কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব -১০

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র
জগদানন্দ রায়ের মৃত্যুর পর বাকলার সিংহাসনে আরোহন করেন তাঁর পুত্র কন্দর্পনারায়ণ রায়৷ কন্দর্প বালক হলেও রাজ্য পরিচালনা এবং শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত দক্ষ। এ কথা জানা যায় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পর্যটক র্যালফ ফিচের কলম থেকে। তাঁর মতে সেই সময় বাকলা নগরীতে অত্যন্ত সুশাসনব্যবস্থা প্রচলিন ছিল। এবং রাজা ছিলেন দক্ষ। বন্দুক চালাতে ও শিকার করতে তিনি ভালোবাসতেন। সেই রাজ্য ছিল উর্বর এবং শস্যশ্যামলা। সেখানে যেমন প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপাদন হতো, ঠিক তেমন ছিল রেশম ও কার্পাসের বস্ত্র তৈরীর ব্যবস্থা। পথ ছিল প্রশস্ত এবং প্রাসাদোপম ঘরবাড়ি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একজন ব্রিটিশ পর্যটক যখন বাংলার কোনো অঞ্চলের প্রশংসা করেন, তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে সেখানে অতি সুন্দর এবং সু্ব্যবস্থাপনা অবশ্যই প্রচলিত ছিল। পর্যটক রিচ বাংলার চট্টগ্রাম থেকে বাকলা এসেছিলেন। এবং সেখানে কিছুদিন রাজার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তবে কেউ কেউ বলেন তিনি কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রাজা রামচন্দ্র রায়ের আমলে বাকলা এসেছিলেন। তবে সে যাই হোক, সেইসময়ের বাকলা এবং চন্দ্রদ্বীপ যে বাংলার শৌর্যবীর্যের এক অন্যতম প্রতীক সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। রাজা কন্দর্পনারায়ণ রায়ের আমলেই রাজা টোডরমল বাংলাকে মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করেন। যদিও সেই আমলে মুঘল দরবারের আধিপত্য মেনে নিলেও বাংলা একরকম স্বাধীনই ছিল। আর সেক্ষেত্রে বারবার মুঘলদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে এইসব ভূঁইয়াদের। বাংলাকে সেই সময় সরকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সম্পূর্ণ অঞ্চলকে চারটি মহলে বিভক্ত করা হয়। সেগুলি হল – বাকলা, শ্রীরামপুর, শাহজাদপুর এবং আদিলপুর।
বাকলা পরগনার দিকে প্রথম থেকেই অন্যান্য রাজাদের দৃষ্টি ছিল। তার মধ্যে ত্রিপুরার রাজা অমর মানিক্য এবং আরাকানরাজ উল্লেখযোগ্য। আসলে দুই পাশ থেকে এই দুই সাঁড়াশি আক্রমণ বারবার প্রতিহত করতে হয়েছে বাকলার রাজাদের। একসময় ত্রিপুরা, আরাকান এবং পর্তুগিজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাজা কন্দর্পনারায়ণ বাধ্য হন রাজধানী পরিবর্তন করতে। তিনি বাকলার কচুয়া থেকে রাজধানী পরিবর্তন করে নিয়ে যান মাধবপাশায়। আজ মাধবপাশা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম। রাজা রামচন্দ্র রায় থেকে একাধিক রাজারা এই মাধবপাশা থেকেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। যদিও মাধবপাশা অধিকার করবার জন্য কন্দদর্পনারায়ণের হাতে রক্তের দাগ লেগেছিল। জনৈক এক গাজীকে হত্যা করে তিনি এই অঞ্চলের অধিকার লাভ করেছিলেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে একটি রাজনৈতিক হত্যা তাঁর সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মাধবপাশা রাজবাড়ীর ভগ্নাবশেষ আজও সেই অঞ্চলে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হিসাবে চিহ্নিত হয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনস্ত। এই রাজবাড়ী থেকে রাজা কন্দর্পনারায়ণ রায়ের নামাঙ্কিত একটি কামান উদ্ধার করা হয়েছিল। এই কামানের উপর রাজার নাম খোদাই করা দেখা যায় এবং আশ্চর্যজনকভাবে ৩১৮ নম্বরটি লেখা দেখতে পাওয়া যায়। এই নম্বরটির রহস্য যদিও আজ অবধি উদ্ধার হয়নি। তবে কেউ কেউ মনে করেন এই নম্বরটির পেছনে লুকিয়ে আছে কামানটির ক্রমিক সংখ্যা।
বারোভূঁইয়ার এক প্রতাপশালী ভূঁইয়া হিসেবে কন্দর্পনারায়ণ রায়ের নাম উল্লেখ করলেও তার সাথে উচ্চারিত হয় তাঁর বীর পুত্র রামচন্দ্র রায়ের নাম। কারণ চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের বীরত্বের কথা বলতে গেলে রামচন্দ্র রায়ের কথা অবশ্যই লেখা প্রয়োজন। কন্দর্পনারায়ণের মৃত্যুর সময়ে বালক রামচন্দ্রের বয়স ছিল আট বছর। আর সেই বয়সেই রাজা হিসেবে তিনি বাকলার রাজ সিংহাসনে আরোহন করেন। সেই শিশু বয়স থেকেই শুরু হয় তাঁর বিজয় গৌরবের কাহিনী। ১৫৯৯ সালে তার রাজ্যে আগমন ঘটে জেসুইট সংঘের অন্যতম দার্শনিক এবং ধর্মপ্রচারক পেদ্রো দা ফনসেকার। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক হিসাবে তিনি একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। পর্তুগালে জন্মগ্রহণ করে তিনি জেসুইট সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বাংলায় আসেন। আর সেই সময়ই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তরুণ রাজা রামচন্দ্র রায়ের। তিনি আরও কয়েকজন ধর্ম প্রচারকের সাথে আরাকান প্রদেশ পরিভ্রমণ করে চট্টগ্রাম হয়ে বাংলায় আগমন করেন। সেখানে সেই অষ্টম বর্ষীয় রামচন্দ্র রায়ের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে সেই কাহিনী তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এবং সেই বালকের উঁচু চিন্তা ভাবনা এবং দক্ষ রাজনৈতিক কৌশলে তিনি রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন। কারণ রামচন্দ্রের মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক ক্ষমতা ছিল দেখবার মত। ফনসেকা তাঁর কাছে রাজ্যে গির্জা নির্মাণ এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অনুমতি চেয়েছিলেন। রামচন্দ্র ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল। সেই সময় তাঁর রাজ্যে পর্তুগিজরাও বসবাস করত। বিশেষ করে আরাকান এবং মগদস্যুদের হাতে অত্যাচারিত পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা বাকলা অঞ্চলে নিশ্চিন্তে বাস করত। এর থেকেই বোঝা যায় রাজা রামচন্দ্র সকল প্রকারের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আর তাই জেসুইট সংঘের ধর্ম প্রচারকদের তিনি অনুমতি প্রদান করে এবং বৃত্তিদান করে তাঁর রাজসভাতে সম্মান প্রদর্শন করেন।
রামচন্দ্র আরাকান এবং মগদস্যুদের সঙ্গে সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন। সেই লড়াই তাঁকে পরিণত করেছে। বারবার তাঁর রাজ্য বাকলা দস্যুদের হাতে হস্তান্তরিত হলেও তিনি আবার নিজে ক্ষমতা বলে ফিরে পেয়েছেন রাজ্যের অধিকার। আর সুবিচার করেছেন তার বাবার নামের। শোনা যায় বিখ্যাত পর্তুগিজ অভিযাত্রী জীন গ্যারি প্রায় দশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁর সৈন্যবাহিনীতে যুক্ত হন। রামচন্দ্র তার সৈন্যবাহিনীকে বিশেষভাবে বন্দুক এবং কামান চালানোর প্রশিক্ষণ দিতেন। ফলে যেকোন যুদ্ধে অভিনব কামান ব্যবহারে এই বাঙালি রাজার দক্ষতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি একাধারে বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার পন্ডিত ছিলেন এবং তার পাশাপাশি যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন। তাই বিভিন্ন সময়ে রাজ্য পুনরুদ্ধার এবং রাজ্য বিস্তারে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বাংলার মানুষ বিস্মৃতপ্রায় হলেও, ইতিহাস তা যুগে যুগে মনে রাখবে।