সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ১৩)

কেল্লা নিজামতের পথে

ঘটনাবহুল মুর্শিদাবাদ। কিন্তু সেদিনের মুর্শিদাবাদ তৈরির আগে যে গল্পটা আমরা পূর্বদিকে ঢাকায় ফেলে এসেছি, সেটাই কিন্তু ধীরে ধীরে তৈরি করেছিল মুর্শিদাবাদের জমি। ঠিক যেমন করে জব চার্নক ও ইংরেজ কোম্পানির হঠাৎ পছন্দ হওয়া গঙ্গার ধারে একখণ্ড জমিতে তৈরি হয়ে গেছে আজকের কলকাতা মহানগরী, সেভাবেই দেওয়ান করতলব খাঁর হাত ধরে হঠাৎ প্রাসাদ নগরী হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদ। এর পিছনের ঘটনাটা না উল্লেখ করলেই নয়। ঢাকা তখন বাংলা সুবার রাজধানী। সম্রাট আকবরের সময় সম্পূর্ণ মুঘল সাম্রাজ্য যে কটি সুবাতে ভাগ হয়েছিল রাজা টোডরমলের হাত ধরে, তারই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুবা বাংলা। আজকের দিনেও পরগণা, মৌজা বিভাজনে সেই মুঘল ছাপ যেন স্পষ্ট দেখা যায়। এই দেশে রাজস্ব সংগ্রহ এবং সুবা পরগণা বিভাজনে রাজা টোডরমল যে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন, তা এক কথায় কালজয়ী। আর ঠিক এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকাতে তখন নবাব আজিমুশ্বান। কিন্তু নব্য নির্বাচিত দেওয়ান করতলব খাঁয়ের সাথে তার নিত্য অশান্তি। অশান্তিটা কিছুটা ইগোর, আবার কিছুটা পজিশনের। দেওয়ান করতলব যেমন মানতে পারেন না নবাবের সমস্ত সিদ্ধান্ত, ঠিক তেমনি নতুন দেওয়ান করতলবের সমস্ত বিষয়ে অত্যধিক নজরদারি নবাবেরও না-পসন্দ। বিশেষ করে বাংলায় আসার পর করতলব লক্ষ্য করেন, যে এই সুবা একটি সোনার খনি। শস্য ভাণ্ডার হিসেবে এবং কৃষিকাজের ভিত্তিতে দেশের মধ্যে এর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু সমস্তটাকেই অদ্ভুতভাবে লুকিয়ে রাখার একটা প্রচেষ্টা নবাব পক্ষে বেশ স্পষ্ট। নবাব সবসময়ই দিল্লিতে বাদশার কাছে বাংলাকে একটা অনুর্বর এবং অস্বাস্থ্যকর জায়গা হিসেবে উপস্থাপনা করে আসছেন বহুদিন ধরে। তো ঢাকা পৌঁছেই করতলব প্রথম দেওয়ানির ক্ষমতা বলে তলব করলেন সমস্ত রাজস্বের কাগজপত্র। আর সেখানেই প্রথম ধরে ফেলেন বিভিন্ন ইচ্ছাকৃত ত্রুটি। যে বাংলা থেকে প্রায় এক কোটি টাকা দিল্লিতে পাঠানো যায় অনায়াসে, সেখানে খুবই কম পরিমাণ রাজস্ব প্রতিবছর যায় বাদশার হাতে। আর এসব কিছুরই নেপথ্যে নবাব আজিমুশ্বান। এইখানেই প্রথম যে বিবাদটা শুরু হয়ে গেল, তা মুর্শিদাবাদ তৈরির ভিতটাকে যেন ধীরে ধীরে শক্ত জমিতে পরিণত করল।
আজিমুশ্বান সম্রাট বংশের লোক। স্বয়ং বাদশা ঔরঙ্গজেবের নাতি। কিন্তু করতলব সেই নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ধীরে ধীরে ঘুঁটি সাজালেন ঢাকার মাটিতে। এখানেই দক্ষ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে তাঁর সার্থকতা।
তখন ঢাকায় দু’রকম সৈন্য ছিল। যারা সরাসরি নবাব দরবারে দেওয়ানের থেকে বেতন পেত, তাদের নগদী সৈন্য বলা হত। আর একদল কাজ করলে জমিদারদের থেকে প্রাপ্ত জায়গীরের ওপর ভিত্তি করে বেতন পেত। কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে ছিল তীব্র রেষারেষি। নগদী সৈন্যের সেনাপতি আব্দুল ওয়াহেদ তখন ঢাকায় উল্লেখযোগ্য নাম। আর নবাবের অনুগত হিসেবে করতলব খাঁয়ের ওপর তার তীব্র দৃষ্টি।
ঢাকায় নিজের পাকা সরকারি বাসস্থান ছেড়ে করতলব বা মুর্শিদকুলি এমনি এমনি মুখসুদাবাদে এসে বাসস্থান স্থাপন করেননি। এর পিছনে আছে বহু অজানা চক্রান্ত। দেওয়ান হিসেবে ঢাকায় এক একটি সকাল তার জন্য ছিল এক একটি আশঙ্কার প্রহর। ঢাকা থেকে দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে ব্যস্ত সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলত সে৷ আর পদে পদে জানাত নবাবের বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা এবং তছরুপের হিসাবনিকাশ। ফলতই শরীরে সম্রাট বংশের রক্ত বয়ে যাওয়া নবাব সামান্য এক কর্মচারীর এহেন রক্তচক্ষুকে সাধারণভাবে নেবেন না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সম্রাটের প্রিয় করতলবকে দমিয়ে রাখাও যে বেশ কিছুটা কঠিন কাজ তাও তাঁর বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। তখনকার দিনে বাদশা নবাবদের কাছে রক্ত বা বংশধর নয়, সবার আগে অর্থ ও রাজস্বই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং বাংলা থেকে প্রায় এক কোটি টাকা রাজস্বের হিসেব পাঠানো মুর্শিদকুলি যে সম্রাটের কাছে প্রিয় পাত্র হবেন, তা সে যুগের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বলে দেয়। এইসব কারণে তখন প্রতিদিন নবাব আর দেওয়ানের মধ্যে প্রকাশ্য রেষারেষি এবং বিবাদ। কিন্তু একটা দিনের ঘটনা সবকিছুকে পিছনে ফেলে তীব্র রূপ ধারণ করল। নগদী সৈন্যের নেতা আব্দুল ওয়াহিদ নবাবকে এক প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন। তিনি বললেন আপোষ নয়, কায়দা করে সরিয়ে ফেলতে হবে দেওয়ানকে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ঢাকার রাজপ্রাসাদে সেদিন তৈরি হয়ে গেল মুর্শিদকুলিকে খুনের ব্লুপ্রিন্ট। এদিকে নবাবের বিভিন্ন কার্যকলাপে প্রতিবাদ জানালেও প্রকাশ্যে মুর্শিদকুলি কখনোই অসম্মান করতেন না তাঁকে। হাজার হোক তিনিই নবাব। রোজ সকালে নিয়ম করে দেখাও করতে যেতেন নবাবের সাথে। ঠিক তেমনি একটি দিনে মাঝ রাস্তায় মুর্শিদকুলিকে ঘিরে ফেলল ওয়াহেদ। সাথে নবাবের সৈন্য। কিন্তু ছেড়ে কথা বলবার পাত্র নয় মুর্শিদকুলিও। তিনিও তার অনুচরদের এগিয়ে দিলেন পথ পরিষ্কার করার লক্ষ্যে। কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর নগদী সৈন্য বাধ্য হল পিছু হটতে। এদিকে ফুঁসছেন মুর্শিদকুলি। দেওয়ান হিসেবে দিল্লি থেকে তার নিয়োগ। হাতে সম্রাটের নিয়োগপত্র। অথচ স্বয়ং নবাবের হাতেই তিনি সবচেয়ে অরক্ষিত। নিজের ঘরেই যুদ্ধ করা যে কতটা কঠিন তা বিলক্ষণ বুঝলেন করতলব। সোজা নবাবের প্রাসাদে গিয়ে ভৎসনা শুরু করলেন প্রকাশ্যে। নবাবও সব জেনে না জানার ভান করে মুর্শিদকুলিকে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন। ওয়াহেদকে ডেকে ক্ষমা চাওয়ালেন দেওয়ানের কাছে। কিন্তু সেদিনের ঘটনা যেন একেবারে নাড়িয়ে দিল করতলবকে। আর দেরি করলেন না তিনি। দিল্লিতে চিঠি লিখে নবাবের সমস্ত কীর্তিকলাপ এবং তাকে প্রাণনাশের চেষ্টা সম্বন্ধে যথাযথ রিপোর্ট পেশ করলেন, এবং নিজের বাসস্থান পরিবর্তনের জন্য শুরু করলেন বাংলার বুকে নতুন একটি জায়গার তল্লাশি। মিলে গেল জায়গাও। সম্পূর্ণ বাংলা সুবার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত ধীর গতিতে বয়ে চলা ভাগীরথীর তীরে শান্তির নগরী মুখসুদাবাদ।
মুর্শিদকুলি দক্ষ সিভিল অফিসার। দিল্লি থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বাংলায় এসে হেরে যাবেন, এমনভাবে তিনি কখনোই তৈরি করেননি নিজেকে। তাই যেকোনো প্রতিরোধ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা স্বতন্ত্র নবাবী প্রতিষ্ঠা করতে তার খুব বেশিদিন সময়ও লাগেনি। তাঁর হাত ধরেই মুখসুদাবাদ হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদ। বাংলাও পায় নতুন রাজধানী। আর দেওয়ানের চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে আজিমুশ্বানের ওপর বেজায় চটে যান সম্রাট। তাকে সত্তর ট্রান্সফার করিয়ে নিয়ে আসেন বিহারের গভর্নর পদে। এ কি মুর্শিদকুলির জয় নয়? তাঁর দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার পাশে ফিকে হয়ে যায় সমস্ত অপচেষ্টা। কোনদিনই প্রতিরোধকে ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর৷ মুখসুদাবাদে আসবার পর করতলব বাংলার রাজস্ব বৃদ্ধির উপর একটি বিশদে রিপোর্ট তৈরি করেন সম্রাটকে জমা করবার লক্ষ্যে। সেই যুগে দেওয়ানের রিপোর্টে দু’জন কানুনগোর সই থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। প্রধান কানুনগো দর্পনারায়ণ ও দ্বিতীয় কানুনগো জয়নারায়ণ সই না করলে সেক্ষেত্রে হিসাবের ডিটেল রিপোর্ট জমা দেওয়া যেত না বাদশাকে। কিন্তু দর্পনারায়ণের সাথে তাঁর অর্থ বিষয়ক বিবাদ থাকার কারণে শুধুমাত্র জয়নারায়ণের সই নিয়ে সম্পূর্ণ রিপোর্ট তিনি নিজে গিয়ে জমা করেন দাক্ষিণাত্যে থাকা সম্রাটের হাতে। এরপর আর পিছন ঘুরে তাকাতে হয়নি করতলবকে। সেই সময়ই তাঁর সম্রাটের থেকে মুর্শিদকুলি মুতামউলমুল্ক আলাউদ্দৌলা জাফর খাঁ নাসিরি জঙ্গবাহাদুর উপাধিলাভ৷ আর দেওয়ানির সাথে সাথে উপহারস্বরূপ বাংলার নবাব নাজিম পদ ও নিজের পতাকা। এই ছিল মুর্শিদকুলির কর্মদক্ষতার পুরস্কার। কিন্তু আজকের মুর্শিদাবাদ তাঁর প্রতিষ্ঠাতার কথা মনে রেখেছি কি?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।