সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৩৫)

কেল্লা নিজামতের পথে

আমি মুর্শিদাবাদ যেতে ভীষণ পছন্দ করি। সূদুর কলকাতা থেকে সুযোগ পেলেই ইচ্ছে করে ছুঁয়ে আসি মুর্শিদাবাদকে। আর পছন্দ করি খোশবাগ। খোশবাগের মধ্যমণি হয়ে যিনি শুয়ে আছেন তিনি আলীবর্দী। তাঁর নবাবি জীবনের যুদ্ধব্যস্ততার কথা আগেই বলেছি। সেদিন খোশবাগে তাঁর সমাধির পাশে বসে ভাবছিলাম কয়েকটা কথা। নিতান্তই নবাব সুজাউদ্দিনের খাস উচ্চপদস্থ কর্মচারী থেকে বাংলার দোর্দন্ডপ্রতাপ নবাব। তাঁর নবাবি সময় মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ। কিন্তু নবাব হওয়ার পর তাঁর মতো যুদ্ধবিগ্রহের ব্যস্ত থাকতে আর কোনো নবাবকেই দেখা যায়নি। যখন সিংহাসনে বসলেন, উড়িষ্যার সিংহাসনে তখন দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁ। মুর্শিদকুলি সম্পর্কে সুজাউদ্দিনের জামাই। তাই আলীবর্দী সিংহাসনে বসলে উড়িষ্যা নিয়ে একটা কাঁটা তো ছিলই, কিন্তু নিজে আক্রমণ করে উড়িষ্যা থেকে তাকে উৎখাত করবে, এমন চিন্তা ভাবনা আলীবর্দী কোনদিনই করেননি। আসলে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফারাজের প্রাণ কেড়ে নেবেন, এমন চিন্তাও কি আর আগে থেকে আলীবর্দী করেছিলেন? কিন্তু সময় এবং সুযোগ অনেক কিছু চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। নবাব আলীবর্দী খাঁয়ের রাজত্বকাল তার সব থেকে বড় উদাহরণ। গিরিয়ায় সরফরাজ নিহত হওয়ার পর আলীবর্দী সিংহাসনে বসলে উড়িষ্যায় মুর্শিদকুলীর একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয় বৈকি। কিন্তু নিজে থেকে সিংহাসন ছেড়ে দেবেন এমন উদারতা তিনি দেখাবেন বলে কোনদিন ভাবেননি। প্রথমত উড়িষ্যার স্বাধীন শাসক তো নয়, মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়োজিত উড়িষ্যার সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মাত্র। অর্থাৎ বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবের কার্য পরিচালনার সুবিধা জন্য একটি রাজ্যের দায়িত্বভার হাতে নেওয়া ও কর সংগ্রহ থেকে শুরু করে শাসনভার পরিচালনায় নবাব কে সামনে থেকে সাহায্য করা। তাই মুর্শিদাবাদের রাজ সিংহাসনে পট পরিবর্তন ঘটে যাওয়ায় উড়িষ্যায় মুর্শিদকুলের জন্য তা এক ভীষণ প্রহসনের পরিস্থিতি হয়ে উপস্থিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে নবাবের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন এই চিন্তাভাবনা এবং দুঃসাহস তিনি কখনোই নিজে করেননি। কিন্তু সেনাপতি ও তার জামাই বাখর খাঁ নবাবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে একরকম উদ্বুদ্ধ করায় শেষ পর্যন্ত নবাবের সাথে মুর্শিদকুলির যুদ্ধ বাঁধে বালাসোরের পাহাড় ও জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলে। উড়িষ্যায় বিদ্রোহের খবর পেয়ে আলীবর্দীও সৈন্যবাহিনী গুছিয়ে ছুটে যায় সেই অভিমুখে। এই ছিল আলীবর্দির নবাব হওয়ার পর প্রথম যুদ্ধযাত্রা। এরপর থেকে কোন সময়ই মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে শান্তিতে দুদণ্ড বসতে পারেননি তিনি। বলতে গেলে বসতে দেয়া হয়নি তাঁকে। কারণ অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। উড়িষ্যা থেকে বিদ্রোহ দমন করে যুদ্ধ মিটিয়ে মুর্শিদাবাদের পথে ফিরতে ফিরতেই তিনি খবর পান বাংলায় ঘোড়সওয়ার গেরিলা বর্গীদের আক্রমণের কথা। এমনকি উড়িষ্যা সীমান্ত থেকে তিনি মুর্শিদাবাদের ফিরেও যেতে পারেননি। সেখান থেকেই ক্লান্ত সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান বর্ধমান অভিমুখে। রাস্তাতেই খবর পান দলে দলে মহারাষ্ট্রীয় যোদ্ধারা রঘুজি ভোঁসলের দুর্ধর্ষ সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে পঞ্চকোটের পাহাড় পেরিয়ে বর্ধমানের দিকে ধেয়ে আসছে। আলীবর্দী বুঝতে পারেন বাংলার মহা বিপদ। অবিলম্বে তাদের না রুখলে রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখাই এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়বে। কিন্তু রণক্লান্ত সেনা নিয়ে এই বিশাল বর্গীবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার ক্ষমতা ও মানসিকতা কোনটাই যে তখন নেই তা নবাব ভালোই বুঝেছিলেন। অথচ বীর বিক্রমে সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করা ছাড়া উপাই বা কী ছিল? স্থিরপ্রতিজ্ঞ নবাব আলীবর্দী।
মুর্শিদাবাদের কথা হলে প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে পড়ে বাংলায় মারাঠা বর্গীদের আক্রমণের কথা। আজও যে ছড়া মুখে মুখে ঘোরে তা হল,

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।

বাংলার এই প্রবাদ আজও বাঙালির মধ্যে বুনে রেখেছে সেই হাড় হিম করা আতঙ্কের কাহিনী। বছর যায়, আর বাংলায় ফিরে ফিরে আসে মারাঠা বর্গীর বাহিনী। উদ্দেশ্য তাদের একটাই, খাজনা বা চৌথ। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। আলীবর্দির সময় বাংলা থেকে আর দিল্লিতে সেভাবে কর প্রেরণ করা হতো না বললেই চলে। বাংলার সিংহাসনে একরকম স্বাধীনভাবে জাঁকিয়ে বসেছিলেন নবাব। সিংহাসনে বসবার পর সেই যে দিল্লিতে প্রচুর পরিমাণ উপহার সামগ্রী, উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন, তারপর থেকে আর করও পাঠানো হত না নিয়মিত। এদিকে অস্তমিত মুঘল সাম্রাজ্যের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাওয়া সম্রাটরাও যে তাদের বিভিন্ন সুবার খবরাখবর নেবেন এবং করের হিসেব করতে বসবেন সেই পরিস্থিতিও আর ছিল না। তাঁরা তখন ব্যস্ত সাম্রাজ্য বাঁচাতে। সেই সুযোগে মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সুবাগুলোতে আলীবর্দির মতই স্বাধীন রাজ্যপাট গুছিয়ে নিজেদের মতো করে সালতানাত গড়ে তুলেছিলেন নবাবরা। এদিকে মহারাজা শিবাজীর পর মারাঠা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পেশোয়ারা হাতে দুর্দান্ত ক্ষমতা পেয়ে গেলে এবং রাজত্বের সীমাও বৃদ্ধি হলে তারাও নিয়মিত মুঘল সাম্রাজ্যের উপর করের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে দুবার ভাবেননি। তাদের প্রয়োজন অর্থ। বাংলা সুবা থেকে কর হিসেবে চৌথ সংগ্রহ করার জন্য মুঘল বাদশার উপর মরাঠারা চাপ তৈরি করলে একরকম হাত তুলে দেয় বাদশা। তিনি তখন প্রায় দেউলিয়া। অগত্যা দিল্লী দেখিয়ে দেয় বাংলার দরজা। সেক্ষেত্রে আলীবর্দীর মুঘলদেরকে প্রাপ্য কর না দেওয়াই যে বাংলায় বর্গী আক্রমণের এক প্রধান কারণ তা মেনে নিতে কোন গবেষকই দ্বিমত হননি। শস্য শ্যামলা বাংলা। ছুঁলেই সোনা। অথচ সেখান থেকে বৃহৎ শক্তি মারাঠাদের প্রাপ্য কর হিসেবে এক কানাকড়িও আসে না। এহেন পরিস্থিতি মারাঠারা মুখ বুজে মেনে নেবেন না এটাই স্বাভাবিক। গেরিলা যুদ্ধের জনক ছিলেন শিবাজী। তার সময় থেকেই মারাঠারা নিজেদের অংশটুকু একরকম ছিনিয়ে নিয়ে বুঝে নিতে শিখেছেন। আর এর ফলই ভোগ করতে হয় এই বাংলার নিরীহ মানুষজনকে। আলীবর্দির সময় কালের মধ্যেই ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর বাংলার সমস্ত মানুষ লড়াই করে এই দুর্ধর্ষ মারাঠা বর্গীদের আক্রমণের সাথে। আর বর্গীদের পেছনে ছুটতে ছুটতেই একরকম ক্লান্ত হয়ে পড়েন আলীবর্দী। বাংলায় মানুষজনের ওপর প্রচুর অত্যাচার চালালেও আলীবর্দির রণনিপুণ যুদ্ধ পরিচালনা এবং নাছোড় মনোভাবও ছিল তারিফ করার মতই। একমাত্র নবাবের জন্যই বারবার দলে দলে যোদ্ধা নিয়ে বাংলায় আছড়ে পড়লেও প্রতিবার অল্প কদিন পরেই ফিরে যেতে হয়েছে বর্গীদের। ১১ বছরের মধ্যে পাঁচ বার বাংলা আক্রমণ করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি সেই দস্যু যোদ্ধারা। শুধুমাত্র বিভিন্ন স্থাপত্যের ক্ষয়সাধন এবং বাংলার মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারিনি বর্গীরা। আলীবর্দির সুরম্য সমাধিটুকুর পাশে বসে এই কথাগুলোই বারবার মনে আসছিল। ঠিক তখনই যেন ঘুম ভাঙানোর মতো খোশবাগের সমাধি মন্দিরে এসে হাজির হলেন সমর্পিতাদি। প্রতিদিনের মতো তিনি তখন সেবা ও পরিচর্যা করবেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং আলীবর্দী খাঁয়ের পাশাপাশি সমাধি দুটির। আমিও এসে বসলাম ঠিক দরজার পাশে। প্রায় আধ ঘন্টা সময় সাক্ষী থাকলাম এক অদ্ভুত অন্তরঙ্গতার। বর্তমান যুগ যেন মিশে গেল অতীতের সাথে। সেই রঙিন অভিজ্ঞতাটুকু হয়তো সারা জীবন থেকে যাবে আমার লুকিয়ে থাকা অনুসন্ধিৎসু মনের একদম অন্দরমহলে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।