সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ১৯)

কলকাতার ছড়া

কলকাতা শহরের ইতিহাসে আর একজন স্থিরপ্রতিজ্ঞ মানুষের নাম অত্যাবশ্যক ভাবে উঠে আসে। তিনি রাজা রামমোহন রায়। ১৮১৯ সালে মাদ্রাজ থেকে সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী কলকাতায় এলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য সুবিদিত। তর্কে তাঁর সাথে পেরে ওঠেন এমন পণ্ডিত এই শহরে হাতে গুনে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ঠিক তখনই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রায় একাহাতে লড়াই করে যাচ্ছেন রামমোহন। তখন তিনি কলকাতাবাসী। সারা শহর জুড়ে জোগাড় করছেন জনমত। শহরে স্পষ্ট তৈরি হয়েছে দুরকম ভিন্নধর্মী জনমত। একটি উদারপন্থী রামমোহনের দলের এবং অন্যটি সমাজপতি রাধাকান্ত দেবের দলের। ছড়া কেটে, গান গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় চলে প্রচার। যে যার মত করে কলি বাঁধে গানের। এরই মধ্যে রামমোহনের সামনে এসে গেল সুযোগ। সমাজের গণ্যমান্যদের সামনে পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের মত্ প্রতিষ্ঠার। বিপক্ষে সনাতন ধর্মের দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো খবর। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল সভাঘর। বৈদিক শাস্ত্রীয় পণ্ডিতরা সকলে শাস্ত্রীমশাইয়ের সামনে একেবারে চুপ। কিন্তু একা নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করতে লড়ে গেলেন রামমোহন। তুমুল তর্কের পরে নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনাকেই সেরা উপাসনা বলে মেনে নিলেন শাস্ত্রী। কিন্তু যশভাগ্য প্রসন্ন হল না রামমোহনের। উল্টে আরও দ্বিগুণ হল বিরোধিতা। দিকে দিকে গোঁড়া সনাতন পন্থীরা মুখে মুখে কাটতে লাগলো ছড়া। যেমন –

“খানাকুলের বামুন একটা করেছে স্কুল,
জাতের দফা হলো রফা থাকবে না কো কুল |”

হ্যাঁ, এবার আসা যাক রামমোহন রায় ও স্কুলশিক্ষা প্রসঙ্গে। দেশবরেণ্য ডেভিড হেয়ার সাহেবের কথা আগেই বলেছি। সুইস ঘড়ির ব্যবসা করতে এসে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ছেলেপুলেদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানোই ছিল তাঁর ব্রত। বলে রাখি, পাশ্চাত্য স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তা তাঁর সাথে সাথে আর একজন এদেশীয় বাঙালী করেছিলেন। তিনিই রাজা রামমোহন। কিন্তু দেশীয় মানুষদের তাঁর প্রতি ঘৃণা এমন পর্যায়ে গেছিল যে আধুনিক শিক্ষার পীঠস্থান হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর তিনি কমিটিতে থাকায় সেই কমিটি থেকে ওয়াক আউট করে গেছিলেন রাজাবাহাদুর রাধাকান্ত সমেত বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির দল। কিন্তু দেশের হিন্দু ছেলেদের শিক্ষার স্বার্থে শেষমেশ কমিটি থেকে নাম তুলে নেন স্বয়ং রামমোহনই। এমনই ছিল তাঁর প্রজ্ঞা। তৎকালীন গুটিকয়েক বাঙালী ছাড়া কেউই তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারেন নি। উপরন্তু দিয়েছেন ভৎসনা, অপমান আর লাঠির আঘাত। কিন্তু তারপরেও শুধুমাত্র হিন্দু বাল্যবিধবাদের অবাধে খুন আটকাতে দিল্লীর সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে ব্রিটেন যান প্রিভি কাউন্সিলে সওয়াল করতে। বাকিটা সকলের জানা। তাঁর প্রতি তৎকালীন শহরবাসীর ঘৃণার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে আর একটি কথ্যছড়ার অবতারণা করা যাক –

“সুরাই মেলের কুল,
বেটার বাড়ী খানাকুল,
বেটা সর্ব্বনাশের মুল
ওঁ তত্সৎ বলে বেটা বানিয়েছে ইস্কুল
ও সে জেতের দফা, করলে রফা
মজালে তিন কুল |”

চলবে…

ছবি –
১) রাজা রামমোহন রায়
২) ব্রিষ্টলে রাজা রামমোহনের সমাধি মন্দির

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।