কলেজ ভবনের মধ্যে। জলের সে এক মারণ রূপ। কলেজ শিক্ষা শিকেয় তুলে কেরীসাহেবরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন বন্যাবিধ্বস্তদের সাহায্যে। খাবার তুলে দিলেন দলে দলে গৃহহীন মানুষের মুখে৷ কিন্তু এই বন্যায় মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল কেরী সাহেবের সাধের বাগানটির। দেশবিদেশ থেকে আনা সমস্ত গাছ চলে গেল জলের নীচে। বন্যার জল নেমে গেলে বাগানের অবস্থা দেখে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না কেরী সাহেব৷ কেঁদে উঠলেন ডুকরে। নিজে হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা বাগান পড়ে রইল একেবারে শ্রীহীন অবস্থায়।
এরমধ্যেই ঘটে গেছে আর একটি ছন্দপতন। মিশনারী ত্রয়ীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব রেভারেন্ড উইলিয়াম ওয়ার্ড পরলোক গমন করেছেন। শ্রীরামপুর প্রেস আর কলেজের উন্নতিতে তাঁর ভুমিকা আজও ভোলেনি শ্রীরামপুর। ইংল্যান্ডের ডার্বিতে জন্মগ্রহণ করা এই কর্মযোগী ১৮১১ সালে ‘হিন্দুদিগের সাহিত্য ইতিহাস ও পুরাণ’ নামে একটি বইও শ্রীরামপুর প্রেস থেকে প্রকাশ করেন। প্রেসের প্রতিটি অক্ষর ও যন্ত্রপাতি ছিল তাঁর হাতের তালুর মত চেনা। পঞ্চানন কর্মকারের সাথে নিজে অক্ষর নির্মাণ থেকে মুদ্রণ যন্ত্র বসানো, সবেতেই তিনি অগ্রণী। কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে কলেজের জন্য টাকা জোগাড় করতে তিনি ঘুরে বেড়ান বিলেত ও মার্কিন দেশের পথে পথে। ১৮২৩ সালের মার্চে শ্রীরামপুরে কলেরা মারাত্মক রূপ নিলে তিনিও আক্রান্ত হয়ে পড়েন ও সেই রোগেই শ্রীরামপুরের সমস্ত মায়া কাটিয়ে পাড়ি দেন অমৃতলোকের পথে। কেরী, মার্শম্যান সাহেবের সাথে মিলে তাঁর অবদান আজও শ্রীরামপুরের ইতিউতি ছড়িয়ে আছে। মিশনারীদের সমাধিক্ষেত্রে তাঁর সমাধি আজও খ্রীষ্টানদের কাছে প্রণম্য।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।