সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ২২)
কেল্লা নিজামতের পথে
‘বাংলার আকবর’ আলীবর্দিকে নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। গিরিয়ার ময়দান তাঁর জীবনে পরিবর্তন এনে দিলেও, সিংহাসনে বসার পর থেকে শান্তির রাজত্ব ছিল না কখনোই। বাংলার জন্য সে এক মনে রাখবার মতন খারাপ সময়। আলীবর্দির সময় কাল বাংলার আকাশে দুর্ভাগ্যের সময়। একে তো সিংহাসনে বসার পর উড়িষ্যার শাসক রুস্তম জং বিদ্রোহ ঘোষণা করলো নবাবের বিরুদ্ধে। আলীবর্দিকে মানতে তিনি একেবারেই নারাজ। বিষয়টি ভালো চোখে নেননি আলীবর্দিও। ফলে সিংহাসনে বসবার একেবারে পরপরই উড়িষ্যা ছুটে গিয়ে দমন করতে হয়েছিল রুস্তম জঙের বিদ্রোহ। মুর্শিদাবাদের প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর সাথে এঁটে উঠবে তেমন ক্ষমতা রুস্তম জং এর ছিল না। ফলত একটি যুদ্ধ ও তার পরিণামে মৃত্যু, এই ছিল তার ভবিতব্য। কিন্তু বিদ্রোহ দমন করে মুর্শিদাবাদের ফিরে আসতে না আসতেই বাংলার আকাশে বাতাসে রৈ রৈ করে ভেসে উঠলো “হর হর মহাদেও” রব। মুখে শিবের নাম, আর হাতে তীক্ষ্ণ তরবারি নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়া এক বিভীষিকাময় ত্রাস। তাদের নাম বর্গী। মারাঠি বারগী শব্দ থেকে বর্গীর উৎপত্তি বলে জানা যায়। বারগী অর্থে অশ্বারোহী। মারাঠা প্রদেশে নাগপুর রাজ্যে তখন রঘুজি ভোঁসলের শাসন। এদিকে নিয়ম মত আলীবর্দি দিল্লিতে কর না পাঠানোর ফলে, বাংলা থেকে প্রদেয় চৌথ ঠিকমতো হাতে আসছিল না রঘুজির। অস্তমিত মুঘল সাম্রাজ্যের ডামাডোল অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তখন সারা ভারতে নিজেদের শাসন কায়েম করতে ব্যস্ত মারাঠারা। দুই দিক থেকে উঠে আসছে রঘুজি ভোঁসলে আর পেশোয়া বালাজি বাজিরাওয়ের নাম। যদিও শিবাজী মহারাজের পর থেকেই মারাঠাদের মধ্যেও এক ক্ষমতার লড়াই বেধেই থাকতো অহরহ। এই অবস্থায় বাংলা থেকে লুট করে যৌথ সংগ্রহ করার সুযোগ রঘুজি ছেড়ে দেবেন তা কখনো হতে পারে না। ১৭৪২ সালে এপ্রিলে রঘুজি ভোঁসলের প্রধান সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে প্রথম দলে দলে বর্গীরা ঘোড়ায় চড়ে হাতে বর্শা নিয়ে ছুটে আসে উড়িষ্যা হয়ে বাংলার দিকে। সে এক আকাশভেদী চিৎকার। ঘরে ঘরে অত্যাচার, লুট, নারী নিগ্রহ থেকে শুরু করে সমস্ত রকমের নির্যাতনে তারা যেন সিদ্ধহস্ত। এর মধ্যে আবার আলীবর্দির এক সেনাপতি মীর হাবিব যোগদান করে মারাঠা পক্ষে। ফলে শক্তি বাড়ে তাদের। মুর্শিদাবাদের সমস্ত ভেতরের খবরাখবর হাবিবের কাছে পরিচিত। তাই ভাস্কর পণ্ডিতদের কাছে মুর্শিদাবাদের ভেতরের কথা জানিয়ে তাদের সাহায্য করতে মীর হাবিবের বেশি অসুবিধে হয়নি। আর মারাঠাদের এই অচেনা বাংলায় এসে এখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্লু প্রিন্টের সঙ্গে পরিচিত হতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। প্রথমবার মারাঠাদের সঙ্গে নবাব আলীবর্দির মুখোমুখি হয় বর্ধমানে। বর্গীদের আক্রমণে খবর পেয়ে নবাব তখন কাটোয়া থেকে সরাসরি বর্ধমান এসে দাঁড়ালেন বর্গীদের সামনে। তাই শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, বর্গী হাঙ্গামা সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরিচয় ঘটেছে বাংলার বিভিন্ন প্রদেশের। বর্ধমান হুগলি মেদিনীপুর এমনকি সুদূর বিষ্ণুপুর পর্যন্ত বুকে করে ধরে রেখেছে বর্গীদের অকথ্য অত্যাচার। ন’বছর ধরে মোট ছ’বার বাংলাতে আক্রমণ করেছে বর্গীরা। প্রথম তিনবার ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে, এবং তারপর স্বয়ং রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে। বাংলার এখনো কিছু কিছু জায়গায় এই আক্রমণের নিশান স্পষ্ট পড়ে রয়েছে। কিছুদিন আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম বাঁকুড়ার গড়পঞ্চকোট পাহাড়ে। তিন দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা সেই জায়গা ছিল রাজা দামোদর শেখরের নিজের গড়। কিন্তু বর্গী আক্রমণের সময় সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত সেইসব প্রাসাদের অংশ আজও ভেঙেচুরে পড়ে রয়েছে আনাচে-কানাচে। কি নেই সেখানে। মুখ্য তোরণ থেকে শুরু করে রাণীমহল, সব কিছুরই নির্মম ধ্বংসাবশেষ সাক্ষী দেয় আলীবর্দীর সময়কালে এই ভয়ানক মারাঠা দস্যুদের আক্রমণের সময়কালকে। মারাঠারা প্রতিবছর যেভাবে ধেয়ে এসেছে বাংলার ক্ষয়ক্ষতি করতে, ঠিক অপরদিকে নবাব আলীবর্দিও প্রতিবার দুর্ধর্ষ প্রতি আক্রমণের মাধ্যমে সরিয়েছেন সেই সব ভিনদেশী দস্যুদের। এমনকি ক্ষমতাশালী এবং সাহসী যোদ্ধা আলীবর্দি কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ছলনার আশ্রয় নিয়ে ভাস্কর পন্ডিতকে হত্যা করেছেন শুধু বাংলার মানুষ ও মুর্শিদাবাদের ভালোর জন্য। মারাঠা আক্রমণ বাংলার জন্য এক চিরকালীন অভিশাপ। এই সময় এমন এক অস্থির রাজনৈতিক অবস্থায় আলীবর্দি দেশ শাসন করেছেন যে বারবার শত্রুর আক্রমণ আটকাতে আটকাতেই তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত। একবার ছুটতে হয় কাটোয়া, তো তারপরেই বর্ধমান। এতো লড়াই করতে করতে নিজামত কোষাগারেও তখন টানাটানি। কর্মচারীদের মাইনে দিতে গিয়েই নবাবের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠবার উপক্রম। কিন্তু আলীবর্দির পাশেই ছাতার মত দাঁড়িয়ে ছিলেন জগৎ শেঠ ফতেচাঁদ। টাকায় পয়সায় সবসময় তিনিই সাহায্য করে গেছেন মুর্শিদাবাদের নিজামত বৃত্তিতে। আলীবর্দিকেও টাকা জুগিয়ে বারবার রক্ষা করেছেন। সেই সময় জগৎশেঠের প্রতিপত্তি দেখবার মতো। লোকে বলে জগৎশেঠ ছাড়া নবাব অন্ধকার। কিন্তু নবাব ছাড়া জগৎশেঠ অন্ধকার নয়। এতোই তার প্রতাপ৷ জগৎশেঠ অর্থাৎ বিশ্বের ব্যাঙ্কার। মুর্শিদাবাদের মহিমাপুরে তার গদী। নিজস্ব ট্যাঁকশাল, মুদ্রা। ধারে ভারে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো তখন আর ভূভারতে কেউ নেই। কিন্তু আলীবর্দির সময়ে আর্থিক অনটন বাড়লে একদল সৈন্য তার গদী লুঠ করতেও দুবার ভাবেনি। স্বয়ং আলীবর্দিও এই ঘটনায় হতবাক হয়েছেন। তার গদী লুঠ করে প্রায় দু কোটি মুদ্রা নিয়ে চম্পট দিয়েছে মারাঠার দলও। আর এই লুঠপাটের পর জগৎশেঠও মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পাড়ি দেন ঢাকার পথে। আর জগৎশেঠ মহিমাপুরে না থাকলে নবাবের যে কী হাল হয়, তা সেই যুগের প্রতিটি মানুষ বিলক্ষণ জানতেন। রাজধানী থেকে গৃহলক্ষ্মী চলে গেলে যা হাল হয়, আলীবর্দিরও তখন সেই অবস্থা। পরে অনেক অনুরোধ করে মান দিয়ে ফতেচাঁদকে আবার মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনতে হয় নবাবকে। কিন্তু দু দণ্ড সুস্থির ভাবে বসবার জন্য যেন নবাব হননি আলীবর্দি খাঁ। রুস্তম জং যায় তো ভাস্কর পণ্ডিত। আবার ভাস্কর পণ্ডিত ফিরে যায় তো পাটনায় মাথাচাড়া দেয় আফগান সৈন্যরা। নবান সৈন্য থেকেই বিতাড়িত হয়ে তারা তখন নবাবেরই বিদ্রোহী। সুযোগ পেলেই নবাবের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁকে নাকাল করতে দুবার ভাবেনা তারা। তাই তামাম বাংলা বিহার উড়িষ্যা জুড়ে নবাবের ছোটাছুটিতে তখন বিরাম নেই৷ নিজের রাজত্ব ও রাজ্যের মানুষের জন্য ছুটেই কেটে গেছে তাঁর রাজত্বের ষোলোটা বছর। সেই সময়ের মাঝেই মুর্শিদাবাদে বেড়েছে কেল্লা নিজামত। নিজের মায়ের সমাধি নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে বানিয়েছেন অসাধারণ উদ্যান খোসবাগ৷ যা আজও মানুষের চোখ টানে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে। সেখানেই নিজেও আজ শুয়ে আছেন তিনি। ভোরে যেদিন একা একা খোশবাগ পৌঁছেছিলাম আমি, গিয়ে সম্পূর্ণ চত্তরে খুঁজে পাইনি আর একটিও মানুষকে। একা গিয়ে বসেছি তাঁর রাজকীয় কবরের গা ঘেঁষে। চোখের সামনে ফুটে উঠেছে বাংলার একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। খোসবাগ নিজেই একটা অধ্যায়। সেখানে একা কিছু সময় কাটানোর মত অনুভূতি কতবার অর্জন করতে পেরেছি তা হাতে গুনেই বলা যায়।