কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ১১

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গোপসাগরের ভয়ংকর বন্যার কথা আইন ই আকবরীতে উল্লেখ করা আছে। আর ধারনা করা হয় সেই ভয়ংকর বন্যাতে বাকলা নামক জায়গা ধ্বংস হয়ে গেছিল। তাই বর্তমানে এই জায়গার কোন অস্তিত্ব আর বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। কিন্তু একসময় বাংলার ইতিহাসে যে সব বীরত্বের জয়গাথা লেখা হয়ে আছে, তার মধ্যে এই বাকলা অন্যতম। ইতিমধ্যেই আমরা কন্দর্পনারায়ণ রায় এবং তাঁর পুত্র রামচন্দ্র রায়ের বীরত্বের গল্প শুনেছি। কিন্তু একটি কথা না বললেই নয়। বীরের সঙ্গে বীর যেভাবে সম্বন্ধের বাঁধনে আবদ্ধ হয়, ঠিক তেমনভাবেই বাংলাদেশের দুটি রাজপরিবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল সেইসময়। বারো ভূঁইয়ার অন্যতম যশোরের প্রতাপাদিত্য এবং বাকলার কন্দর্পনারায়ণ রায় তাঁদের পুত্র এবং কন্যার সাথে বিবাহের মাধ্যমে সম্বন্ধের বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যদিও এই বিবাহের সাথে জড়িয়ে আছে একটি অত্যন্ত কদর্য ঘটনা। শোনা যায় প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিন্দুমতিকে বিবাহ করতে গেলে রামচন্দ্র রায়কে হত্যার চেষ্টা করেন স্বয়ং যশোর রাজ প্রতাপাদিত্য। এই ঘটনা নিয়ে বহু জনশ্রুতি আছে। সারা বাংলায় একাধিপত্ব কায়েম এবং শক্তিশালী বাকলা পরগনা অধিকার করবার ইচ্ছা নিয়ে নিজের জামাই রামচন্দ্র রায়কে বিবাহের দিনেই প্রতাপাদিত্য হত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলে শোনা যায়। প্রাচীন বিবাহসম্বন্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ঘটককারিকায় এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এদিকে এই ষড়যন্ত্রের কথা নিজের নব্যবিবাহিত পত্নীর থেকে শুনে সম্বন্ধী উদয়াদিত্যের সাহায্যে প্রতাপাদিত্যের প্রাসাদ থেকে পলায়ন করেন রামচন্দ্র। সেও এক অদ্ভুত গল্প। ছদ্মবেশে মশালধারির বেশে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে ছিলেন তিনি। এদিকে পালাবার আগে বাকলা থেকে কামান এবং বন্দুক সজ্জিত নৌকা এনে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন আগে থেকেই। তারপরে নৌকা সহযোগে পালানোর সময় তোপধ্বনি দিয়ে নিজের পলায়ন সংবাদ প্রতাপাদিত্যের কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এদিকে বিবাহের উদ্দেশ্যে প্রতাপাদিত্যের রাজধানীতে আসবার পরে রামচন্দ্রের বাকলা অধিকার করে নেয় আরাকান রাজ। পরে যদিও সেই রাজ্য পুনরুদ্ধার করে রামচন্দ্র পুনরায় নিজের সাম্রাজ্য রক্ষা করেছিলেন।
মহারাজা প্রতাপাদিত্যের জীবনে এটি একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিজের জামাইকে হত্যার এই ষড়যন্ত্র ঐতিহাসিকরা কখনোই তাঁর উজ্জ্বল চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভালো চোখে দেখেননি। ১৬০২ সালে এই বিবাহ সম্পন্ন হয়। এদিকে রামচন্দ্র রায়ের জীবনে বীরত্বের কাহিনী কম ছিল না। ত্রিপুরার অত্যধিক শক্তিশালী রাজা লক্ষণমানিক্যকেও তিনি যুদ্ধে পরাজিত করে নিজের রাজ্য বাকলায় নিয়ে এসেছিলেন। এই যুদ্ধ তাঁর জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। শোনা যায় লক্ষণমানিক্যের মৃত্যু হয় সেই বাকলাতেই। রামচন্দ্র রায়ের পুত্র কীর্তিনারায়ণও বীর ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি নৌ যুদ্ধে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন এবং সমুদ্র তীরবর্তী মোহনা থেকে ফিরিঙ্গিদের বিতাড়িত করেছিলেন।
বারো ভূঁইয়ার ইতিহাসে বাকলা এবং রামচন্দ্র রায় এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় বলে বিবেচিত হয়। যদিও কন্দর্পনারায়ন বাকলা থেকে রাজধানী মাধবপাশায় স্থানান্তরিত করেছিলেন, তবুও এই রাজবংশের সঙ্গে জুড়ে আছে বাকলা পরগনার নাম।